সড়ক পরিবহণ: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২ নং লাইন: | ২ নং লাইন: | ||
'''সড়ক পরিবহণ''' অতীতে বাংলাদেশের বিশাল অংশ জুড়ে নৌপরিবহণ ব্যবস্থার প্রাধান্য থাকার কারণে এখানে সড়ক পরিবহণ খাতে শ্লথগতিতে উন্নয়ন ঘটে। কারণ নদীমাতৃক দেশটিতে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গীয় বদ্বীপ জুড়ে বড় বড় নদনদী ও এগুলির ছোটবড় অসংখ্য শাখানদী, খালবিল এবং নিচু জলাভূমি থাকায় পরিবহণ ব্যবস্থার বিবর্তনে নৌযানের আধিক্য ক্ষুন্ন হয় নি। এই অঞ্চলের ভূমি এতটাই সমতল ও নিচু যে সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে কয়েক মিটার উচ্চতাসম্পন্ন জায়গা রয়েছে খুব সামান্যই। বর্ষাকালে এই ভূখন্ড এক সুবিশাল জলরাশিতে প্লাবিত হয়, চারদিকে বিবিধ আকার ও আকৃতির নৌকাই শুধু বাহন হিসেবে দেখা যায়। কয়েক দশক আগেও এদেশের অনেক এলাকায় নৌকাই ছিল একমাত্র পরিবহণ। এ অঞ্চলে জলাভূমি ও নদী অতিক্রম করতে অসংখ্য সেতু ও কালভার্টসহ উচু বাঁধের উপর সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী সড়ক এবং রেলপথ তৈরির প্রয়োজন হয়। বাংলা অববাহিকায় অতি প্রাচীন সড়ক-কাম-বাঁধসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সড়ক হচ্ছে ঢাকা থেকে সংগ্রামগড় (নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বলে গণ্য করা হয়) পর্যন্ত উচু বাঁধের উপর নির্মিত রাস্তা। বাদশাহ আওরঙ্গজেব-এর আমলে শায়েস্তা খান এই রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন। আরও দুটি উল্লেখযোগ্য পুরাতন সড়কের মধ্যে একটি ছিল বাগদ্বার থেকে কুচবিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সড়কটি উত্তরবঙ্গের কামতাপুর থেকে ভোটমার ধাপ, মালাং এবং পীরগঞ্জ হয়ে ঘোড়াঘাটে গিয়ে শেষ হয়। অন্যটি হলো রাঙ্গামাটি-কুচবিহার সড়ক। এ দুটি সড়ক পরস্পরের সাথে কম-বেশি একটি অখন্ড বাঁধপরিবেষ্টিত উচ্চভূমির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুচবিহারের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই দুটি সড়ক। | '''সড়ক পরিবহণ''' অতীতে বাংলাদেশের বিশাল অংশ জুড়ে নৌপরিবহণ ব্যবস্থার প্রাধান্য থাকার কারণে এখানে সড়ক পরিবহণ খাতে শ্লথগতিতে উন্নয়ন ঘটে। কারণ নদীমাতৃক দেশটিতে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গীয় বদ্বীপ জুড়ে বড় বড় নদনদী ও এগুলির ছোটবড় অসংখ্য শাখানদী, খালবিল এবং নিচু জলাভূমি থাকায় পরিবহণ ব্যবস্থার বিবর্তনে নৌযানের আধিক্য ক্ষুন্ন হয় নি। এই অঞ্চলের ভূমি এতটাই সমতল ও নিচু যে সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে কয়েক মিটার উচ্চতাসম্পন্ন জায়গা রয়েছে খুব সামান্যই। বর্ষাকালে এই ভূখন্ড এক সুবিশাল জলরাশিতে প্লাবিত হয়, চারদিকে বিবিধ আকার ও আকৃতির নৌকাই শুধু বাহন হিসেবে দেখা যায়। কয়েক দশক আগেও এদেশের অনেক এলাকায় নৌকাই ছিল একমাত্র পরিবহণ। এ অঞ্চলে জলাভূমি ও নদী অতিক্রম করতে অসংখ্য সেতু ও কালভার্টসহ উচু বাঁধের উপর সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী সড়ক এবং রেলপথ তৈরির প্রয়োজন হয়। বাংলা অববাহিকায় অতি প্রাচীন সড়ক-কাম-বাঁধসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সড়ক হচ্ছে ঢাকা থেকে সংগ্রামগড় (নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বলে গণ্য করা হয়) পর্যন্ত উচু বাঁধের উপর নির্মিত রাস্তা। বাদশাহ আওরঙ্গজেব-এর আমলে শায়েস্তা খান এই রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন। আরও দুটি উল্লেখযোগ্য পুরাতন সড়কের মধ্যে একটি ছিল বাগদ্বার থেকে কুচবিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সড়কটি উত্তরবঙ্গের কামতাপুর থেকে ভোটমার ধাপ, মালাং এবং পীরগঞ্জ হয়ে ঘোড়াঘাটে গিয়ে শেষ হয়। অন্যটি হলো রাঙ্গামাটি-কুচবিহার সড়ক। এ দুটি সড়ক পরস্পরের সাথে কম-বেশি একটি অখন্ড বাঁধপরিবেষ্টিত উচ্চভূমির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুচবিহারের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই দুটি সড়ক। | ||
[[Image:RoadNetworkThreeTire.jpg|thumb|right| | [[Image:RoadNetworkThreeTire.jpg|thumb|right|600px]] | ||
হিন্দুস্থানের মানচিত্রে ভূ-জরিপবিদ জেমস রেনেল, কলকাতার সাথে বাইরের অঞ্চল-সংযুক্ত ৬টি উল্লেখযোগ্য স্থলপথের উল্রেখ করেছিলেন। এর মধ্যে দুটি সড়ক বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের অনেক অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম সড়কটি উত্তরবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী অতিক্রম করে পদ্মা নদী পার হয়ে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় সড়কটি বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণভাগ অতিক্রম করে ঢাকা ও সিলেটের দিকে বিস্তৃত হয়। অসংখ্য নদী ও খাল পেরিয়ে এই স্থলপথটি অতিক্রম করা ছিল খুবই কষ্টকর। রেনেল-এর মতে, সড়কপথে ঢাকা থেকে কলকাতার প্রকৃত দূরত্ব ছিল ১৭৭ মাইল এবং চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার দূরত্ব ছিল ৩১৭ মাইল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের প্রথমদিকে মূলত সামরিক বাহিনীর চলাচল ও ডাক যোগাযোগের দিকে লক্ষ্য রেখে কয়েকটি সড়কের উন্নয়ন করা হয়। [[গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড|গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড]] পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের পরেই কেবল চাকাযুক্ত গাড়ি চালানোর চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটে। বঙ্গদেশে স্থানীয় রাস্তা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার জমিদারদের। ১৮২২ সালের বিধি ৭ ও ১৮৩৩ সালের বিধি ৯-এর আওতায় সড়ক তহবিল গঠনের জন্য অস্থায়ী বন্দোবস্তে গড়ে ওঠা এস্টেটগুলির ওপর এক শতাংশ হারে কর ধার্য করার বিধান রাখা হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতো ভারতের সর্বত্র একটি মিলিটারি বোর্ড ওই সময়ে সড়ক উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করত। | হিন্দুস্থানের মানচিত্রে ভূ-জরিপবিদ জেমস রেনেল, কলকাতার সাথে বাইরের অঞ্চল-সংযুক্ত ৬টি উল্লেখযোগ্য স্থলপথের উল্রেখ করেছিলেন। এর মধ্যে দুটি সড়ক বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের অনেক অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম সড়কটি উত্তরবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী অতিক্রম করে পদ্মা নদী পার হয়ে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় সড়কটি বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণভাগ অতিক্রম করে ঢাকা ও সিলেটের দিকে বিস্তৃত হয়। অসংখ্য নদী ও খাল পেরিয়ে এই স্থলপথটি অতিক্রম করা ছিল খুবই কষ্টকর। রেনেল-এর মতে, সড়কপথে ঢাকা থেকে কলকাতার প্রকৃত দূরত্ব ছিল ১৭৭ মাইল এবং চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার দূরত্ব ছিল ৩১৭ মাইল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের প্রথমদিকে মূলত সামরিক বাহিনীর চলাচল ও ডাক যোগাযোগের দিকে লক্ষ্য রেখে কয়েকটি সড়কের উন্নয়ন করা হয়। [[গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড|গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড]] পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের পরেই কেবল চাকাযুক্ত গাড়ি চালানোর চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটে। বঙ্গদেশে স্থানীয় রাস্তা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার জমিদারদের। ১৮২২ সালের বিধি ৭ ও ১৮৩৩ সালের বিধি ৯-এর আওতায় সড়ক তহবিল গঠনের জন্য অস্থায়ী বন্দোবস্তে গড়ে ওঠা এস্টেটগুলির ওপর এক শতাংশ হারে কর ধার্য করার বিধান রাখা হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতো ভারতের সর্বত্র একটি মিলিটারি বোর্ড ওই সময়ে সড়ক উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করত। | ||
৩১ নং লাইন: | ৩১ নং লাইন: | ||
সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী নতুন সড়ক নির্মাণ ও সড়ক পাকা করার কাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) জন্য ব্যাহত হয়। নির্মাণসামগ্রী বহনের জন্য রেল ওয়াগনের সরবরাহও হ্রাস পায়। উপরন্তু, এই বিশ্বযুদ্ধ নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ বিলম্বিত করে দেয়। তবুও শ্লথগতিতে কয়েকটি প্রধান সড়ক প্রশস্ত করা ও পাকা করার কাজ চলতে থাকে। | সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী নতুন সড়ক নির্মাণ ও সড়ক পাকা করার কাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) জন্য ব্যাহত হয়। নির্মাণসামগ্রী বহনের জন্য রেল ওয়াগনের সরবরাহও হ্রাস পায়। উপরন্তু, এই বিশ্বযুদ্ধ নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ বিলম্বিত করে দেয়। তবুও শ্লথগতিতে কয়েকটি প্রধান সড়ক প্রশস্ত করা ও পাকা করার কাজ চলতে থাকে। | ||
[[Image:RoadNetworkNationalRegional.jpg|thumb| | [[Image:RoadNetworkNationalRegional.jpg|thumb|left|400px]] | ||
১৯৩৪ সালে সরকারের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ তত্ত্বাবধানের বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে মি. এ.জে কিং নিয়োগ পান। সরকার তাঁকে একটি সড়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। নির্মাণের ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য তাঁকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবহণ খাতে ভবিষ্যতে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে সে সম্পর্কিত বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পিত হয়। সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়নের সময় ওই সড়কগুলি যাতে ইতোমধ্যে নির্মিত কোন পাকা সড়ক কিংবা মহাসড়কসমূহ, রেলস্টেশন, বড় শহর, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় কেন্দ্র ও হাট-বাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলপথের সাথে প্রতিযোগিতা পরিহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যান চলাচল ও মাল পরিবহণের চাহিদা পূরণে ওই সকল সড়কের অধিকাংশ অংশই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এমনকি গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা ঠেলা গাড়িও ওই সকল রাস্তায় সারাবছর ধরে চলাচল করতে পারত না। ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকত। যে সকল কারণে সড়কগুলির এহেন করুণ দশার সৃষ্টি হতো সেগুলির মধ্যে রয়েছে: রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহূত নিম্নমানের মাটি, নদীর উপর সেতু না থাকায় দুই তীরের সড়কের বিচ্ছিন্নতা, বর্ষাকালে সড়ক প্লাবিত হওয়া এবং যথাযথ সংরক্ষণের অভাব। | ১৯৩৪ সালে সরকারের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ তত্ত্বাবধানের বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে মি. এ.জে কিং নিয়োগ পান। সরকার তাঁকে একটি সড়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। নির্মাণের ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য তাঁকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবহণ খাতে ভবিষ্যতে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে সে সম্পর্কিত বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পিত হয়। সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়নের সময় ওই সড়কগুলি যাতে ইতোমধ্যে নির্মিত কোন পাকা সড়ক কিংবা মহাসড়কসমূহ, রেলস্টেশন, বড় শহর, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় কেন্দ্র ও হাট-বাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলপথের সাথে প্রতিযোগিতা পরিহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যান চলাচল ও মাল পরিবহণের চাহিদা পূরণে ওই সকল সড়কের অধিকাংশ অংশই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এমনকি গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা ঠেলা গাড়িও ওই সকল রাস্তায় সারাবছর ধরে চলাচল করতে পারত না। ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকত। যে সকল কারণে সড়কগুলির এহেন করুণ দশার সৃষ্টি হতো সেগুলির মধ্যে রয়েছে: রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহূত নিম্নমানের মাটি, নদীর উপর সেতু না থাকায় দুই তীরের সড়কের বিচ্ছিন্নতা, বর্ষাকালে সড়ক প্লাবিত হওয়া এবং যথাযথ সংরক্ষণের অভাব। | ||
০৪:০৫, ১৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
সড়ক পরিবহণ অতীতে বাংলাদেশের বিশাল অংশ জুড়ে নৌপরিবহণ ব্যবস্থার প্রাধান্য থাকার কারণে এখানে সড়ক পরিবহণ খাতে শ্লথগতিতে উন্নয়ন ঘটে। কারণ নদীমাতৃক দেশটিতে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গীয় বদ্বীপ জুড়ে বড় বড় নদনদী ও এগুলির ছোটবড় অসংখ্য শাখানদী, খালবিল এবং নিচু জলাভূমি থাকায় পরিবহণ ব্যবস্থার বিবর্তনে নৌযানের আধিক্য ক্ষুন্ন হয় নি। এই অঞ্চলের ভূমি এতটাই সমতল ও নিচু যে সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে কয়েক মিটার উচ্চতাসম্পন্ন জায়গা রয়েছে খুব সামান্যই। বর্ষাকালে এই ভূখন্ড এক সুবিশাল জলরাশিতে প্লাবিত হয়, চারদিকে বিবিধ আকার ও আকৃতির নৌকাই শুধু বাহন হিসেবে দেখা যায়। কয়েক দশক আগেও এদেশের অনেক এলাকায় নৌকাই ছিল একমাত্র পরিবহণ। এ অঞ্চলে জলাভূমি ও নদী অতিক্রম করতে অসংখ্য সেতু ও কালভার্টসহ উচু বাঁধের উপর সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী সড়ক এবং রেলপথ তৈরির প্রয়োজন হয়। বাংলা অববাহিকায় অতি প্রাচীন সড়ক-কাম-বাঁধসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সড়ক হচ্ছে ঢাকা থেকে সংগ্রামগড় (নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত বলে গণ্য করা হয়) পর্যন্ত উচু বাঁধের উপর নির্মিত রাস্তা। বাদশাহ আওরঙ্গজেব-এর আমলে শায়েস্তা খান এই রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন। আরও দুটি উল্লেখযোগ্য পুরাতন সড়কের মধ্যে একটি ছিল বাগদ্বার থেকে কুচবিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সড়কটি উত্তরবঙ্গের কামতাপুর থেকে ভোটমার ধাপ, মালাং এবং পীরগঞ্জ হয়ে ঘোড়াঘাটে গিয়ে শেষ হয়। অন্যটি হলো রাঙ্গামাটি-কুচবিহার সড়ক। এ দুটি সড়ক পরস্পরের সাথে কম-বেশি একটি অখন্ড বাঁধপরিবেষ্টিত উচ্চভূমির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কুচবিহারের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই দুটি সড়ক।
হিন্দুস্থানের মানচিত্রে ভূ-জরিপবিদ জেমস রেনেল, কলকাতার সাথে বাইরের অঞ্চল-সংযুক্ত ৬টি উল্লেখযোগ্য স্থলপথের উল্রেখ করেছিলেন। এর মধ্যে দুটি সড়ক বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের অনেক অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রথম সড়কটি উত্তরবঙ্গের মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী অতিক্রম করে পদ্মা নদী পার হয়ে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় সড়কটি বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণভাগ অতিক্রম করে ঢাকা ও সিলেটের দিকে বিস্তৃত হয়। অসংখ্য নদী ও খাল পেরিয়ে এই স্থলপথটি অতিক্রম করা ছিল খুবই কষ্টকর। রেনেল-এর মতে, সড়কপথে ঢাকা থেকে কলকাতার প্রকৃত দূরত্ব ছিল ১৭৭ মাইল এবং চট্টগ্রাম থেকে কলকাতার দূরত্ব ছিল ৩১৭ মাইল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলের প্রথমদিকে মূলত সামরিক বাহিনীর চলাচল ও ডাক যোগাযোগের দিকে লক্ষ্য রেখে কয়েকটি সড়কের উন্নয়ন করা হয়। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের পরেই কেবল চাকাযুক্ত গাড়ি চালানোর চিন্তাভাবনার সূত্রপাত ঘটে। বঙ্গদেশে স্থানীয় রাস্তা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার জমিদারদের। ১৮২২ সালের বিধি ৭ ও ১৮৩৩ সালের বিধি ৯-এর আওতায় সড়ক তহবিল গঠনের জন্য অস্থায়ী বন্দোবস্তে গড়ে ওঠা এস্টেটগুলির ওপর এক শতাংশ হারে কর ধার্য করার বিধান রাখা হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতো ভারতের সর্বত্র একটি মিলিটারি বোর্ড ওই সময়ে সড়ক উন্নয়নের দায়িত্ব পালন করত।
ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম বছরগুলিতে সরকার শুধু প্রধান সড়কগুলিতে অর্থ ব্যয় করত। সম্ভবত এর কারণ ছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলে রেল ও স্টিমারের বাণিজ্যিক পরিবহণের সম্ভাবনার দ্বার তখনও উন্মুক্ত না হওয়া। ১৮৬৭-৬৮ সালের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যোগযোগ খাতে বিশেষ করে সড়ক নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রশাসন সম্পর্কে ১৮৬০-৬১ সালের বার্ষিক রিপোর্টে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ সড়কের অস্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে। ১৮৭০-৭১ সালের বার্ষিক রিপোর্টে ভারতের পূর্বাঞ্চলে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের উল্লেখ রয়েছে। মূলত কলকাতার সাথে এর চারপাশের প্রায় অর্ধডজন বড় জনপদের সঙ্গে এই সড়কগুলি সংযুক্ত ছিল। পূর্ব ভারতের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ জনপথের মধ্যে তিনটি সড়ক বাংলাদেশের যোগাযোগ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। এগুলি হলো: কলকাতা থেকে বিরহামপুর, ভগবানগোলা, গোদাগাড়ী, দিনাজপুর এবং শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং পর্যন্ত দার্জিলিং ট্রাঙ্ক রোড; কলকাতা থেকে বনগাঁও ও যশোর হয়ে ফরিদপুর পর্যন্ত যশোর রোড এবং দাউদকান্দি, কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চিটাগাং ট্রাঙ্ক রোড। এই তিনটি ট্রাঙ্ক রোডের সাথে উল্লেখ্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হচ্ছে দার্জিলিং ট্রাঙ্ক রোড থেকে বেরিয়ে দিনাজপুর হয়ে ব্রহ্ম্রপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত সড়ক।
১৮৮০-৮১ সাল নাগাদ সরকারের সড়ক সম্পর্কিত নীতিমালায় কয়েকটি নতুন বিবেচনা খুব গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে বারবার কৃষক আন্দোলন ও আদিবাসীদের অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ঔপনিবেশিক শাসকদের সেখানে দ্রুত শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সশস্ত্রবাহিনী প্রেরণ করা জরুরি হয়ে পড়ে বলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সড়ক ব্যবস্থা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
১৯০০ সালে বাংলার সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণাধীন সড়কের দৈর্ঘ্য নিচের সারণিতে দেওয়া হলো:
সারণি ১৯০০ সালে বিভিন্ন সংস্থার আওতাভুক্ত সড়কের দৈর্ঘ্য (মাইলে)।
বিভাগ | গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) | স্থানীয় সরকার | মোট | |||
পাকা | কাঁচা | পাকা | কাঁচা | পাকা | কাঁচা | |
রাজশাহী | ১৫১.৫ | ২২২ | ১৩৩ | ৪৮০৩.৭৫ | ২৮৪.৫ | ৫০২৫.৭৫ |
ঢাকা | --- | --- | ৬০ | ১৩৯৫ | ৬০.২৫ | ১৩৯৫.৭ |
চট্টগ্রাম | --- | --- | ১৫ | ১৩৬১ | ১৫ | ১৩৬১.২৫ |
প্রেসিডেন্সি | ১৪.৫ | --- | ৫২০ | ৪৫১৫.৭৫ | ৫৩৪.৫৪ | ৪৫১৫.২৫ |
সারাবছর ধরে চলাচলের উপযোগী নতুন সড়ক নির্মাণ ও সড়ক পাকা করার কাজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) জন্য ব্যাহত হয়। নির্মাণসামগ্রী বহনের জন্য রেল ওয়াগনের সরবরাহও হ্রাস পায়। উপরন্তু, এই বিশ্বযুদ্ধ নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ বিলম্বিত করে দেয়। তবুও শ্লথগতিতে কয়েকটি প্রধান সড়ক প্রশস্ত করা ও পাকা করার কাজ চলতে থাকে।
১৯৩৪ সালে সরকারের সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পসমুহ তত্ত্বাবধানের বিশেষ কর্মকর্তা হিসেবে মি. এ.জে কিং নিয়োগ পান। সরকার তাঁকে একটি সড়ক পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দেয়। নির্মাণের ফলে যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য তাঁকে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি সড়ক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়নেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবহণ খাতে ভবিষ্যতে যে সম্ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে সে সম্পর্কিত বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পিত হয়। সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়নের সময় ওই সড়কগুলি যাতে ইতোমধ্যে নির্মিত কোন পাকা সড়ক কিংবা মহাসড়কসমূহ, রেলস্টেশন, বড় শহর, গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় কেন্দ্র ও হাট-বাজারের সঙ্গে সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলপথের সাথে প্রতিযোগিতা পরিহারেরও পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যান চলাচল ও মাল পরিবহণের চাহিদা পূরণে ওই সকল সড়কের অধিকাংশ অংশই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এমনকি গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি বা ঠেলা গাড়িও ওই সকল রাস্তায় সারাবছর ধরে চলাচল করতে পারত না। ফলে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকত। যে সকল কারণে সড়কগুলির এহেন করুণ দশার সৃষ্টি হতো সেগুলির মধ্যে রয়েছে: রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহূত নিম্নমানের মাটি, নদীর উপর সেতু না থাকায় দুই তীরের সড়কের বিচ্ছিন্নতা, বর্ষাকালে সড়ক প্লাবিত হওয়া এবং যথাযথ সংরক্ষণের অভাব।
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ উন্নয়ন তেমন জোরদার ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে মাত্র ৪৮০ কিলোমিটার উন্নতমানের পাকা সড়ক। এগুলির মধ্যে ৫৬.৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ সিলেট-তামাবিল সড়কটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ওই সময়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে মোট কাঁচা রাস্তার দৈর্ঘ্য ছিল ৩,৬০০ কিলোমিটার। গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডবিউডি), জেলা বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ডগুলি সড়ক, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল। ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে পরিকল্পিতভাবে রাজধানী ঢাকার সাথে জেলা শহরগুলির সংযোগ সড়ক নির্মাণ শুরুর মাধ্যমে এই ভূখন্ডে সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন গতিশীল হয়। ফলে ১৯৭০ সাল নাগাদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকা সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় আটগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩,৮৬০ কিলোমিটার।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর সড়ক পরিবহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ খাত হিসেবে বিকাশ লাভ করে। খুব দ্রুত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সড়ক, সেতু ও কালভার্টসমূহ পুনর্নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি জাতীয় মহাসড়কগুলিতে বেশ কয়েকটি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়। ফলে সড়ক পরিবহণ ব্যবসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিস্তৃত হতে থাকে। এই খাতে কয়েক হাজার শ্রমিক ও কর্মচারীর কর্মসংস্থান হতে থাকে। সড়ক পরিবহণের উন্নয়ন পরিকল্পনা, যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনা এবং সড়ক ও মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পায়। এই খাতে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জাতীয় মহাসড়কগুলিসহ আঞ্চলিক ও সংযোগ সড়কসমূহ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পড়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওপর। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতো নগর উন্নয়ন সংস্থাগুলি, জেলা পরিষদসমূহ এবং স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলি নিজ নিজ এলাকার সড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলি যথাক্রমে বড় বড় নগরী ও শহরাঞ্চলের সড়ক পরিবহণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকায় চলাচলের জন্য রিকশার লাইসেন্স ইস্যু করে। পুলিশ সকল এলাকার যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মোটরযানের লাইসেন্স ও যাত্রীবাহী বাসের রুট পারমিট প্রদান করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্পোরেশন (বিআরটিসি) রাষ্টী্রয় মালিকানাধীন যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড মোটরযানের জ্বালানি হিসেবে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) সরবরাহ করে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত দেশব্যাপী বিস্তৃত সড়ক নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য ২০০১ সালে প্রায় ২০,৮৫৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়। এর মধ্যে ৩,১৪৪ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ১,৭৪৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৫,৯৬৪ কিলোমিটার প্রথম শ্রেণির সংযোগ সড়ক। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলির প্রায় সম্পূর্ণ অংশই পাকা। এছাড়া প্রথম শ্রেণির সংযোগ সড়কগুলির শতকরা ৫০ ভাগ পিচঢালা। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) দেশের সদর উপজেলা, গ্রামগঞ্জ ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে ছোট ছোট সংযোগ সড়ক নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করে। ২০০১ সাল পর্যন্ত এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত এ ধরনের সড়কগুলির মোট দৈর্ঘ্য ১,৪৯,১৬৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির (‘বি’ টাইপ) সংযোগ সড়কগুলির মোট দৈর্ঘ্য ১৪,৩৯৩ কিলোমিটার এবং আর-১, আর-২, ও আর-৩ নামে পরিচিত তিন ধরনের গ্রামীণ সড়কের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৩৭,৮২৭ কিলোমিটার, ৪৯,৫৩৮ কিলোমিটার এবং ৪৭,৪০৯ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ প্রতিবছর বন্যাকবলিত হয় বলে সড়কগুলি সাধারণত উঁচু বাঁধের উপর নির্মাণ করা হয়। জাতীয় মহাসড়কগুলি যে সকল বাঁধের উপর নির্মিত হয় সেগুলির প্রস্থ ১২.২ মিটার, সড়কের প্রস্থ ৭.৩ মিটার এবং উচ্চতা ১.৮৩ মিটার হয়ে থাকে। আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে এই তিনটি পরিমাপ যথাক্রমে ১০ মিটার, ৫.৫ মিটার এবং ১.৮৩ মিটার হয়ে থাকে। প্রথম (এ) ও দ্বিতীয় (বি) শ্রেণির সংযোগ সড়কগুলির জন্য বাঁধের উপরিতলের প্রস্থ ৭.৩ মিটার, সড়কের প্রস্থ ৩.৬৬ মিটার এবং বাঁধের উচ্চতা ১.৮৩ মিটার হয়ে থাকে। অবশ্য জাতীয় মহাসড়কগুলির দুই-তৃতীয়াংশেরই পরিমাপ এই নির্ধারিত মাপের চেয়ে কম।
বাংলাদেশের সার্বিক সড়ক নেটওয়ার্কের মান সাধারণভাবে ভাল বলে গণ্য করা হলেও এগুলির প্রকৃত অবস্থা তেমন ভাল নয়। এগুলি যানবাহন চলাচলের চাহিদা সন্তোষজনকভাবে মেটাতে সক্ষম নয়। নিম্নমানের নির্মাণ, অধিকাংশ বাঁধে জমাট গাঁথুনির অপ্রতুলতা এবং সড়কে ব্যবহূত দ্রব্যসামগ্রী আর্দ্রতা নিরোধক না হওয়ার ফলে এই অবনতি ঘটে। নদ-নদীগুলির প্লাবনভূমি জুড়ে গড়ে তোলা সড়ক নেটওয়ার্কে নিষ্কাশন সুবিধা না থাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ জলাবদ্ধতার ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী ও প্রকট রূপ ধারণ করে। প্রবল বন্যার তোড়ে সড়কের ক্ষয়ক্ষতি এবং নদী ভাঙনের ফলে তীরবর্তী সড়কগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যান্ত্রিক বাহনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪,৩৮০ এবং এই সংখ্যা স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মোটরগাড়ির মোট সংখ্যা ছিল ১,৩৩,২৫৩ এবং ১৯৯৯ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪ লাখ ৬ হাজারে উন্নীত হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেশিসংখ্যক সড়ক ও সেতু নির্মাণের সাথে সাথে যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা ও চলাচল বৃদ্ধি পেয়ে পরিবহণ ব্যবসায়ের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৯৬-২০০১ সালে সারা দেশের শতকরা ৭৩ ভাগ যাত্রী সড়কপথে যাতায়াত করে এবং শতকরা ৬০ ভাগ মালপত্র এ পথেই পরিবহণ করা হয়। শুধু ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ সরকার ৩,২৪৫ কিলোমিটার পিচঢালা সড়ক, ১,৩৬৫ কিলোমিটার বাঁধ-কাম-রাস্তা, ১,৬৭০ কিলোমিটার বেইলি সেতু এবং সড়ক, ১,০৬৫ মিটার সেতু, ১৮,৬১৭ মিটার বেইলি সেতু এবং ২,০৩৫ মিটার সেতু নির্মাণ করে। ২০০০-২০০১ অর্থ বছরে পূর্বোক্ত খাতগুলিতে সরকারি নির্মাণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩,৭১৯ কিলোমিটার, ৩,৭৬৬ কিলোমিটার, ২,১৫৯ কিলোমিটার, ১৩,৮১৩ মিটার, ২৩,১৭৬ মিটার এবং ৬,১৮৮ মিটার। ১৯৯০ দশকের শেষার্ধে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং এটি ১৯৯৮ সালে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে বাংলাদেশে আরও যে সকল গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মিত হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে ধরলা সেতু, ৪র্থ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, লাঙ্গলবন্দ সেতু এবং দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু। বড় বড় নদীর উপর নির্মিত এ সকল সেতু জাতীয় মহাসড়কগুলির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় সড়কপথে যানবাহন চলাচলের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
১৯৯১-৯২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩,৮৪,০০০ রিকশা, ৪৮,২৭২টি ঠেলাগাড়ি, ৭,০২,০০০টি গরুর গাড়ি, ২১,৫৭৮টি বাস ও মিনিবাস, ২,২৭৯টি মাইক্রোবাস, ৩০,৯৯৪টি ট্রাক, ৮,৯২৭টি জিপ, ৩৪,৮১৭টি কার, ২,১৪০টি ট্যাক্সি, ৩০,১৯৪টি অটোরিকশা এবং ১,১৬,৬৮৯টি মোটর সাইকেল ছিল। ১৯৯৯ সাল নাগাদ এসব সংখ্যা গড়ে ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) যোগাযোগ খাতে ৬৩.২০ বিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয়। সরকার এ সময়ে যে সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, সেগুলির মধ্যে রয়েছে খুলনায় রূপসা সেতু, পদ্মা নদীর উপর পাকশী সেতু এবং ভৈরবে মেঘনা নদীর উপর আরেকটি সেতু নির্মাণ। উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উন্নয়ন, কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলীয় সড়ক, সিলেট-জাফলং মহাসড়ক এবং ভোলা-বরিশাল-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের নির্মাণে কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
সরকারের গণপরিবহণ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা বিআরটিসি ২০০০ সাল পর্যন্ত একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান ছিল। বিআরটিসির বহরে ছিল ২৭৩টি গাড়ি এবং দৈনিক এ সকল যানবাহনে ৮৪ হাজার যাত্রী যাতায়াত করত। ২০০১ সালে কয়েকটি দ্বিতল বাসসহ বিআরটিসির যাত্রীবাহী গাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬১টিতে। এখন এইসব বাহনে দৈনিক তিন লক্ষ যাত্রী পরিবহণ সুবিধা পাচ্ছে। এ বছরে বিআরটিসির পরিবহণ খাত থেকে মুনাফা হয়েছে ১৬৭.০১ মিলিয়ন টাকা। সড়ক ও মহাসড়কগুলির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন হওয়ায় বিআরটিসির সিটি সার্ভিস বাস এবং বেসরকারি খাতে সিটি সার্ভিস ও আন্তঃজেলা বিলাসবহুল কোচ সার্ভিসের চলাচল উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতকিছুর পরেও অবশ্য মহানগরীগুলিতে পরিবহণ ব্যবস্থায় তেমন উন্নতি ঘটে নি। রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি উভয়খাত মিলিয়ে যাত্রীবাহী বাস চলছে ১,৭০০টি। অথচ যাত্রীদের চাহিদাপূরণে প্রয়োজন কমপক্ষে ৫,০০০টি বাসের প্রয়োজন। ঢাকা নগরীতে চলাচলকারী মোট যানবাহনের সংখ্যা সাড়ে ছয় লক্ষ। এর মধ্যে যন্ত্রচালিত গাড়ির সংখ্যা মাত্র আড়াই লাখ, বাকি ৪ লাখই রিকশা। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর ৬৫ শতাংশ বাসিন্দা কোন ধরনের যানবাহনে চড়ে না, অথচ তাদের হাঁটার জন্য রয়েছে মাত্র ২২০ কিলোমিটার ফুটপাত। বাকি যে সকল নগরবাসী চলাচলের জন্য যানবাহনে চড়ে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ (৩৫%) রিকশায় আরোহণ করে। বাসে চড়ে শতকরা ২৭ ভাগ যাত্রী, বেবি ট্যাক্সি ও টেম্পুতে চড়ে শতকরা ১৫ ভাগ এবং মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রী প্রাইভেট কারে যাতায়াত করে। বর্তমানে (২০০১) ঢাকায় চার লেনবিশিষ্ট সড়ক রয়েছে ৪৩৬ কিলোমিটার এবং দুই লেনবিশিষ্ট রাস্তা রয়েছে ১,৪০৮ কিলোমিটার। প্রায় দশ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই নগরীতে মাত্র ৮ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে সড়ক, জনপথ ও অলিগলি। অথচ যে কোন নগরীর সুষ্ঠু সড়ক পরিবহণের জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে রাস্তা থাকা প্রয়োজন। রাজধানী ঢাকার গণপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে দশ হাজার মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে সরকার এখন ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বাংলাদেশের সড়কগুলিতে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে রিকশা। দেশে রেজিস্টার্ড রিকশার সংখ্যা ৫ লক্ষ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ৪ লক্ষ ৭০ হাজারই শহরে চলাচল করে। বাকি এক লক্ষ পল্লী অঞ্চলে চলাচল করে। ঢাকা মহানগরীতে লাইসেন্সকৃত রিকশার সংখ্যা মাত্র ১,২৮,০৮৫, অথচ প্রকৃতপক্ষে নিবন্ধন ছাড়াই এর কয়েকগুণ বেশি রিকশা অবৈধভাবে চলাচল করে। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোটরগাড়ি বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ছিল ১০ শতাংশ যা জনসংখা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক বেশি। এই পাঁচ বৎসরে বিআরটিএ ৫০,৩৫০টি ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করে। পরবর্তী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে ৮২,৬৮৮-তে দাঁড়ায়। ১৯৯০-৯৫ মেয়াদে বিআরটিএ ৮৬,১৭৪টি মোটরগাড়ির রুট পারমিট প্রদান করে। অথচ ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যানবাহনের দেওয়া রুট পারমিটের সংখ্যা গড়ে দাঁড়ায় ১,১৫,৭৮৬টিতে। বিআরটিএ ১৯৯০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছরে ৯৬,৬২৩টি এবং পরবর্তী পাঁচ বছরে ১,৬০,৬২৬টি মোটরগাড়ি নিবন্ধন করে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের সড়কগুলিতে চার লক্ষ ছয় হাজারেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক মোটরযান চালু ছিল। এর মধ্যে বাস ও মিনিবাস ২৬,৭০৭টি, মাইক্রোবাস ১২,৫৮০টি, ট্রাক ৪২,৭৫০টি, জিপ ১০,৩৪৬টি, কার ৫৬,৩৭৭টি, ট্যাক্সি ২,৩৭৬টি, অটোরিকশা ও অটো টেম্পু ৮৯,৩১৭টি এবং মোটর সাইকেল ১,৬৫,৪৬০টি। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশের প্রায় সকল বড় শহরে বেসরকারি ট্যাক্সি ক্যাব চালু হয়েছে। বিদেশী সহায়তায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা ঢাকায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস চালু করেছে। ভারতের প্রতিবেশী রাজ্যগুলির রাজধানীর সাথে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা থেকে কলকাতা ও আগরতলায় নিয়মিত বিলাসবহুল কোচ সার্ভিস চলাচল করছে এবং যানবাহনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনিবার্যভাবে নগরী ও বড় শহরগুলিতে যানজট সৃষ্টি একটি দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। [মো. ফজলুল বারী এবং মাহবুবুল আলম]