খাদ্যশস্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
অতি প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে ব্যাপক হারে ধানের চাষ প্রচলিত এবং ঢেঁকি, অন্যকোন দেশীয় পদ্ধতিতে ধান ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে চাল প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলার জনগণের জমি বা ব্যবসায় এবং কর্মসংস্থান থেকে আয় যেমন স্বল্প ছিল তেমনি চালের দামও ছিল কম। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে মুগল শাসনামলে মোটা চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ৩০০ কেজি। বাজারে স্বল্পস্থায়ী ওঠানামার মাধ্যমে দীর্ঘকাল এই মূল্য স্থিতিশীল ছিল।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে ব্যাপক হারে ধানের চাষ প্রচলিত এবং ঢেঁকি, অন্যকোন দেশীয় পদ্ধতিতে ধান ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে চাল প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলার জনগণের জমি বা ব্যবসায় এবং কর্মসংস্থান থেকে আয় যেমন স্বল্প ছিল তেমনি চালের দামও ছিল কম। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে মুগল শাসনামলে মোটা চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ৩০০ কেজি। বাজারে স্বল্পস্থায়ী ওঠানামার মাধ্যমে দীর্ঘকাল এই মূল্য স্থিতিশীল ছিল।


উদ্বৃত্ত চাল, গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে এবং পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপসমূহে রপ্তানি করা হতো। মুর্শিদ কুলী খাঁর শাসনামলে (১৭০৪-১৭২৭) সাধারণ জাতের চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ২০০ কেজি। নবাব নিজে খাদ্যের মূল্য সস্তা রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেন এবং ধনী ব্যক্তিদের খাদ্যশস্য মজুদ করতে দিতেন না। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশের ব্যবসার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ মতা লাভ করে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানিকে দেওয়ানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৭৬৮ সাল থেকে দুর্ভি ও অভাব শুরু হয়। চালের দাম টাকায় ১০-১৫ কেজিতে বৃদ্ধির ফলে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত দেশ কখনওই আঞ্চলিকভাবে বা জাতীয়ভাবে অভাব বা দুর্ভিরে কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয় নি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৮০০-১৮৫৮) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের অধীনে চালের দাম সাধারণভাবে টাকায় ৪০-৫০ কেজিতে স্থিতিশীল থাকে। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার বাংলাসহ ভারতের বৃহদাংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৮৫৮-১৯০০ সময়ে দুর্ভিরে বছরগুলি ছাড়া সাধারণ মানের চালের দাম ছিল টাকায় ২৫-৩০ কেজি।  
উদ্বৃত্ত চাল, গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে এবং পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপসমূহে রপ্তানি করা হতো। মুর্শিদ কুলী খাঁর শাসনামলে (১৭০৪-১৭২৭) সাধারণ জাতের চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ২০০ কেজি। নবাব নিজে খাদ্যের মূল্য সস্তা রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেন এবং ধনী ব্যক্তিদের খাদ্যশস্য মজুদ করতে দিতেন না। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশের ব্যবসার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানিকে দেওয়ানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৭৬৮ সাল থেকে দুর্ভিক্ষ ও অভাব শুরু হয়। চালের দাম টাকায় ১০-১৫ কেজিতে বৃদ্ধির ফলে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত দেশ কখনওই আঞ্চলিকভাবে বা জাতীয়ভাবে অভাব বা দুর্ভিক্ষের কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয় নি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৮০০-১৮৫৮) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের অধীনে চালের দাম সাধারণভাবে টাকায় ৪০-৫০ কেজিতে স্থিতিশীল থাকে। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার বাংলাসহ ভারতের বৃহদাংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৮৫৮-১৯০০ সময়ে দুর্ভিক্ষের বছরগুলি ছাড়া সাধারণ মানের চালের দাম ছিল টাকায় ২৫-৩০ কেজি।  


১৯০১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য মোটামুটি টাকায় ১০-১২ কেজিতে বিদ্যমান ছিল। তবে ১৯১৪-১৯২৯ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য উল্লিখিত দামের দ্বিগুণ হয়। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময় বাংলায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় আধা কেজি বা তারও কমে দাঁড়ায়, তবে কোথাও কোথাও তখন টাকায় ১.৭৫ কেজি চাল পাওয়া যেত। এই দুর্ভিে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে।
১৯০১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য মোটামুটি টাকায় ১০-১২ কেজিতে বিদ্যমান ছিল। তবে ১৯১৪-১৯২৯ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য উল্লিখিত দামের দ্বিগুণ হয়। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময় বাংলায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় আধা কেজি বা তারও কমে দাঁড়ায়, তবে কোথাও কোথাও তখন টাকায় ১.৭৫ কেজি চাল পাওয়া যেত। এই দুর্ভিক্ষের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে।


যে ভৌগোলিক এলাকা এখন বাংলাদেশ নামে অভিহিত ব্রিটিশ শাসনামলে তা কখনও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। পার্শ্ববর্তী বার্মা থেকে নিয়মিতভাবে চাল আমদানি করা হতো। গম এবং গমজাত পণ্য আসত বর্তমান ভারতের অধীনস্থ পশ্চিমাঞ্চল থেকে। ১৯৩০-এর দশকে অবিভক্ত বাংলার চাল ও গমের চাহিদার পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৭.৫ মিলিয়ন টন। এই চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এর অর্ধেক ছিল চাল আর অর্ধেক গম। ১৯৪১ সালে বার্মায় জাপানি সেনাবাহিনী প্রবেশের ফলে বাংলায় খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সেদেশ থেকে চাল সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক গৃহীত বর্জন নীতির (এক ধরনের পোড়ামাটি নীতি) আওতায় নৌকা ও অন্যান্য সব ধরনের পরিবহণ যানবাহন ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং শত্র“দের নাগালের বাইরে রাখার জন্য সকল খাদ্যমজুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে নজিরবিহীন আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং চালের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১৯৪২ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর (ঈরারষ ঝঁঢ়ঢ়ষরবং উবঢ়ধৎঃসবহঃ) স্থাপন করে সরকার দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
যে ভৌগোলিক এলাকা এখন বাংলাদেশ নামে অভিহিত ব্রিটিশ শাসনামলে তা কখনও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। পার্শ্ববর্তী বার্মা থেকে নিয়মিতভাবে চাল আমদানি করা হতো। গম এবং গমজাত পণ্য আসত বর্তমান ভারতের অধীনস্থ পশ্চিমাঞ্চল থেকে। ১৯৩০-এর দশকে অবিভক্ত বাংলার চাল ও গমের চাহিদার পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৭.৫ মিলিয়ন টন। এই চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এর অর্ধেক ছিল চাল আর অর্ধেক গম। ১৯৪১ সালে বার্মায় জাপানি সেনাবাহিনী প্রবেশের ফলে বাংলায় খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সেদেশ থেকে চাল সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক গৃহীত বর্জন নীতির (এক ধরনের পোড়ামাটি নীতি) আওতায় নৌকা ও অন্যান্য সব ধরনের পরিবহণ যানবাহন ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং শত্রুদের নাগালের বাইরে রাখার জন্য সকল খাদ্যমজুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে নজিরবিহীন আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং চালের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১৯৪২ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর (Civil Supplies Department) স্থাপন করে সরকার দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।


১৯৪৩-এর মন্বন্তরের প্রোপটে সরকার বেঙ্গল রেশনিং অর্ডার ১৯৪৩ জারির মাধ্যমে কিছু ঘোষিত এলাকায় জনগণের মধ্যে নির্ধারিত কোটাভিত্তিতে খাদ্যশস্য সরবরাহের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই আদেশবলে সরকার কয়েকটি ভোগ্যপণ্যকে রেশনদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করে। এসব পণ্য কিছু নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রেশন কার্ড উপস্থাপন সাপেে পাইকারি ও খুচরা ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে সংবিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি (ঝঃধঃঁঃড়ৎু জধঃরড়হরহম ঝুংঃবস) বা বহুল পরিচিত এসআর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলসমূহ, স্থাপনা মালিক, শ্রমিক, কর্মচারী, স্থানীয় সরকার কর্তৃপ এবং দোকান, কেন্টিন গুদামের ব্যবস্থাপক বা ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। বিশেষায়িত রেশন দোকান খোলা হয় এবং ঘোষিত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রেশন কার্ড ইস্যু করা হয়।
১৯৪৩-এর মন্বন্তরের প্রোপটে সরকার বেঙ্গল রেশনিং অর্ডার ১৯৪৩ জারির মাধ্যমে কিছু ঘোষিত এলাকায় জনগণের মধ্যে নির্ধারিত কোটাভিত্তিতে খাদ্যশস্য সরবরাহের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই আদেশবলে সরকার কয়েকটি ভোগ্যপণ্যকে রেশনদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করে। এসব পণ্য কিছু নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রেশন কার্ড উপস্থাপন সাপেে পাইকারি ও খুচরা ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে সংবিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি (Statutory Rationing System) বা বহুল পরিচিত এসআর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলসমূহ, স্থাপনা মালিক, শ্রমিক, কর্মচারী, স্থানীয় সরকার কর্তৃপ এবং দোকান, কেন্টিন গুদামের ব্যবস্থাপক বা ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। বিশেষায়িত রেশন দোকান খোলা হয় এবং ঘোষিত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রেশন কার্ড ইস্যু করা হয়।


১৯৪৬ সালে চাল ও গম সংগ্রহ নীতিকে সরকারের একচেটিয়া অধিকারে পরিণত করা হয়। বাধ্যতামূলক সংগ্রহের অধীনে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ (সাময়িক মতা) অধ্যাদেশ ১৯৪৬-এর অধীনে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হয়। এর ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ ও ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে সংরতি থাকে। কিন্তু বাংলায় অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিমাণ স্বল্পই থেকে যায়। ১৯৪৫-৪৬ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শস্য আমদানি করেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রা করা সম্ভব হয় নি। সংবিধিবদ্ধ রেশনের আওতায় খাদ্যশস্যের কোটা দৈনিক ১ পাউন্ড থেকে হ্রাস করে ১২ আউন্স এবং ১৯৪৬ সালে তারও কম করা হয়।  
১৯৪৬ সালে চাল ও গম সংগ্রহ নীতিকে সরকারের একচেটিয়া অধিকারে পরিণত করা হয়। বাধ্যতামূলক সংগ্রহের অধীনে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ (সাময়িক ক্ষমতা) অধ্যাদেশ ১৯৪৬-এর অধীনে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হয়। এর ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ ও ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে সংরতি থাকে। কিন্তু বাংলায় অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিমাণ স্বল্পই থেকে যায়। ১৯৪৫-৪৬ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শস্য আমদানি করেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রা করা সম্ভব হয় নি। সংবিধিবদ্ধ রেশনের আওতায় খাদ্যশস্যের কোটা দৈনিক ১ পাউন্ড থেকে হ্রাস করে ১২ আউন্স এবং ১৯৪৬ সালে তারও কম করা হয়।  


১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা শহরে চালু থাকে। ১৯৪৯ সালে আরও ১১টি শহরে (চাঁদপুর, রাজবাড়ী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও টাঙ্গাইল) এসআর চালু করা হয়। চাল, আটা, ভুশি, সুজি, রুটি (সাদা, বাদামি ও আস্ত গমের) এবং চিনিকে রেশন দ্রব্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এসআর-ভুক্ত এলাকায় সাপ্তাহিক কোটা-ভিত্তিতে চাল ও গম/আটার সরবরাহ মোটামুটি নিয়মিত ছিল। সংশোধিত রেশনিং আদেশ ১৯৪৯ (গড়ফরভরবফ জধঃরড়হরহম ঙৎফবৎ)-এর আওতায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রামীণ এলাকায় সীমিত পরিমাণে রেশনিং পদ্ধতি চালু করা হয়। আয় অনুসারে গ্রামীণ জনগণকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, ইউনিয়ন এবং শহর খাদ্য ও রিলিফ কমিটির মাধ্যমে একটি বিতরণ অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়। সংশোধিত রেশনিং পদ্ধতির আওতায় প্রাপ্যতা সাপেে পনেরো দিনে বা মাসে একবার খাদ্যশস্য বিতরণ করা হতো। সরকারের প্রধান প্রয়াস ছিল অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, বাণিজ্যিক আমদানি এবং খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত শস্যকে কয়েকটি চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করে সারাবছর সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতিকে (চঁনষরপ ঋড়ড়ফ উরংঃৎরনঁঃরড়হ ঝুংঃবস-চঋউঝ) সচল রাখা। পিএফডিএস-এর অধীনে চ্যানেল ছিল সাতটি। এগুলির মধ্যে ৫টি ছিল অর্থ-সংশ্লিষ্ট তথা (সংবিধিবদ্ধ রেশনিং, সংশোধিত রেশনিং, অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকার, অন্যান্য অগ্রাধিকার এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানাদির কর্মচারী) এবং ২টি বিনা অর্থে অর্থাৎ খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ। অর্থের বিনিময়ে বিতরণকৃত খাদ্যশস্য বেশ খানিকটা ভর্তুকির বিনিময়ে দেওয়া হয় এবং মোট সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতির ৯৮ শতাংশেরও বেশি এই চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে তিগ্রস্ত লোকজনের দুঃখকষ্ট লাঘবের জন্য স্থানীয়ভাবে খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ দিয়ে থাকে। পিএফডিএস-এর অধীনে চাল ও গম উভয়ই বিতরণ করা হয়। মাঝে মাঝে চিনি, ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য পণ্যও প্রদান করা হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পিএফডিএস-এর আওতায় বাৎসরিক গড় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পরিমাণ ছিল ২.৫ মিলিয়ন টন। খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত গমের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিএফডিএস-এর অধীনে বিতরণের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে লোকজনও গমকে নিয়মিত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে।
১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা শহরে চালু থাকে। ১৯৪৯ সালে আরও ১১টি শহরে (চাঁদপুর, রাজবাড়ী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও টাঙ্গাইল) এসআর চালু করা হয়। চাল, আটা, ভুশি, সুজি, রুটি (সাদা, বাদামি ও আস্ত গমের) এবং চিনিকে রেশন দ্রব্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এসআর-ভুক্ত এলাকায় সাপ্তাহিক কোটা-ভিত্তিতে চাল ও গম/আটার সরবরাহ মোটামুটি নিয়মিত ছিল। সংশোধিত রেশনিং আদেশ ১৯৪৯ (Modified Rationing Order)-এর আওতায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রামীণ এলাকায় সীমিত পরিমাণে রেশনিং পদ্ধতি চালু করা হয়। আয় অনুসারে গ্রামীণ জনগণকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, ইউনিয়ন এবং শহর খাদ্য ও রিলিফ কমিটির মাধ্যমে একটি বিতরণ অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়। সংশোধিত রেশনিং পদ্ধতির আওতায় প্রাপ্যতা সাপেে পনেরো দিনে বা মাসে একবার খাদ্যশস্য বিতরণ করা হতো। সরকারের প্রধান প্রয়াস ছিল অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, বাণিজ্যিক আমদানি এবং খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত শস্যকে কয়েকটি চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করে সারাবছর সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতিকে ((Public Food Distribution System-PFDS) সচল রাখা। পিএফডিএস-এর অধীনে চ্যানেল ছিল সাতটি। এগুলির মধ্যে ৫টি ছিল অর্থ-সংশ্লিষ্ট তথা (সংবিধিবদ্ধ রেশনিং, সংশোধিত রেশনিং, অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকার, অন্যান্য অগ্রাধিকার এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানাদির কর্মচারী) এবং ২টি বিনা অর্থে অর্থাৎ খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ। অর্থের বিনিময়ে বিতরণকৃত খাদ্যশস্য বেশ খানিকটা ভর্তুকির বিনিময়ে দেওয়া হয় এবং মোট সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতির ৯৮ শতাংশেরও বেশি এই চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের দুঃখকষ্ট লাঘবের জন্য স্থানীয়ভাবে খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ দিয়ে থাকে। পিএফডিএস-এর অধীনে চাল ও গম উভয়ই বিতরণ করা হয়। মাঝে মাঝে চিনি, ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য পণ্যও প্রদান করা হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পিএফডিএস-এর আওতায় বাৎসরিক গড় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পরিমাণ ছিল ২.৫ মিলিয়ন টন। খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত গমের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিএফডিএস-এর অধীনে বিতরণের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে লোকজনও গমকে নিয়মিত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে।


সরকার ১৯৫৫ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং সরকারি গুদামে জমাকৃত সব খাদ্যশস্য বিক্রয় করে দেয়। অধিদপ্তরের সকল কর্মচারী ছাঁটাই করে তাদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু শীঘ্রই চালের দাম বাড়তে থাকে এবং খাদ্যাভাব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং সারাদেশে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। এর ফলে ১৯৫৬ সালে সরকার সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তরের পুনরুজ্জীবন এবং ১৯টি বড় ও ছোট শহরে এসআর-এর আওতায় পুনরায় খাদ্যশস্য বিতরণ শুরু করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৯ সালে গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণের ল্েয এসআর পুনরুজ্জীবিত করা হয়। অবশ্য, ১৯৬০ সালে ১৬টি ছোট শহর থেকে এসআর বিলুপ্ত করা হয় যদিও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তা অব্যাহত থাকে। সারণি ১  থেকে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে কখনই খাদ্য উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না।
সরকার ১৯৫৫ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং সরকারি গুদামে জমাকৃত সব খাদ্যশস্য বিক্রয় করে দেয়। অধিদপ্তরের সকল কর্মচারী ছাঁটাই করে তাদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু শীঘ্রই চালের দাম বাড়তে থাকে এবং খাদ্যাভাব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং সারাদেশে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। এর ফলে ১৯৫৬ সালে সরকার সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তরের পুনরুজ্জীবন এবং ১৯টি বড় ও ছোট শহরে এসআর-এর আওতায় পুনরায় খাদ্যশস্য বিতরণ শুরু করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৯ সালে গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষে এসআর পুনরুজ্জীবিত করা হয়। অবশ্য, ১৯৬০ সালে ১৬টি ছোট শহর থেকে এসআর বিলুপ্ত করা হয় যদিও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তা অব্যাহত থাকে। সারণি ১  থেকে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে কখনই খাদ্য উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না।


''সারণি'' ১ পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।
''সারণি'' ১ পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।
সময় চাল গম ডাল তেলবীজ বার্লি ভুট্টা মোট
১৯৪৮-৫২ ৭২৩২ ২১ ২৬৬ ১৩৮ ১৬ ২ ৭৬৭৫
১৯৫৩-৫৭ ৭৫৪৫ ২৪ ২৮১ ২০২ ১৭ ২ ৮০৭১
১৯৫৮-৬২ ৮৩৯৬ ২৯ ২২০ ১৮৩ ১৪ ৪ ৮৮৪৬
১৯৬৩-৬৭ ৯৮৬০ ৩৯ ২০৫ ২১৭ ১৪ ৩ ১০৩৩৮
১৯৬৮-৭২ ১০৯৩৫ ৯৫ ২৭৮ ৩১৩ ২০ ৩ ১১৬৪৪


জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং মোট উৎপাদন থেকে বীজ ও বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে নীট উৎপাদন হিসেবে করলে দেখা যায় ১৯৫৬-১৯৫৯ সময়ে বাৎসরিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬.৮৪ মিলিয়ন টন। তবে ১৯৬৮-১৯৭১ সালে এই ঘাটতি হ্রাস পেয়ে ৩.০২ মিলিয়ন টনে দাঁড়ায়। অব্যাহত খাদ্য ঘাটতির ফলে পিএফডিএস-এর অধীনে অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য বিতরণের এবং সংরণের জন্য নতুন গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫০-এর দশকে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়-কেন্দ্র ও শিল্প এলাকায় কেন্দ্রীয় মজুত ভাণ্ডার (ঈবহঃৎধষ ঝঃড়ৎধমব উবঢ়ড়ঃ-ঈঝউং) এবং থানা ও বাজারে স্থানীয় সরবরাহ ভাণ্ডার (খড়পধষ ঝঁঢ়ঢ়ষু উবঢ়ড়ঃ-খঝউং) স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। এর পরে ১৯৭১ সালে বিশ্ব ব্যাংক ও সুইডিশ ঋণের আওতায় চট্টগ্রাম, আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও সান্তাহারে ৪টি সাইলো নির্মাণ করা হয়। এগুলি লাহোর শেড, কলকাতা শেড, টিন শেড, জুট শেড, এবং আসাম টাইপ ইত্যাদি নামে পরিচিত পুরানো গুদামের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। মজুত মতা ১৯৪৭ সালের ০.১৬৭ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭১ সালে ০.৯১৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছে। পিএফডিএস পরিচালনার ফলে চাল ও গমের মূল্য সহনীয় হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে চালের মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৮ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র ১.০৮ টাকা এবং গমের/আটার মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৯ টাকা থেকে ০.৭৭ টাকায় উন্নীত হয়।
{| class="table table-bordered table-hover"
|-
| সময়   || চাল  || গম  || ডাল  || তেলবীজ  || বার্লি   || ভুট্টা   || মোট
|-
| ১৯৪৮-৫২   || ৭২৩২  || ২১  || ২৬৬   || ১৩৮   || ১৬  || ২  || ৭৬৭৫
|-
| ১৯৫৩-৫৭   || ৭৫৪৫  || ২৪  || ২৮১   || ২০২  || ১৭  || ২  || ৮০৭১
|-
| ১৯৫৮-৬২   || ৮৩৯৬  || ২৯  || ২২০   || ১৮৩  || ১৪  || ৪  || ৮৮৪৬
|-
| ১৯৬৩-৬৭   || ৯৮৬০   || ৩৯  || ২০৫  || ২১৭  || ১৪   || ৩  || ১০৩৩৮
|-
| ১৯৬৮-৭২  || ১০৯৩৫   || ৯৫  || ২৭৮  || ৩১৩  || ২০  || ৩  || ১১৬৪৪
|}


মুক্তিযুদ্ধ কালীন বাংলাদেশের মানুষ ও সম্পদ উভয়ের ব্যাপক তি সাধিত হয়। এ সময় চাষিরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে নি। ফলে শস্যের উৎপাদন মারাÍকভাবে ব্যাহত হয়। যুদ্ধের পর প্রত্যাবাসিত জনগণের (১০ মিলিয়নেরও বেশি) জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা সংস্থার সমন্বয়ের অধীনে কানাডা, ভারত, ইউএনআরওবি, ইউনিসেফ, আইভিএ ১৯৭২ সালে ৭৭,০০০ মেট্রিক টন চাল ও ০.৮৪৭ মিলিয়ন টন গম সরবরাহ করে। বাংলাদেশ সরকার দাতাগোষ্ঠীর বিবেচনার জন্য বাৎসরিক খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি তাদের নিকট উপস্থাপনের একটি প্রথা চালু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে খাদ্য-সাহায্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এবং দেশের প্রশাসনিক, আর্থিক, ব্যাংকিং পরিকল্পনা কৌশলে একে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শেষে এসে সরকারের খাদ্যনীতির দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল এবং পরিচালনা পদ্ধতি/ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অধিক খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য অধিকার এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই খাতের সকল নীতির ল্য হয়ে ওঠে। আশির দশকের শেষে প্রণীত খাদ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং একটি নির্ভরযোগ্য জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই নীতির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে মূল্য সহায়তা প্রদান, সরকারি খাদ্য বিতরণে ভর্তুকি হ্রাস, আরও বেশিসংখ্যক গরিব জনগোষ্ঠীকে পিএফডিএস-এর আওতায় আনার জন্য এর পরিধি বিস্তার, খাদ্য উৎপাদন বিতরণে ব্যক্তিগত খাতের ভূমিকা বৃদ্ধি এবং খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়। কৃষক কর্তৃক অধিকহারে সার, সেচ সুবিধা উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার এবং উৎসাহ-মূল্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সক্রিয় সহায়তা প্রদানের ফলে চাল ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সারণি-২-এ বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো।
জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং মোট উৎপাদন থেকে বীজ বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে নীট উৎপাদন হিসেবে করলে দেখা যায় ১৯৫৬-১৯৫৯ সময়ে বাৎসরিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬.৮৪ মিলিয়ন টন। তবে ১৯৬৮-১৯৭১ সালে এই ঘাটতি হ্রাস পেয়ে ৩.০২ মিলিয়ন টনে দাঁড়ায়। অব্যাহত খাদ্য ঘাটতির ফলে পিএফডিএস-এর অধীনে অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য বিতরণের এবং সংরণের জন্য নতুন গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫০-এর দশকে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়-কেন্দ্র শিল্প এলাকায় কেন্দ্রীয় মজুত ভাণ্ডার (Central Storage Depot-CSDs) এবং থানা ও বাজারে স্থানীয় সরবরাহ ভাণ্ডার (Local Supply Depot-LSDs) স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। এর পরে ১৯৭১ সালে বিশ্ব ব্যাংক ও সুইডিশ ঋণের আওতায় চট্টগ্রাম, আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সান্তাহারে ৪টি সাইলো নির্মাণ করা হয়। এগুলি লাহোর শেড, কলকাতা শেড, টিন শেড, জুট শেড, এবং আসাম টাইপ ইত্যাদি নামে পরিচিত পুরানো গুদামের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। মজুত ক্ষমতা ১৯৪৭ সালের ০.১৬৭ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭১ সালে ০.৯১৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছে। পিএফডিএস পরিচালনার ফলে চাল ও গমের মূল্য সহনীয় হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে চালের মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৮ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র ১.০৮ টাকা এবং গমের/আটার মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৯ টাকা থেকে ০.৭৭ টাকায় উন্নীত হয়।


সারণি-২  বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।
মুক্তিযুদ্ধ কালীন বাংলাদেশের মানুষ ও সম্পদ উভয়ের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ সময় চাষিরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে নি। ফলে শস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। যুদ্ধের পর প্রত্যাবাসিত জনগণের (১০ মিলিয়নেরও বেশি) জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা সংস্থার সমন্বয়ের অধীনে কানাডা, ভারত, ইউএনআরওবি, ইউনিসেফ, আইভিএ ১৯৭২ সালে ৭৭,০০০ মেট্রিক টন চাল ও ০.৮৪৭ মিলিয়ন টন গম সরবরাহ করে। বাংলাদেশ সরকার দাতাগোষ্ঠীর বিবেচনার জন্য বাৎসরিক খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি তাদের নিকট উপস্থাপনের একটি প্রথা চালু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে খাদ্য-সাহায্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এবং দেশের প্রশাসনিক, আর্থিক, ব্যাংকিং ও পরিকল্পনা কৌশলে একে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শেষে এসে সরকারের খাদ্যনীতির দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল এবং পরিচালনা পদ্ধতি/ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অধিক খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য অধিকার এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই খাতের সকল নীতির ল্য হয়ে ওঠে। আশির দশকের শেষে প্রণীত খাদ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং একটি নির্ভরযোগ্য জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই নীতির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে মূল্য সহায়তা প্রদান, সরকারি খাদ্য বিতরণে ভর্তুকি হ্রাস, আরও বেশিসংখ্যক গরিব জনগোষ্ঠীকে পিএফডিএস-এর আওতায় আনার জন্য এর পরিধি বিস্তার, খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণে ব্যক্তিগত খাতের ভূমিকা বৃদ্ধি এবং খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়। কৃষক কর্তৃক অধিকহারে সার, সেচ সুবিধা ও উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার এবং উৎসাহ-মূল্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সক্রিয় সহায়তা প্রদানের ফলে চাল ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সারণি--এ বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো।
সময় চাল গম ডাল তেলবীজ বার্লি ভুট্টা মোট
১৯৭৩-৭৭ ১১৩৭৭ ১৫৭ ২২৪ ২২৭ ১৬ ২ ১২০০৩
১৯৭৮-৮২ ১৩০৬৭ ৭৩৯ ২১৯ ২৫৪ ১২ ১ ১৪২৯২
১৯৮৩-৮৭ ১৪৭৫৮ ১১৮১ ৪৬৭ ৪২২ ১৩ ৩ ১৬৮৪৪
১৯৮৮-৯২ ১৬৯৮৩ ১০০৬ ৫১৬ ৪৪২ ১১ ৩ ১৮৯৬১
১৯৯৩-৯৭ ১৭৯৮২ ১২৭৫ ৫২৬ ৪৬৪ ৬ ৩ ২০২৫৬


সারণিতে লণীয় যে, দানাদার শস্যের উৎপাদন ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সাইকোন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল হানির ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বিপুল থেকে যায়।
''সারণি ২''  বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।
 
{| class="table table-bordered table-hover"
|-
| সময় || চাল || গম || ডাল || তেলবীজ || বার্লি || ভুট্টা || মোট
|-
| ১৯৭৩-৭৭ || ১১৩৭৭ || ১৫৭ || ২২৪ || ২২৭ || ১৬ || ২ || ১২০০৩
|-
| ১৯৭৮-৮২ || ১৩০৬৭ || ৭৩৯ || ২১৯ || ২৫৪ || ১২ || ১ || ১৪২৯২
|-
| ১৯৮৩-৮৭ || ১৪৭৫৮ || ১১৮১ || ৪৬৭ || ৪২২ || ১৩ || ৩ || ১৬৮৪৪
|-
| ১৯৮৮-৯২ || ১৬৯৮৩ || ১০০৬ || ৫১৬ || ৪৪২ || ১১ || ৩ || ১৮৯৬১
|-
| ১৯৯৩-৯৭ || ১৭৯৮২ || ১২৭৫ || ৫২৬ || ৪৬৪ || ৬ || ৩ || ২০২৫৬
|}
 
 
সারণিতে লক্ষণীয় যে, দানাদার শস্যের উৎপাদন ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সাইকোন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল হানির ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বিপুল থেকে যায়।


বাৎসরিক ঘাটতি (জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার চাহিদা ও নেট উৎপাদন অর্থাৎ মোট উৎপাদন থেকে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য, বীজ ও বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে পার্থক্য) ১৯৭৩-১৯৭৭ সময়ে ছিল ২.১৪ মিলিয়ন টন। ১৯৯৩-১৯৯৭ সময়ে এই ঘাটতি ১.৪৬ মিলিয়ন টনে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল ও গম বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। কাস্তে দিয়ে কাটার সময়, মাঠ থেকে শুকানোর স্থানে পরিবহণের প্রাক্কালে, সিদ্ধ করা এবং ছাঁটাইয়ের সময় অনেক শস্য অপচয় হয়ে থাকে। অনুপযোগী প্যাকিং, অপর্যাপ্ত শুকানো, অতিমাত্রায় আর্দ্রতা, চুরি এবং পোকামাকড়, ইঁদুর ও পাখির আক্রমণের কারণেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়। এছাড়া, একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহণের পর্যায়েও একটি অংশ অপচয় হয়।
বাৎসরিক ঘাটতি (জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার চাহিদা ও নেট উৎপাদন অর্থাৎ মোট উৎপাদন থেকে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য, বীজ ও বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে পার্থক্য) ১৯৭৩-১৯৭৭ সময়ে ছিল ২.১৪ মিলিয়ন টন। ১৯৯৩-১৯৯৭ সময়ে এই ঘাটতি ১.৪৬ মিলিয়ন টনে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল ও গম বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। কাস্তে দিয়ে কাটার সময়, মাঠ থেকে শুকানোর স্থানে পরিবহণের প্রাক্কালে, সিদ্ধ করা এবং ছাঁটাইয়ের সময় অনেক শস্য অপচয় হয়ে থাকে। অনুপযোগী প্যাকিং, অপর্যাপ্ত শুকানো, অতিমাত্রায় আর্দ্রতা, চুরি এবং পোকামাকড়, ইঁদুর ও পাখির আক্রমণের কারণেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়। এছাড়া, একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহণের পর্যায়েও একটি অংশ অপচয় হয়।


বন্দরে জাহাজ থেকে খালাসের সময় অযতœ ও অবহেলার কারণে তি হয় জাহাজ প্রতি কয়েক শত টন পর্যন্ত। এর ফলে অনেক সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলে। বস্তায় ভর্তি ও পুনঃভর্তির সময় এবং সরকারি খাতে গুদাম থেকে খাদ্যশস্য বরাদ্দ বা পুনঃবরাদ্দের সময়ও কিছু শস্য বিনষ্ট হয়। সরকারি খাতে সারাবছর নৌকা, বার্জ, রেলওয়ে ওয়াগন, ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য দেশের অভ্যন্তরে এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে পরিবহণ করা হয়ে থাকে। এ কারণে সরকার নির্ধারিত হারে পরিবহণজনিত তি অনুমোদন করে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯১ সালের একটি সমীা অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে খাদ্যশস্যের মোট অপচয়ের পরিমাণ ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ১১.৫৮%, তবে, মন্ত্রণালয় ১০% তি বাদ দিয়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা হিসেব করে থাকে।  
বন্দরে জাহাজ থেকে খালাসের সময় অযত্ন ও অবহেলার কারণে ক্ষতি হয় জাহাজ প্রতি কয়েক শত টন পর্যন্ত। এর ফলে অনেক সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলে। বস্তায় ভর্তি ও পুনঃভর্তির সময় এবং সরকারি খাতে গুদাম থেকে খাদ্যশস্য বরাদ্দ বা পুনঃবরাদ্দের সময়ও কিছু শস্য বিনষ্ট হয়। সরকারি খাতে সারাবছর নৌকা, বার্জ, রেলওয়ে ওয়াগন, ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য দেশের অভ্যন্তরে এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে পরিবহণ করা হয়ে থাকে। এ কারণে সরকার নির্ধারিত হারে পরিবহণজনিত ক্ষতি অনুমোদন করে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯১ সালের একটি সমীা অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে খাদ্যশস্যের মোট অপচয়ের পরিমাণ ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ১১.৫৮%, তবে, মন্ত্রণালয় ১০% ক্ষতি বাদ দিয়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা হিসেব করে থাকে।  


সরকার প্রধানত খাদ্য-সাহায্য কর্মসূচির অধীনে ও নগদ মূল্যে আমদানি এবং আংশিকভাবে দেশের কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের উদ্বৃত্ত অংশ ক্রয়ের মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক গড় সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ০.৪ মিলিয়ন টন, ১৯৮১-৯০ সময়কালে এই পরিমাণ ছিল ০.৪৪ মিলিয়ন টন এবং ১৯৯১-৯৭ সময়ে সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়ায় ০.৫০ মিলিয়ন টনে। সংগ্রহের ইতিহাসে মাত্র দুই বার (১৯৮১ ও ১৯৯২) এই অঙ্ক ১ মিলিয়ন টন অতিক্রম করেছিল। চাল ও গম সংগ্রহের যে মূল্য ধার্য করা হয়, সর্বদাই তা বাজার মূল্যের চেয়ে কম থাকে এবং তা বেশির ভাগ চাষিকেই সহায়ক-মূল্য দিতে পারে না। ১৯৮৩ সাল থেকে স্বয়ংক্রিয় চাল কলগুলিকে সরকারি খাতে ধান ক্রয় ও তা থেকে প্রাপ্ত চাল সরকারি গুদামে সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়।  
সরকার প্রধানত খাদ্য-সাহায্য কর্মসূচির অধীনে ও নগদ মূল্যে আমদানি এবং আংশিকভাবে দেশের কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের উদ্বৃত্ত অংশ ক্রয়ের মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক গড় সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ০.৪ মিলিয়ন টন, ১৯৮১-৯০ সময়কালে এই পরিমাণ ছিল ০.৪৪ মিলিয়ন টন এবং ১৯৯১-৯৭ সময়ে সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়ায় ০.৫০ মিলিয়ন টনে। সংগ্রহের ইতিহাসে মাত্র দুই বার (১৯৮১ ও ১৯৯২) এই অঙ্ক ১ মিলিয়ন টন অতিক্রম করেছিল। চাল ও গম সংগ্রহের যে মূল্য ধার্য করা হয়, সর্বদাই তা বাজার মূল্যের চেয়ে কম থাকে এবং তা বেশির ভাগ চাষিকেই সহায়ক-মূল্য দিতে পারে না। ১৯৮৩ সাল থেকে স্বয়ংক্রিয় চাল কলগুলিকে সরকারি খাতে ধান ক্রয় ও তা থেকে প্রাপ্ত চাল সরকারি গুদামে সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়।  
৪৮ নং লাইন: ৬৭ নং লাইন:
১৯৭৪ সালে নতুন রেশনকার্ড বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্ডগুলি প্রতি পরিবারে সর্বোচ্চ ৬ সদস্যের জন্য সীমিত ছিল এবং সাপ্তাহিক কোটার পরিমাণ ১৯৭৩ সালের জনপ্রতি ৩ সের (প্রায় ২.৮ কেজি) থেকে কমিয়ে ১৯৮৬ সালে ১.৫ কেজি করা হয়। এসআর-এর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের পরিমাণ ১৯৭৬-৮১ সময়কালে ২০ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করে এবং ১৯৮২ সাল (১৫%) থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৩ সালে ৫% শতাংশে দাঁড়ায়।
১৯৭৪ সালে নতুন রেশনকার্ড বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্ডগুলি প্রতি পরিবারে সর্বোচ্চ ৬ সদস্যের জন্য সীমিত ছিল এবং সাপ্তাহিক কোটার পরিমাণ ১৯৭৩ সালের জনপ্রতি ৩ সের (প্রায় ২.৮ কেজি) থেকে কমিয়ে ১৯৮৬ সালে ১.৫ কেজি করা হয়। এসআর-এর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের পরিমাণ ১৯৭৬-৮১ সময়কালে ২০ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করে এবং ১৯৮২ সাল (১৫%) থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৩ সালে ৫% শতাংশে দাঁড়ায়।


গ্রামীণ জনগণের জন্য সংশোধিত রেশনিং (এমআর) বরাবর অনিয়মিতই থেকে যায় এবং ১৯৮৯ সালে সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে এর পরিবর্তে পল্লী রেশনিং নামে একটি নতুন পদ্ধতির রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯২ সালে আরআর ব্যবস্থা স্থগিত করে দেওয়া হয়। পিএফডিএস চ্যানেলের খাদ্য বিতরণ প্রকৃত অর্থে বৃহৎ নিয়োগকর্তার (খধৎমব ঊসঢ়ষড়ুবৎ-খঊ) অধীনে সরকারি খাতের এবং কিছু নির্বাচিত বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রয়। পিএফডিএস চ্যানেলের অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকারের অধীনে যারা খাদ্যশস্য পায় তারা হচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), আনসার ও রী বাহিনীর সদস্যগণ, অর্ডিন্যান্স কারখানার কর্মচারী এবং জেলখানা ও হাসপাতালের কর্মচারী ও বাসিন্দাগণ। বোর্ড, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মচারিবৃন্দ এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের শিকবৃন্দ, এবং এতিমখানা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা পিএফডিএস চ্যানেলের অন্যান্য অগ্রাধিকারের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য পায়। পিএফডিএস চ্যানেলের খয়রাতি সাহায্যের আওতায় দুস্থ জনগণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তিগ্রস্তদের মধ্যে সাহায্য হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হয়। টেস্ট রিলিফ চ্যানেলের অধীনে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য বর্ষাকালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। উক্ত ৭টি চ্যানেল ছাড়াও আরও কয়েকটি পিএফডিএস চ্যানেল রয়েছে যেগুলি মূলত মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হয়। এ ধরনের একটি চ্যানেলের নাম হচ্ছে আটা মিল। এর অধীনে, তালিকাভুক্ত আটা মিলের কাছে নির্ধারিত মূল্যে মাসিক কোটাভিত্তিতে রুটি কারখানা, বেকারি ও অন্যান্য গ্রাহকের কাছে বিতরণের জন্য গম বিক্রয় করা হয়।
গ্রামীণ জনগণের জন্য সংশোধিত রেশনিং (এমআর) বরাবর অনিয়মিতই থেকে যায় এবং ১৯৮৯ সালে সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে এর পরিবর্তে পল্লী রেশনিং নামে একটি নতুন পদ্ধতির রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯২ সালে আরআর ব্যবস্থা স্থগিত করে দেওয়া হয়। পিএফডিএস চ্যানেলের খাদ্য বিতরণ প্রকৃত অর্থে বৃহৎ নিয়োগকর্তার (Large Employer-LE) অধীনে সরকারি খাতের এবং কিছু নির্বাচিত বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রয়। পিএফডিএস চ্যানেলের অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকারের অধীনে যারা খাদ্যশস্য পায় তারা হচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), আনসার ও রী বাহিনীর সদস্যগণ, অর্ডিন্যান্স কারখানার কর্মচারী এবং জেলখানা ও হাসপাতালের কর্মচারী ও বাসিন্দাগণ। বোর্ড, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মচারিবৃন্দ এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের শিকবৃন্দ, এবং এতিমখানা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা পিএফডিএস চ্যানেলের অন্যান্য অগ্রাধিকারের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য পায়। পিএফডিএস চ্যানেলের খয়রাতি সাহায্যের আওতায় দুস্থ জনগণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সাহায্য হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হয়। টেস্ট রিলিফ চ্যানেলের অধীনে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য বর্ষাকালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। উক্ত ৭টি চ্যানেল ছাড়াও আরও কয়েকটি পিএফডিএস চ্যানেল রয়েছে যেগুলি মূলত মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হয়। এ ধরনের একটি চ্যানেলের নাম হচ্ছে আটা মিল। এর অধীনে, তালিকাভুক্ত আটা মিলের কাছে নির্ধারিত মূল্যে মাসিক কোটাভিত্তিতে রুটি কারখানা, বেকারি ও অন্যান্য গ্রাহকের কাছে বিতরণের জন্য গম বিক্রয় করা হয়।


১৯৮৮ সালে চালু করা হয় আটা চাক্কি চ্যানেল। এর আওতায় গ্রামীণ এলাকায় বহুসংখ্যক ছোট ছোট গম ভাঙ্গার প্রতিষ্ঠানের নিকট নির্ধারিত মূল্যে গম বিক্রয় করা হয়। আটা তৈরি করে বাজার মূল্যে বিক্রয়ের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মাসে এক মেট্রিক টন গম পায়। সরবরাহে ঘাটতির কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে মূলত এমআরভুক্ত এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রয় পদ্ধতি চালু করা হয়। একই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার বিক্রয় কার্যক্রম নামে আরেকটি অনিয়মিত চ্যানেল মাঝে মাঝে ব্যবহার করে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অভাবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখা। বিক্রয় কার্যক্রমের আওতায় সরকার ভ্রাম্যমাণ যানবাহনের সাহায্যে সরাসরি খাদ্যশস্য বিক্রয় করে। পান্তরে, খোলা বাজারে বিক্রয়ের আওতায় খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে খাদ্যশস্য বিক্রয় করা হয়।
১৯৮৮ সালে চালু করা হয় আটা চাক্কি চ্যানেল। এর আওতায় গ্রামীণ এলাকায় বহুসংখ্যক ছোট ছোট গম ভাঙ্গার প্রতিষ্ঠানের নিকট নির্ধারিত মূল্যে গম বিক্রয় করা হয়। আটা তৈরি করে বাজার মূল্যে বিক্রয়ের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মাসে এক মেট্রিক টন গম পায়। সরবরাহে ঘাটতির কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে মূলত এমআরভুক্ত এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রয় পদ্ধতি চালু করা হয়। একই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার বিক্রয় কার্যক্রম নামে আরেকটি অনিয়মিত চ্যানেল মাঝে মাঝে ব্যবহার করে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অভাবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখা। বিক্রয় কার্যক্রমের আওতায় সরকার ভ্রাম্যমাণ যানবাহনের সাহায্যে সরাসরি খাদ্যশস্য বিক্রয় করে। পান্তরে, খোলা বাজারে বিক্রয়ের আওতায় খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে খাদ্যশস্য বিক্রয় করা হয়।


বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের সরকারি চ্যানেলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যানেলটি হচ্ছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। ১৯৭৫ সালে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রথম চালু হওয়ার পর এই কর্মসূচি দারিদ্র বিমোচনের একটি নিয়মিত পদপে হিসেবে ব্যবহƒত হয়ে আসছে।
বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের সরকারি চ্যানেলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যানেলটি হচ্ছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। ১৯৭৫ সালে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রথম চালু হওয়ার পর এই কর্মসূচি দারিদ্র বিমোচনের একটি নিয়মিত পদপে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।


প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য শ্রমের বিনিময়ে ত্রাণ হিসেবে গম দেওয়া হতো। এ ধরনের কাজের মধ্যে রয়েছে রাস্তা সংস্কার বা তৈরি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ুদ্র বাঁধ নির্মাণ, পুকুর ও খাল খনন, নদীর লবণাক্ততা দূরীকরণ, বৃ রোপণ, মৎস্য পুকুর ও জলা পুনঃখনন, বন্যা আশ্রয়ের জন্য উঁচুস্থান নির্মাণসহ এ ধরনের আরও অনেক কাজ। পরবর্তী সময়ে এই কর্মসূচি গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচি (জগচ), স্থানীয় উদ্যোগ প্রকল্প (খওঝ) এবং বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির (চগজ) আওতায় শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে খাদ্য সরবরাহ শুরু করে। খাদ্য সহায়তাপ্রাপ্ত উন্নয়ন সংস্থাগুলিকে শক্তিশালীকরণের টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী সম্প্রতি উন্নয়নের বাহন হিসেবে খাদ্যের আরও সুষম ব্যবহারের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি পুনর্গঠন করা হয়। ঠঁষহবৎধনষব এৎড়ঁঢ় উবাবষড়ঢ়সবহঃ নামে একটি কর্মসূচির আওতায় সম্পূর্ণ ত্রাণ হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে এই কর্মসূচির নতুন নামকরণ করা হয়েছে ঠএউ কর্মসূচি। এই কর্মসূচির অধীনে দুস্থ, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা এবং অপুষ্ট শিশুদেরকে মাসিক পরিবার প্রতি ৩১.২৫ কেজি গম প্রদান করা হয়। পিএফডিএস-এর একটি বিশেষ চ্যানেল হচ্ছে শিার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। গরিব জনগণকে খাদ্যশস্যের বিনিময়ে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালে এই কর্মসূচি চালু করা হয়।
প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য শ্রমের বিনিময়ে ত্রাণ হিসেবে গম দেওয়া হতো। এ ধরনের কাজের মধ্যে রয়েছে রাস্তা সংস্কার বা তৈরি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্ষুদ্র বাঁধ নির্মাণ, পুকুর ও খাল খনন, নদীর লবণাক্ততা দূরীকরণ, বৃক্ষরোপণ, মৎস্য পুকুর ও জলা পুনঃখনন, বন্যা আশ্রয়ের জন্য উঁচুস্থান নির্মাণসহ এ ধরনের আরও অনেক কাজ। পরবর্তী সময়ে এই কর্মসূচি গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচি (RMP), স্থানীয় উদ্যোগ প্রকল্প (LIS) এবং বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির (PMR) আওতায় শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে খাদ্য সরবরাহ শুরু করে। খাদ্য সহায়তাপ্রাপ্ত উন্নয়ন সংস্থাগুলিকে শক্তিশালীকরণের টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী সম্প্রতি উন্নয়নের বাহন হিসেবে খাদ্যের আরও সুষম ব্যবহারের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি পুনর্গঠন করা হয়। Vulnerable Group Development নামে একটি কর্মসূচির আওতায় সম্পূর্ণ ত্রাণ হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে এই কর্মসূচির নতুন নামকরণ করা হয়েছে VGD কর্মসূচি। এই কর্মসূচির অধীনে দুস্থ, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা এবং অপুষ্ট শিশুদেরকে মাসিক পরিবার প্রতি ৩১.২৫ কেজি গম প্রদান করা হয়। পিএফডিএস-এর একটি বিশেষ চ্যানেল হচ্ছে শিার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। গরিব জনগণকে খাদ্যশস্যের বিনিময়ে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালে এই কর্মসূচি চালু করা হয়।


১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ একটি বিরাট পরিমাণ খাদ্য সাহায্য পেয়ে আসছে এবং এই খাদ্য-সাহায্য প্রাপ্তি সরকারের খাদ্য নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খাদ্য-সাহায্য ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবে খাদ্য ঘাটতি পূরণে ও নিরাপত্তা মজুত গড়ে তোলায় সহায়তা করছে এবং মূল্য শোধভিত্তিক পিএফডিএস চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এ তহবিল জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে অবদান রাখছে।  
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ একটি বিরাট পরিমাণ খাদ্য সাহায্য পেয়ে আসছে এবং এই খাদ্য-সাহায্য প্রাপ্তি সরকারের খাদ্য নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খাদ্য-সাহায্য ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবে খাদ্য ঘাটতি পূরণে ও নিরাপত্তা মজুত গড়ে তোলায় সহায়তা করছে এবং মূল্য শোধভিত্তিক পিএফডিএস চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এ তহবিল জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে অবদান রাখছে।  
৬২ নং লাইন: ৮১ নং লাইন:
১৯৭২-১৯৯৭ সময়কালে প্রাপ্ত খাদ্য-সাহায্যের পরিমাণ ছিল ২৬.৯ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে ২.২৬ মিলিয়ন টন চাল এবং বাকি অংশ গম। খাদ্য-সাহায্যের শর্তানুসারে, সরকার পিএফডিএস-এর কতিপয় সংস্কার সাধন করে। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে:
১৯৭২-১৯৯৭ সময়কালে প্রাপ্ত খাদ্য-সাহায্যের পরিমাণ ছিল ২৬.৯ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে ২.২৬ মিলিয়ন টন চাল এবং বাকি অংশ গম। খাদ্য-সাহায্যের শর্তানুসারে, সরকার পিএফডিএস-এর কতিপয় সংস্কার সাধন করে। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে:


কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ল্েয কৃষকদের উৎসাহ ও মূল্য-সহায়তা দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ জোরদারকরণ;
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে কৃষকদের উৎসাহ ও মূল্য-সহায়তা দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ জোরদারকরণ;


প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বাফার স্টক গড়ে তোলা;
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বাফার স্টক গড়ে তোলা;
৭২ নং লাইন: ৯১ নং লাইন:
ওএমএস-এর মাধ্যমে খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা।
ওএমএস-এর মাধ্যমে খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা।


অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য-সাহায্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক আমদানি (যদিও উল্লেখযোগ্য নয়, ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে মাত্র ১৩ মিলিয়ন টন) বৃদ্ধির ফলে সরকারকে খাদ্যমজুতের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হয়। ডানিডা, ইসি, আইডিএ, এডিবি, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, কানাডা এবং ইউএনসিডিএফ প্রভৃতি দাতা সারাদেশে খাদ্যগুদাম নির্মাণের জন্য উদারভাবে প্রকল্প সহায়তা প্রদান করে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৮০-৮৫) শেষদিকে মজুত মতা ছিল ১.৮৩৬ মিলিয়ন টন (সাইলো ০.২২৬ মিলিয়ন টন, সিএসডি ০.৪৬৮ মিলিয়ন টন এবং এলএসডি ১.১৪২ মিলিয়ন টন)। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে (১৯৮৫-৯০) তিগ্রস্ত গুদামসমূহের ব্যাপকভিত্তিক মেরামত কাজে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহার করা হয়। বস্তুত, পরবর্তী পর্যায়ে অতিরিক্ত মজুত-সুবিধা গড়ে তোলার আর কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নি। ব্যবসায়ীরা তাদের খাদ্যশস্যের মজুত সংরণের জন্য নিজেদের গুদাম (প্রায়শই শেডের আকারে) ব্যবহার করে, অন্যদিকে চাষিরা স্থানীয়ভাবে তৈরি পাত্র যেমন ডোল, গোলা, ডাবর, মটকা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। কখনও কখনও তারা নিজেদের বাড়িতে মজুদের ছোটখাটো স্থান তৈরি করে নেয়।
অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য-সাহায্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক আমদানি (যদিও উল্লেখযোগ্য নয়, ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে মাত্র ১৩ মিলিয়ন টন) বৃদ্ধির ফলে সরকারকে খাদ্যমজুতের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হয়। ডানিডা, ইসি, আইডিএ, এডিবি, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, কানাডা এবং ইউএনসিডিএফ প্রভৃতি দাতা সারাদেশে খাদ্যগুদাম নির্মাণের জন্য উদারভাবে প্রকল্প সহায়তা প্রদান করে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৮০-৮৫) শেষদিকে মজুত মতা ছিল ১.৮৩৬ মিলিয়ন টন (সাইলো ০.২২৬ মিলিয়ন টন, সিএসডি ০.৪৬৮ মিলিয়ন টন এবং এলএসডি ১.১৪২ মিলিয়ন টন)। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে (১৯৮৫-৯০) ক্ষতিগ্রস্ত গুদামসমূহের ব্যাপকভিত্তিক মেরামত কাজে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহার করা হয়। বস্তুত, পরবর্তী পর্যায়ে অতিরিক্ত মজুত-সুবিধা গড়ে তোলার আর কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নি। ব্যবসায়ীরা তাদের খাদ্যশস্যের মজুত সংরণের জন্য নিজেদের গুদাম (প্রায়শই শেডের আকারে) ব্যবহার করে, অন্যদিকে চাষিরা স্থানীয়ভাবে তৈরি পাত্র যেমন ডোল, গোলা, ডাবর, মটকা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। কখনও কখনও তারা নিজেদের বাড়িতে মজুদের ছোটখাটো স্থান তৈরি করে নেয়।


১৯৯২ সাল পর্যন্ত খাদ্যশস্য আমদানিতে সরকারের একচেটিয়া অধিকার ছিল। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ২.৭৬ মিলিয়ন টন চাল ও গম আমদানি করে। এ সময়ে সরকারি খাতের আমদানির চেয়ে তাদের আমদানির পরিমাণ ১ মিলিয়ন টন বেশি ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে গমের আমদানি শুল্ক ছিল ১৫%, যা পরবর্তীতে ৭.৫%-এ হ্রাস করা হয়।   
১৯৯২ সাল পর্যন্ত খাদ্যশস্য আমদানিতে সরকারের একচেটিয়া অধিকার ছিল। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ২.৭৬ মিলিয়ন টন চাল ও গম আমদানি করে। এ সময়ে সরকারি খাতের আমদানির চেয়ে তাদের আমদানির পরিমাণ ১ মিলিয়ন টন বেশি ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে গমের আমদানি শুল্ক ছিল ১৫%, যা পরবর্তীতে ৭.৫%-এ হ্রাস করা হয়।   


সরকার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় এনজিওদের নিকট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সহায়তা লাভ করে থাকে। এই সহায়তা বিশেষভাবে আসে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ভিজিডি, পল্লী উন্নয়ন, পল্লীর রণাবেণ কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে। কিছু কিছু এনজিও, যেমন ‘কেয়ার’ সরাসরি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। ‘কেয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০-র আওতায় সরবরাহকৃত গমের সাহায্যে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বন ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য গম বিতরণের সঙ্গে অনেক এনজিও-র সংশ্লিষ্টতা বেশ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিভিন্ন দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহিলা মতায়ন, রেশম চাষ, প্রশিণ কেন্দ্র, পুষ্টি কেন্দ্র স্থাপন, ভিজিডি-র আওতায় দলনেতা ও সম্প্রসারণ কর্মী এবং পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি।  
সরকার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় এনজিওদের নিকট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সহায়তা লাভ করে থাকে। এই সহায়তা বিশেষভাবে আসে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ভিজিডি, পল্লী উন্নয়ন, পল্লীর রণাবেণ কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে। কিছু কিছু এনজিও, যেমন ‘কেয়ার’ সরাসরি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। ‘কেয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০-র আওতায় সরবরাহকৃত গমের সাহায্যে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বন ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য গম বিতরণের সঙ্গে অনেক এনজিও-র সংশ্লিষ্টতা বেশ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিভিন্ন দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহিলা ক্ষমতায়ন, রেশম চাষ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পুষ্টি কেন্দ্র স্থাপন, ভিজিডি-র আওতায় দলনেতা ও সম্প্রসারণ কর্মী এবং পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি।  


দেশে খাদ্য ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। ১৯৪২ সালে সৃষ্ট সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর থেকে এটিকে সংগঠিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে এই দপ্তরের নতুন নামকরণ করা হয় খাদ্য ও কৃষি বিভাগ। পাকিস্তান আমলে খাদ্য বিভাগের অফিস ছিল বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে। স্বাধীনতার পর এই বিভাগকে মন্ত্রণালয়ে পুনর্গঠিত করা হয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে একটি খাদ্য অধিদপ্তর রয়েছে এবং সারাদেশে খাদ্য অফিস বিস্তার লাভ করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় সচিবালয়ে ১৭৫ জন এবং অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে প্রায় ১১,৫০০ ব্যক্তি কর্মরত রয়েছে। সরকার শহর এলাকার নির্ধারিত আয়ের মানুষ এবং গ্রামীণ এলাকার প্রান্তিক চাষি ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় তার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এইসব শ্রেণীর লোকদের পারিবারিক খরচের ৬০% ব্যয় হয় খাদ্যবস্তুর জন্য। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।  
দেশে খাদ্য ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। ১৯৪২ সালে সৃষ্ট সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর থেকে এটিকে সংগঠিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে এই দপ্তরের নতুন নামকরণ করা হয় খাদ্য ও কৃষি বিভাগ। পাকিস্তান আমলে খাদ্য বিভাগের অফিস ছিল বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে। স্বাধীনতার পর এই বিভাগকে মন্ত্রণালয়ে পুনর্গঠিত করা হয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে একটি খাদ্য অধিদপ্তর রয়েছে এবং সারাদেশে খাদ্য অফিস বিস্তার লাভ করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় সচিবালয়ে ১৭৫ জন এবং অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে প্রায় ১১,৫০০ ব্যক্তি কর্মরত রয়েছে। সরকার শহর এলাকার নির্ধারিত আয়ের মানুষ এবং গ্রামীণ এলাকার প্রান্তিক চাষি ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় তার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এইসব শ্রেণীর লোকদের পারিবারিক খরচের ৬০% ব্যয় হয় খাদ্যবস্তুর জন্য। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।  

০৫:৪৩, ২৫ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

খাদ্যশস্য বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য ভাত। খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে জৈবিক-প্রাকৃতিক ও আর্থসমাজ কাঠামোর ভিত্তিতে। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রচলিত প্রথা, বিধিনিষেধ, আচার-অনুষ্ঠান, অভ্যাস, ধর্ম এবং আয়-উপার্জনের ওপরও খাদ্যাভ্যাস নির্ভর করে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে ব্যাপক হারে ধানের চাষ প্রচলিত এবং ঢেঁকি, অন্যকোন দেশীয় পদ্ধতিতে ধান ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে চাল প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলার জনগণের জমি বা ব্যবসায় এবং কর্মসংস্থান থেকে আয় যেমন স্বল্প ছিল তেমনি চালের দামও ছিল কম। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে মুগল শাসনামলে মোটা চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ৩০০ কেজি। বাজারে স্বল্পস্থায়ী ওঠানামার মাধ্যমে দীর্ঘকাল এই মূল্য স্থিতিশীল ছিল।

উদ্বৃত্ত চাল, গম ও অন্যান্য কৃষিপণ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে এবং পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপসমূহে রপ্তানি করা হতো। মুর্শিদ কুলী খাঁর শাসনামলে (১৭০৪-১৭২৭) সাধারণ জাতের চালের গড় মূল্য ছিল টাকায় ২০০ কেজি। নবাব নিজে খাদ্যের মূল্য সস্তা রাখার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেন এবং ধনী ব্যক্তিদের খাদ্যশস্য মজুদ করতে দিতেন না। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশের ব্যবসার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা লাভ করে। ১৭৬৫ সালে কোম্পানিকে দেওয়ানির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৭৬৮ সাল থেকে দুর্ভিক্ষ ও অভাব শুরু হয়। চালের দাম টাকায় ১০-১৫ কেজিতে বৃদ্ধির ফলে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত দেশ কখনওই আঞ্চলিকভাবে বা জাতীয়ভাবে অভাব বা দুর্ভিক্ষের কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয় নি। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৮০০-১৮৫৮) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের অধীনে চালের দাম সাধারণভাবে টাকায় ৪০-৫০ কেজিতে স্থিতিশীল থাকে। ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার বাংলাসহ ভারতের বৃহদাংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৮৫৮-১৯০০ সময়ে দুর্ভিক্ষের বছরগুলি ছাড়া সাধারণ মানের চালের দাম ছিল টাকায় ২৫-৩০ কেজি।

১৯০১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য মোটামুটি টাকায় ১০-১২ কেজিতে বিদ্যমান ছিল। তবে ১৯১৪-১৯২৯ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য উল্লিখিত দামের দ্বিগুণ হয়। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময় বাংলায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে টাকায় আধা কেজি বা তারও কমে দাঁড়ায়, তবে কোথাও কোথাও তখন টাকায় ১.৭৫ কেজি চাল পাওয়া যেত। এই দুর্ভিক্ষের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে।

যে ভৌগোলিক এলাকা এখন বাংলাদেশ নামে অভিহিত ব্রিটিশ শাসনামলে তা কখনও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। পার্শ্ববর্তী বার্মা থেকে নিয়মিতভাবে চাল আমদানি করা হতো। গম এবং গমজাত পণ্য আসত বর্তমান ভারতের অধীনস্থ পশ্চিমাঞ্চল থেকে। ১৯৩০-এর দশকে অবিভক্ত বাংলার চাল ও গমের চাহিদার পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৭.৫ মিলিয়ন টন। এই চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এর অর্ধেক ছিল চাল আর অর্ধেক গম। ১৯৪১ সালে বার্মায় জাপানি সেনাবাহিনী প্রবেশের ফলে বাংলায় খাদ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং সেদেশ থেকে চাল সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সরকার কর্তৃক গৃহীত বর্জন নীতির (এক ধরনের পোড়ামাটি নীতি) আওতায় নৌকা ও অন্যান্য সব ধরনের পরিবহণ যানবাহন ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং শত্রুদের নাগালের বাইরে রাখার জন্য সকল খাদ্যমজুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে নজিরবিহীন আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং চালের মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১৯৪২ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর (Civil Supplies Department) স্থাপন করে সরকার দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।

১৯৪৩-এর মন্বন্তরের প্রোপটে সরকার বেঙ্গল রেশনিং অর্ডার ১৯৪৩ জারির মাধ্যমে কিছু ঘোষিত এলাকায় জনগণের মধ্যে নির্ধারিত কোটাভিত্তিতে খাদ্যশস্য সরবরাহের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই আদেশবলে সরকার কয়েকটি ভোগ্যপণ্যকে রেশনদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করে। এসব পণ্য কিছু নির্বাচিত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রেশন কার্ড উপস্থাপন সাপেে পাইকারি ও খুচরা ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে সংবিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি (Statutory Rationing System) বা বহুল পরিচিত এসআর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সামরিক বাহিনীর সদস্য, বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দলসমূহ, স্থাপনা মালিক, শ্রমিক, কর্মচারী, স্থানীয় সরকার কর্তৃপ এবং দোকান, কেন্টিন গুদামের ব্যবস্থাপক বা ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। বিশেষায়িত রেশন দোকান খোলা হয় এবং ঘোষিত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য রেশন কার্ড ইস্যু করা হয়।

১৯৪৬ সালে চাল ও গম সংগ্রহ নীতিকে সরকারের একচেটিয়া অধিকারে পরিণত করা হয়। বাধ্যতামূলক সংগ্রহের অধীনে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ (সাময়িক ক্ষমতা) অধ্যাদেশ ১৯৪৬-এর অধীনে অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হয়। এর ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ ও ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে সংরতি থাকে। কিন্তু বাংলায় অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহের পরিমাণ স্বল্পই থেকে যায়। ১৯৪৫-৪৬ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শস্য আমদানি করেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও চাহিদার ভারসাম্য রা করা সম্ভব হয় নি। সংবিধিবদ্ধ রেশনের আওতায় খাদ্যশস্যের কোটা দৈনিক ১ পাউন্ড থেকে হ্রাস করে ১২ আউন্স এবং ১৯৪৬ সালে তারও কম করা হয়।

১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিধিবদ্ধ রেশনিং পদ্ধতি শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা শহরে চালু থাকে। ১৯৪৯ সালে আরও ১১টি শহরে (চাঁদপুর, রাজবাড়ী, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও টাঙ্গাইল) এসআর চালু করা হয়। চাল, আটা, ভুশি, সুজি, রুটি (সাদা, বাদামি ও আস্ত গমের) এবং চিনিকে রেশন দ্রব্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এসআর-ভুক্ত এলাকায় সাপ্তাহিক কোটা-ভিত্তিতে চাল ও গম/আটার সরবরাহ মোটামুটি নিয়মিত ছিল। সংশোধিত রেশনিং আদেশ ১৯৪৯ (Modified Rationing Order)-এর আওতায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রামীণ এলাকায় সীমিত পরিমাণে রেশনিং পদ্ধতি চালু করা হয়। আয় অনুসারে গ্রামীণ জনগণকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, ইউনিয়ন এবং শহর খাদ্য ও রিলিফ কমিটির মাধ্যমে একটি বিতরণ অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা হয়। সংশোধিত রেশনিং পদ্ধতির আওতায় প্রাপ্যতা সাপেে পনেরো দিনে বা মাসে একবার খাদ্যশস্য বিতরণ করা হতো। সরকারের প্রধান প্রয়াস ছিল অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, বাণিজ্যিক আমদানি এবং খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত শস্যকে কয়েকটি চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করে সারাবছর সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতিকে ((Public Food Distribution System-PFDS) সচল রাখা। পিএফডিএস-এর অধীনে চ্যানেল ছিল সাতটি। এগুলির মধ্যে ৫টি ছিল অর্থ-সংশ্লিষ্ট তথা (সংবিধিবদ্ধ রেশনিং, সংশোধিত রেশনিং, অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকার, অন্যান্য অগ্রাধিকার এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানাদির কর্মচারী) এবং ২টি বিনা অর্থে অর্থাৎ খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ। অর্থের বিনিময়ে বিতরণকৃত খাদ্যশস্য বেশ খানিকটা ভর্তুকির বিনিময়ে দেওয়া হয় এবং মোট সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতির ৯৮ শতাংশেরও বেশি এই চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। সরকার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের দুঃখকষ্ট লাঘবের জন্য স্থানীয়ভাবে খয়রাতি সাহায্য ও টেস্ট রিলিফ দিয়ে থাকে। পিএফডিএস-এর অধীনে চাল ও গম উভয়ই বিতরণ করা হয়। মাঝে মাঝে চিনি, ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য পণ্যও প্রদান করা হয়। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পিএফডিএস-এর আওতায় বাৎসরিক গড় খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পরিমাণ ছিল ২.৫ মিলিয়ন টন। খাদ্য-সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত গমের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিএফডিএস-এর অধীনে বিতরণের পরিমাণও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এর ফলে লোকজনও গমকে নিয়মিত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে।

সরকার ১৯৫৫ সালে সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং সরকারি গুদামে জমাকৃত সব খাদ্যশস্য বিক্রয় করে দেয়। অধিদপ্তরের সকল কর্মচারী ছাঁটাই করে তাদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু শীঘ্রই চালের দাম বাড়তে থাকে এবং খাদ্যাভাব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে এবং সারাদেশে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। এর ফলে ১৯৫৬ সালে সরকার সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তরের পুনরুজ্জীবন এবং ১৯টি বড় ও ছোট শহরে এসআর-এর আওতায় পুনরায় খাদ্যশস্য বিতরণ শুরু করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৯ সালে গ্রামীণ এলাকায় প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণের লক্ষে এসআর পুনরুজ্জীবিত করা হয়। অবশ্য, ১৯৬০ সালে ১৬টি ছোট শহর থেকে এসআর বিলুপ্ত করা হয় যদিও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তা অব্যাহত থাকে। সারণি ১ থেকে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে কখনই খাদ্য উৎপাদন আশানুরূপ ছিল না।

সারণি ১ পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।

সময় চাল গম ডাল তেলবীজ বার্লি ভুট্টা মোট
১৯৪৮-৫২ ৭২৩২ ২১ ২৬৬ ১৩৮ ১৬ ৭৬৭৫
১৯৫৩-৫৭ ৭৫৪৫ ২৪ ২৮১ ২০২ ১৭ ৮০৭১
১৯৫৮-৬২ ৮৩৯৬ ২৯ ২২০ ১৮৩ ১৪ ৮৮৪৬
১৯৬৩-৬৭ ৯৮৬০ ৩৯ ২০৫ ২১৭ ১৪ ১০৩৩৮
১৯৬৮-৭২ ১০৯৩৫ ৯৫ ২৭৮ ৩১৩ ২০ ১১৬৪৪

জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং মোট উৎপাদন থেকে বীজ ও বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে নীট উৎপাদন হিসেবে করলে দেখা যায় ১৯৫৬-১৯৫৯ সময়ে বাৎসরিক খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬.৮৪ মিলিয়ন টন। তবে ১৯৬৮-১৯৭১ সালে এই ঘাটতি হ্রাস পেয়ে ৩.০২ মিলিয়ন টনে দাঁড়ায়। অব্যাহত খাদ্য ঘাটতির ফলে পিএফডিএস-এর অধীনে অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য বিতরণের এবং সংরণের জন্য নতুন গুদাম নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫০-এর দশকে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়-কেন্দ্র ও শিল্প এলাকায় কেন্দ্রীয় মজুত ভাণ্ডার (Central Storage Depot-CSDs) এবং থানা ও বাজারে স্থানীয় সরবরাহ ভাণ্ডার (Local Supply Depot-LSDs) স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয়। এর পরে ১৯৭১ সালে বিশ্ব ব্যাংক ও সুইডিশ ঋণের আওতায় চট্টগ্রাম, আশুগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও সান্তাহারে ৪টি সাইলো নির্মাণ করা হয়। এগুলি লাহোর শেড, কলকাতা শেড, টিন শেড, জুট শেড, এবং আসাম টাইপ ইত্যাদি নামে পরিচিত পুরানো গুদামের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। মজুত ক্ষমতা ১৯৪৭ সালের ০.১৬৭ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭১ সালে ০.৯১৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছে। পিএফডিএস পরিচালনার ফলে চাল ও গমের মূল্য সহনীয় হারে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ১৯৫০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে চালের মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৮ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র ১.০৮ টাকা এবং গমের/আটার মূল্য প্রতি কেজি ০.৪৯ টাকা থেকে ০.৭৭ টাকায় উন্নীত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ কালীন বাংলাদেশের মানুষ ও সম্পদ উভয়ের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ সময় চাষিরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে নি। ফলে শস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। যুদ্ধের পর প্রত্যাবাসিত জনগণের (১০ মিলিয়নেরও বেশি) জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ পরিচালনা সংস্থার সমন্বয়ের অধীনে কানাডা, ভারত, ইউএনআরওবি, ইউনিসেফ, আইভিএ ১৯৭২ সালে ৭৭,০০০ মেট্রিক টন চাল ও ০.৮৪৭ মিলিয়ন টন গম সরবরাহ করে। বাংলাদেশ সরকার দাতাগোষ্ঠীর বিবেচনার জন্য বাৎসরিক খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি তাদের নিকট উপস্থাপনের একটি প্রথা চালু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে খাদ্য-সাহায্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এবং দেশের প্রশাসনিক, আর্থিক, ব্যাংকিং ও পরিকল্পনা কৌশলে একে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শেষে এসে সরকারের খাদ্যনীতির দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল এবং পরিচালনা পদ্ধতি/ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অধিক খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য অধিকার এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এই খাতের সকল নীতির ল্য হয়ে ওঠে। আশির দশকের শেষে প্রণীত খাদ্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল সকলের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং একটি নির্ভরযোগ্য জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই নীতির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ হচ্ছে মূল্য সহায়তা প্রদান, সরকারি খাদ্য বিতরণে ভর্তুকি হ্রাস, আরও বেশিসংখ্যক গরিব জনগোষ্ঠীকে পিএফডিএস-এর আওতায় আনার জন্য এর পরিধি বিস্তার, খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণে ব্যক্তিগত খাতের ভূমিকা বৃদ্ধি এবং খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়। কৃষক কর্তৃক অধিকহারে সার, সেচ সুবিধা ও উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার এবং উৎসাহ-মূল্যে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক সক্রিয় সহায়তা প্রদানের ফলে চাল ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। সারণি-২-এ বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের একটি চিত্র তুলে ধরা হলো।

সারণি ২ বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন (বার্ষিক গড়, ’০০০ মে টন)।

সময় চাল গম ডাল তেলবীজ বার্লি ভুট্টা মোট
১৯৭৩-৭৭ ১১৩৭৭ ১৫৭ ২২৪ ২২৭ ১৬ ১২০০৩
১৯৭৮-৮২ ১৩০৬৭ ৭৩৯ ২১৯ ২৫৪ ১২ ১৪২৯২
১৯৮৩-৮৭ ১৪৭৫৮ ১১৮১ ৪৬৭ ৪২২ ১৩ ১৬৮৪৪
১৯৮৮-৯২ ১৬৯৮৩ ১০০৬ ৫১৬ ৪৪২ ১১ ১৮৯৬১
১৯৯৩-৯৭ ১৭৯৮২ ১২৭৫ ৫২৬ ৪৬৪ ২০২৫৬


সারণিতে লক্ষণীয় যে, দানাদার শস্যের উৎপাদন ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সাইকোন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল হানির ফলে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বিপুল থেকে যায়।

বাৎসরিক ঘাটতি (জনপ্রতি প্রতিদিন ১৫.৫ আউন্স হিসেবে মোট জনসংখ্যার চাহিদা ও নেট উৎপাদন অর্থাৎ মোট উৎপাদন থেকে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য, বীজ ও বিনষ্ট বাবদ ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে পার্থক্য) ১৯৭৩-১৯৭৭ সময়ে ছিল ২.১৪ মিলিয়ন টন। ১৯৯৩-১৯৯৭ সময়ে এই ঘাটতি ১.৪৬ মিলিয়ন টনে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রতিবছর একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল ও গম বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হয়ে যায়। কাস্তে দিয়ে কাটার সময়, মাঠ থেকে শুকানোর স্থানে পরিবহণের প্রাক্কালে, সিদ্ধ করা এবং ছাঁটাইয়ের সময় অনেক শস্য অপচয় হয়ে থাকে। অনুপযোগী প্যাকিং, অপর্যাপ্ত শুকানো, অতিমাত্রায় আর্দ্রতা, চুরি এবং পোকামাকড়, ইঁদুর ও পাখির আক্রমণের কারণেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়। এছাড়া, একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহণের পর্যায়েও একটি অংশ অপচয় হয়।

বন্দরে জাহাজ থেকে খালাসের সময় অযত্ন ও অবহেলার কারণে ক্ষতি হয় জাহাজ প্রতি কয়েক শত টন পর্যন্ত। এর ফলে অনেক সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় এবং তা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলে। বস্তায় ভর্তি ও পুনঃভর্তির সময় এবং সরকারি খাতে গুদাম থেকে খাদ্যশস্য বরাদ্দ বা পুনঃবরাদ্দের সময়ও কিছু শস্য বিনষ্ট হয়। সরকারি খাতে সারাবছর নৌকা, বার্জ, রেলওয়ে ওয়াগন, ট্রাক এবং অন্যান্য পরিবহণের মাধ্যমে খাদ্যশস্য দেশের অভ্যন্তরে এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে পরিবহণ করা হয়ে থাকে। এ কারণে সরকার নির্ধারিত হারে পরিবহণজনিত ক্ষতি অনুমোদন করে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ১৯৯১ সালের একটি সমীা অনুযায়ী, বিভিন্ন কারণে খাদ্যশস্যের মোট অপচয়ের পরিমাণ ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ১১.৫৮%, তবে, মন্ত্রণালয় ১০% ক্ষতি বাদ দিয়ে খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা হিসেব করে থাকে।

সরকার প্রধানত খাদ্য-সাহায্য কর্মসূচির অধীনে ও নগদ মূল্যে আমদানি এবং আংশিকভাবে দেশের কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের উদ্বৃত্ত অংশ ক্রয়ের মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে থাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাৎসরিক গড় সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ০.৪ মিলিয়ন টন, ১৯৮১-৯০ সময়কালে এই পরিমাণ ছিল ০.৪৪ মিলিয়ন টন এবং ১৯৯১-৯৭ সময়ে সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়ায় ০.৫০ মিলিয়ন টনে। সংগ্রহের ইতিহাসে মাত্র দুই বার (১৯৮১ ও ১৯৯২) এই অঙ্ক ১ মিলিয়ন টন অতিক্রম করেছিল। চাল ও গম সংগ্রহের যে মূল্য ধার্য করা হয়, সর্বদাই তা বাজার মূল্যের চেয়ে কম থাকে এবং তা বেশির ভাগ চাষিকেই সহায়ক-মূল্য দিতে পারে না। ১৯৮৩ সাল থেকে স্বয়ংক্রিয় চাল কলগুলিকে সরকারি খাতে ধান ক্রয় ও তা থেকে প্রাপ্ত চাল সরকারি গুদামে সরবরাহের অনুমতি দেওয়া হয়।

সরকারি খাদ্যবিতরণ পদ্ধতি চালুর উদ্দেশ্য ছিল জনগণের বিভিন্ন অংশকে মূল্য সহায়তা ও আয়-প্রতিরা প্রদান, মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, পুষ্টি সহায়তা প্রদান এবং দুর্যোগে ত্রাণ প্রদান। দেশে খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পিএফডিএস সরকারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়। অর্থ-সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলির মধ্যে সংবিধিবদ্ধ রেশনিং ব্যবস্থা ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ৪টি মহানগরে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে রাজশাহী শহরে এবং ১৯৭৬ সালে রাঙ্গামাটি শহরে তা বর্ধিত করা হয়।

১৯৭৪ সালে নতুন রেশনকার্ড বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্ডগুলি প্রতি পরিবারে সর্বোচ্চ ৬ সদস্যের জন্য সীমিত ছিল এবং সাপ্তাহিক কোটার পরিমাণ ১৯৭৩ সালের জনপ্রতি ৩ সের (প্রায় ২.৮ কেজি) থেকে কমিয়ে ১৯৮৬ সালে ১.৫ কেজি করা হয়। এসআর-এর আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণের পরিমাণ ১৯৭৬-৮১ সময়কালে ২০ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করে এবং ১৯৮২ সাল (১৫%) থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৩ সালে ৫% শতাংশে দাঁড়ায়।

গ্রামীণ জনগণের জন্য সংশোধিত রেশনিং (এমআর) বরাবর অনিয়মিতই থেকে যায় এবং ১৯৮৯ সালে সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে এর পরিবর্তে পল্লী রেশনিং নামে একটি নতুন পদ্ধতির রেশনিং ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯২ সালে আরআর ব্যবস্থা স্থগিত করে দেওয়া হয়। পিএফডিএস চ্যানেলের খাদ্য বিতরণ প্রকৃত অর্থে বৃহৎ নিয়োগকর্তার (Large Employer-LE) অধীনে সরকারি খাতের এবং কিছু নির্বাচিত বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রয়। পিএফডিএস চ্যানেলের অত্যাবশ্যক অগ্রাধিকারের অধীনে যারা খাদ্যশস্য পায় তারা হচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর), আনসার ও রী বাহিনীর সদস্যগণ, অর্ডিন্যান্স কারখানার কর্মচারী এবং জেলখানা ও হাসপাতালের কর্মচারী ও বাসিন্দাগণ। বোর্ড, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মচারিবৃন্দ এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের শিকবৃন্দ, এবং এতিমখানা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা পিএফডিএস চ্যানেলের অন্যান্য অগ্রাধিকারের আওতায় ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য পায়। পিএফডিএস চ্যানেলের খয়রাতি সাহায্যের আওতায় দুস্থ জনগণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সাহায্য হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হয়। টেস্ট রিলিফ চ্যানেলের অধীনে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট মেরামত বা পুনর্নির্মাণের জন্য বর্ষাকালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য দেওয়া হয়। উক্ত ৭টি চ্যানেল ছাড়াও আরও কয়েকটি পিএফডিএস চ্যানেল রয়েছে যেগুলি মূলত মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হয়। এ ধরনের একটি চ্যানেলের নাম হচ্ছে আটা মিল। এর অধীনে, তালিকাভুক্ত আটা মিলের কাছে নির্ধারিত মূল্যে মাসিক কোটাভিত্তিতে রুটি কারখানা, বেকারি ও অন্যান্য গ্রাহকের কাছে বিতরণের জন্য গম বিক্রয় করা হয়।

১৯৮৮ সালে চালু করা হয় আটা চাক্কি চ্যানেল। এর আওতায় গ্রামীণ এলাকায় বহুসংখ্যক ছোট ছোট গম ভাঙ্গার প্রতিষ্ঠানের নিকট নির্ধারিত মূল্যে গম বিক্রয় করা হয়। আটা তৈরি করে বাজার মূল্যে বিক্রয়ের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মাসে এক মেট্রিক টন গম পায়। সরবরাহে ঘাটতির কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে মূলত এমআরভুক্ত এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রয় পদ্ধতি চালু করা হয়। একই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার বিক্রয় কার্যক্রম নামে আরেকটি অনিয়মিত চ্যানেল মাঝে মাঝে ব্যবহার করে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অভাবী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণের মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকিয়ে রাখা। বিক্রয় কার্যক্রমের আওতায় সরকার ভ্রাম্যমাণ যানবাহনের সাহায্যে সরাসরি খাদ্যশস্য বিক্রয় করে। পান্তরে, খোলা বাজারে বিক্রয়ের আওতায় খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে খাদ্যশস্য বিক্রয় করা হয়।

বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের সরকারি চ্যানেলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চ্যানেলটি হচ্ছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। ১৯৭৫ সালে খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় প্রথম চালু হওয়ার পর এই কর্মসূচি দারিদ্র বিমোচনের একটি নিয়মিত পদপে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য শ্রমের বিনিময়ে ত্রাণ হিসেবে গম দেওয়া হতো। এ ধরনের কাজের মধ্যে রয়েছে রাস্তা সংস্কার বা তৈরি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্ষুদ্র বাঁধ নির্মাণ, পুকুর ও খাল খনন, নদীর লবণাক্ততা দূরীকরণ, বৃক্ষরোপণ, মৎস্য পুকুর ও জলা পুনঃখনন, বন্যা আশ্রয়ের জন্য উঁচুস্থান নির্মাণসহ এ ধরনের আরও অনেক কাজ। পরবর্তী সময়ে এই কর্মসূচি গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচি (RMP), স্থানীয় উদ্যোগ প্রকল্প (LIS) এবং বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচির (PMR) আওতায় শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে খাদ্য সরবরাহ শুরু করে। খাদ্য সহায়তাপ্রাপ্ত উন্নয়ন সংস্থাগুলিকে শক্তিশালীকরণের টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুযায়ী সম্প্রতি উন্নয়নের বাহন হিসেবে খাদ্যের আরও সুষম ব্যবহারের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি পুনর্গঠন করা হয়। Vulnerable Group Development নামে একটি কর্মসূচির আওতায় সম্পূর্ণ ত্রাণ হিসেবে খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে এই কর্মসূচির নতুন নামকরণ করা হয়েছে VGD কর্মসূচি। এই কর্মসূচির অধীনে দুস্থ, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা এবং অপুষ্ট শিশুদেরকে মাসিক পরিবার প্রতি ৩১.২৫ কেজি গম প্রদান করা হয়। পিএফডিএস-এর একটি বিশেষ চ্যানেল হচ্ছে শিার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি। গরিব জনগণকে খাদ্যশস্যের বিনিময়ে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৪ সালে এই কর্মসূচি চালু করা হয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ একটি বিরাট পরিমাণ খাদ্য সাহায্য পেয়ে আসছে এবং এই খাদ্য-সাহায্য প্রাপ্তি সরকারের খাদ্য নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খাদ্য-সাহায্য ব্যবস্থাটি কার্যকরভাবে খাদ্য ঘাটতি পূরণে ও নিরাপত্তা মজুত গড়ে তোলায় সহায়তা করছে এবং মূল্য শোধভিত্তিক পিএফডিএস চ্যানেলের মাধ্যমে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তহবিল গঠন করা হচ্ছে। এ তহবিল জাতীয় উন্নয়ন বাজেটে অবদান রাখছে।

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান খাদ্য সহায়তাদানকারী দাতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (প্রধানত পিএল ৪৮০-এর অধীনে), যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় কমিশন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি।

১৯৭২-১৯৯৭ সময়কালে প্রাপ্ত খাদ্য-সাহায্যের পরিমাণ ছিল ২৬.৯ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে ২.২৬ মিলিয়ন টন চাল এবং বাকি অংশ গম। খাদ্য-সাহায্যের শর্তানুসারে, সরকার পিএফডিএস-এর কতিপয় সংস্কার সাধন করে। এসব সংস্কারের মধ্যে রয়েছে:

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে কৃষকদের উৎসাহ ও মূল্য-সহায়তা দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ জোরদারকরণ;

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বাফার স্টক গড়ে তোলা;

ভিজিডি, এফএফডব্লিউ এবং এফএফই কর্মসূচির অধীনে গ্রামীণ ল্যদলের অনুকূলে নগরকেন্দ্রিক রেশনিং চ্যানেল হ্রাস;

বেসরকারি খাতকে খাদ্যশস্য আমদানির অনুমতি দান; এবং

ওএমএস-এর মাধ্যমে খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য-সাহায্য সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক আমদানি (যদিও উল্লেখযোগ্য নয়, ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে মাত্র ১৩ মিলিয়ন টন) বৃদ্ধির ফলে সরকারকে খাদ্যমজুতের সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হয়। ডানিডা, ইসি, আইডিএ, এডিবি, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, কানাডা এবং ইউএনসিডিএফ প্রভৃতি দাতা সারাদেশে খাদ্যগুদাম নির্মাণের জন্য উদারভাবে প্রকল্প সহায়তা প্রদান করে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (১৯৮০-৮৫) শেষদিকে মজুত মতা ছিল ১.৮৩৬ মিলিয়ন টন (সাইলো ০.২২৬ মিলিয়ন টন, সিএসডি ০.৪৬৮ মিলিয়ন টন এবং এলএসডি ১.১৪২ মিলিয়ন টন)। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কালে (১৯৮৫-৯০) ক্ষতিগ্রস্ত গুদামসমূহের ব্যাপকভিত্তিক মেরামত কাজে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহার করা হয়। বস্তুত, পরবর্তী পর্যায়ে অতিরিক্ত মজুত-সুবিধা গড়ে তোলার আর কোন প্রয়োজন দেখা দেয় নি। ব্যবসায়ীরা তাদের খাদ্যশস্যের মজুত সংরণের জন্য নিজেদের গুদাম (প্রায়শই শেডের আকারে) ব্যবহার করে, অন্যদিকে চাষিরা স্থানীয়ভাবে তৈরি পাত্র যেমন ডোল, গোলা, ডাবর, মটকা প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। কখনও কখনও তারা নিজেদের বাড়িতে মজুদের ছোটখাটো স্থান তৈরি করে নেয়।

১৯৯২ সাল পর্যন্ত খাদ্যশস্য আমদানিতে সরকারের একচেটিয়া অধিকার ছিল। ১৯৯৩ এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ২.৭৬ মিলিয়ন টন চাল ও গম আমদানি করে। এ সময়ে সরকারি খাতের আমদানির চেয়ে তাদের আমদানির পরিমাণ ১ মিলিয়ন টন বেশি ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে গমের আমদানি শুল্ক ছিল ১৫%, যা পরবর্তীতে ৭.৫%-এ হ্রাস করা হয়।

সরকার খাদ্য ব্যবস্থাপনায় এনজিওদের নিকট থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সহায়তা লাভ করে থাকে। এই সহায়তা বিশেষভাবে আসে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, ভিজিডি, পল্লী উন্নয়ন, পল্লীর রণাবেণ কর্মসূচি ইত্যাদির মাধ্যমে। কিছু কিছু এনজিও, যেমন ‘কেয়ার’ সরাসরি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত। ‘কেয়ার’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০-র আওতায় সরবরাহকৃত গমের সাহায্যে দীর্ঘকাল যাবৎ গ্রামীণ রণাবেণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। বন ও মৎস্য উন্নয়নের জন্য গম বিতরণের সঙ্গে অনেক এনজিও-র সংশ্লিষ্টতা বেশ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিভিন্ন দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহিলা ক্ষমতায়ন, রেশম চাষ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পুষ্টি কেন্দ্র স্থাপন, ভিজিডি-র আওতায় দলনেতা ও সম্প্রসারণ কর্মী এবং পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি।

দেশে খাদ্য ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। ১৯৪২ সালে সৃষ্ট সরকারি সরবরাহ অধিদপ্তর থেকে এটিকে সংগঠিত করা হয়। ১৯৫৬ সালে এই দপ্তরের নতুন নামকরণ করা হয় খাদ্য ও কৃষি বিভাগ। পাকিস্তান আমলে খাদ্য বিভাগের অফিস ছিল বিভাগ, জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে। স্বাধীনতার পর এই বিভাগকে মন্ত্রণালয়ে পুনর্গঠিত করা হয়। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে একটি খাদ্য অধিদপ্তর রয়েছে এবং সারাদেশে খাদ্য অফিস বিস্তার লাভ করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় সচিবালয়ে ১৭৫ জন এবং অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে প্রায় ১১,৫০০ ব্যক্তি কর্মরত রয়েছে। সরকার শহর এলাকার নির্ধারিত আয়ের মানুষ এবং গ্রামীণ এলাকার প্রান্তিক চাষি ও ভূমিহীন শ্রমিকদের মধ্যে নিয়মিত খাদ্যশস্য সরবরাহ অব্যাহত রাখতে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় তার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এইসব শ্রেণীর লোকদের পারিবারিক খরচের ৬০% ব্যয় হয় খাদ্যবস্তুর জন্য। দেশে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

সরকার অবশ্য পর্যায়ক্রমে খাদ্যশস্যের সরবরাহ ও মূল্যের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। যদিও, সামাজিক, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক জটিলতার আশঙ্কায় সম্পূর্ণ প্রত্যাহার যথাযথ হবে কি না সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরূহ। [এ.ডব্লিউ নুরুদ্দীন আহমেদ]