জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না) | |||
১ নং লাইন: | ১ নং লাইন: | ||
[[Category:Banglapedia]] | [[Category:Banglapedia]] | ||
'''জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়''' | '''জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়''' বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিমি দূরে সাভারের কাছে এশিয়ান হাইওয়ের (ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক) পশ্চিম পার্শ্বে ৬৯৭.৫৬ একর ভূমির উপর এটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে একই ধরনের দু’টি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগ ঢাকার কাছে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে। | ||
[[Image:JahangirnagarUniversity.jpg|thumb|right|400px|ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]] | |||
এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমানো। ১৯৬৫ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ এ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। এই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে গাজীপুর জেলার সালনা এলাকায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে সাভারে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছ থেকে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। বিশ শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে ক্যাম্পাসের দক্ষিণ পাশ থেকে ৫০ একর জায়গা বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে দিয়ে দেওয়া হয়। | |||
১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে রসায়নবিদ ড. সুরাত আলী খান এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এর ২ বছর ৬ মাস ২ দিন পর অর্থাৎ ২০শে আগস্ট ১৯৭০ সালে বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭০’ পকিস্তানের জাতীয় সংসদে পাশ হয়। প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মফিজউদ্দিন আহমেদ। তিনি ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর যোগদান করেন। যোগদানের পূর্বে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্ম কমিশনের সদস্য ছিলেন। | |||
একটি বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৫টি অনুষদ যথা কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মৌলিক বিজ্ঞান ও ফলিত বিজ্ঞান নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরে শুধু সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন ৪টি বিভাগ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বিভাগগুলি হলো অর্থনীতি, ভূগোল, পরিসংখ্যান এবং গণিত। বাংলা ও ইংরেজি মাইনর বিভাগ হিসেবে যুক্ত হয়। শুরুতে ৪টি বিভাগে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৫০। আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে প্রতি ছাত্রছাত্রীর জন্য আবাসিক হলে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। এ জন্য তারা মাসিক ১০০ টাকা স্টাইপেন্ড পেত। | |||
শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ছিল ২১ জন। অধ্যাপক মালিক খসরু চৌধুরী ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিন এবং অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি। প্রফেসর আ.ফ.ম কামালউদ্দীন ছিলেন ভূগোল বিভাগের, প্রফেসর আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের এবং প্রফেসর মিরাজ উদ্দীন মন্ডল ছিলেন গণিত বিভাগের সভাপতি। প্রফেসর মাহবুবুল হক ও প্রফেসর এম.এ রকীবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য। ৪টি বিভাগে ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্নাতক শ্রেণিীত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারিতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস.এম আহসান। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি প্রকল্প আকারে পরিচালিত হয়। | |||
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বেশ কিছু ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বিশ^বিদ্যালটির পূর্ণভাবে কর্মকা- আরম্ভ হয় প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান-এর ২য় উপাচার্য হিসেবে ১৯৭২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে যোগদানের পর থেকে। | |||
১৯৭৩ সালের ৮ই অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বিশ^বিদ্যালয়ের ১৯৭০ সালের অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় এ্যাক্ট পাশ হয় এবং এর কার্যকারিতা ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে দেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। | |||
[[Image:JahangirnagarUniversity2.jpg|thumb|left|400px|শহীদ মিনার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]] | [[Image:JahangirnagarUniversity2.jpg|thumb|left|400px|শহীদ মিনার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]] | ||
বর্তমানে | বর্তমানে (২০২৩) বিশ^বিদ্যালয়ে ৬টি অনুয়দ রয়েছে: কলা ও মানবিকী, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ ও আইন অনুষদ। এই ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, এবং ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং এন্ড জিআইএস। গবেষণার জন্য রয়েছে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র ও সেন্টার অব এক্সসেলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং। | ||
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর শিক্ষার্থীরা এম.ফিল ও পিএইচ.ডি গবেষণা করতে পারে। অনুষদগুলি আলাদা আলাদা জার্নাল প্রকাশ করে। বিজ্ঞান অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভারসিটি জার্নাল অব সাইন্স, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে সোস্যাল সাইন্স রিভিউ, বায়োলজিক্যাল সাইন্স থেকে বাংলাদেশ জার্নাল অব লাইফ সাইন্স এবং কলা অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ পার্ট-৩। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ নামে একটি জার্নাল বের করে। | বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর শিক্ষার্থীরা এম.ফিল ও পিএইচ.ডি গবেষণা করতে পারে। অনুষদগুলি আলাদা আলাদা জার্নাল প্রকাশ করে। বিজ্ঞান অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভারসিটি জার্নাল অব সাইন্স, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে সোস্যাল সাইন্স রিভিউ, বায়োলজিক্যাল সাইন্স থেকে বাংলাদেশ জার্নাল অব লাইফ সাইন্স এবং কলা অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ পার্ট-৩। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ নামে একটি জার্নাল বের করে। | ||
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির জলাশয়। শীতের মৌসুমে এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে এবং অতিথি পাখি দেখতে অনেক পর্যটক আসেন। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। | |||
বিশ্ববিদ্যালয়টি সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত। সিনেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিধিবিধান প্রণয়ন ও বাজেট অনুমোদনের সর্বোচ্চ সংস্থা। অর্থকমিটি বার্ষিক বাজেট তৈরি করার পর সিনেট যাচাই-বাছাই করে তা অনুমোদন করে। ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য সিনেট তিন সদস্যের একটি প্যানেল তৈরি করে। এই প্যানেল থেকে চ্যান্সেলর চার বছরের জন্য একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেন। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং ট্রেজারারও নিয়োগ দেন চ্যান্সেলর। নিয়মতান্ত্রিকভাবে চ্যান্সেলর হন রাষ্ট্রপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক প্রধান হলেন ভাইস চ্যান্সেলর। ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক আর্থিক তহবিল দেখভাল করেন। একাডেমিক কাউন্সিল, অ্যাডভ্যান্স স্টাডিজ বোর্ড, অনুষদ এবং কোর্স সংক্রান্ত কমিটি একাডেমিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এক বা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে ডিন হওয়ার জন্য কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক হতে হয়। বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তবে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য কম পক্ষে সহকারী অধ্যাপক হতে হয়। বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের কার্যকালের মেয়াদ তিন বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক অফিসার হলেন রেজিস্ট্রার। | |||
সিন্ডিকেট | [[Image:JahangirnagarUniversity3.jpg|thumb|right|400px|প্রীতিলতা হল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]] | ||
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার খুবই সমৃদ্ধ। গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ১লাখ ২০ হাজার বই আছে। গ্রন্থাগারে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ১টি জিমনাসিয়াম, ১টি সুইমিংপুল এবং ১টি ক্যাফেটেরিয়া এবং ছাত্রছাত্রীদের চিকিৎসার জন্য ১টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, ও কর্মচারিদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। নতুন কলা ভবনের সম্মুখে নির্মিত ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনারের একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনায়তন হিসেবে রয়েছে একটি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র। ৩০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দানের জন্য রয়েছে স্টুডেন্টস সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ২টি নামকরা ভাস্কর্য। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ‘সংসপ্তক’ এবং সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে ‘অমর একুশে’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে ১৬টি আবাসিক হল। এর মধ্যে ৮টি ছাত্রদের এবং ৮টি ছাত্রীদের। | |||
বর্তমানে (জানুয়ারি ২০২৩) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১২,৯৩৮ (এম.ফিল ১০২৪ জন ও পিএইচ.ডি ১২৭৯ জন), শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৭২১ জন, কর্মকর্তার সংখ্যা ৩৬৫ জন, এবং কর্মচারির সংখ্যা ১৩৯০ জন। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতি ছাত্রছাত্রীকে আবাসিক হলে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। এ জন্য প্রতি ছাত্র মাসিক ১০০ টাকা স্টাইপেন্ড পেত। আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হওয়াতে বর্তমানে ১ম বর্ষ সম্মান ক্লাস থেকে ৪র্থ সম্মান (৪ বছর) ও ১ বছর স্নাতকোত্তর ক্লাসের জন্য মেধার ভিত্তিতে শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্রছাত্রীকে প্রতি মাসে ৫০০/- টাকা করে বছরে মোট ৬০০০/- টাকা স্টাইপেন্ড হিসেবে দেয়া হয়। [মেসবাহ-উস-সালেহীন] | |||
[[en:Jahangirnagar University]] | [[en:Jahangirnagar University]] |
১৫:৪১, ১৬ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানী ঢাকা থেকে ৩২ কিমি দূরে সাভারের কাছে এশিয়ান হাইওয়ের (ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক) পশ্চিম পার্শ্বে ৬৯৭.৫৬ একর ভূমির উপর এটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে একই ধরনের দু’টি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৪ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগ ঢাকার কাছে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমানো। ১৯৬৫ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ এ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। এই প্রকল্পের উপর ভিত্তি করে গাজীপুর জেলার সালনা এলাকায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৭ সালে সাভারে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছ থেকে ৭৫০ একর জমি বরাদ্দ নেওয়া হয়। বিশ শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে ক্যাম্পাসের দক্ষিণ পাশ থেকে ৫০ একর জায়গা বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে দিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে রসায়নবিদ ড. সুরাত আলী খান এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এর ২ বছর ৬ মাস ২ দিন পর অর্থাৎ ২০শে আগস্ট ১৯৭০ সালে বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭০’ পকিস্তানের জাতীয় সংসদে পাশ হয়। প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর মফিজউদ্দিন আহমেদ। তিনি ১৯৭০ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর যোগদান করেন। যোগদানের পূর্বে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্ম কমিশনের সদস্য ছিলেন।
একটি বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৫টি অনুষদ যথা কলা ও মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মৌলিক বিজ্ঞান ও ফলিত বিজ্ঞান নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত থাকলেও পরে শুধু সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন ৪টি বিভাগ নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বিভাগগুলি হলো অর্থনীতি, ভূগোল, পরিসংখ্যান এবং গণিত। বাংলা ও ইংরেজি মাইনর বিভাগ হিসেবে যুক্ত হয়। শুরুতে ৪টি বিভাগে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ছিল ১৫০। আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হিসেবে প্রতি ছাত্রছাত্রীর জন্য আবাসিক হলে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। এ জন্য তারা মাসিক ১০০ টাকা স্টাইপেন্ড পেত।
শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ছিল ২১ জন। অধ্যাপক মালিক খসরু চৌধুরী ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রথম ডিন এবং অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি। প্রফেসর আ.ফ.ম কামালউদ্দীন ছিলেন ভূগোল বিভাগের, প্রফেসর আসকার ইবনে শাইখ ছিলেন পরিসংখ্যান বিভাগের এবং প্রফেসর মিরাজ উদ্দীন মন্ডল ছিলেন গণিত বিভাগের সভাপতি। প্রফেসর মাহবুবুল হক ও প্রফেসর এম.এ রকীবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য। ৪টি বিভাগে ১৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্নাতক শ্রেণিীত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি প্রথম ক্লাস শুরু হলেও ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারিতে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এস.এম আহসান। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি প্রকল্প আকারে পরিচালিত হয়।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বেশ কিছু ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বিশ^বিদ্যালটির পূর্ণভাবে কর্মকা- আরম্ভ হয় প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান-এর ২য় উপাচার্য হিসেবে ১৯৭২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে যোগদানের পর থেকে। ১৯৭৩ সালের ৮ই অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বিশ^বিদ্যালয়ের ১৯৭০ সালের অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় এ্যাক্ট পাশ হয় এবং এর কার্যকারিতা ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে দেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমানে (২০২৩) বিশ^বিদ্যালয়ে ৬টি অনুয়দ রয়েছে: কলা ও মানবিকী, গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, বিজনেস স্টাডিজ ও আইন অনুষদ। এই ৬টি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, এবং ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং এন্ড জিআইএস। গবেষণার জন্য রয়েছে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র ও সেন্টার অব এক্সসেলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগেই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ থিসিস জমা দিতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর শিক্ষার্থীরা এম.ফিল ও পিএইচ.ডি গবেষণা করতে পারে। অনুষদগুলি আলাদা আলাদা জার্নাল প্রকাশ করে। বিজ্ঞান অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভারসিটি জার্নাল অব সাইন্স, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে সোস্যাল সাইন্স রিভিউ, বায়োলজিক্যাল সাইন্স থেকে বাংলাদেশ জার্নাল অব লাইফ সাইন্স এবং কলা অনুষদ থেকে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ পার্ট-৩। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে জাহাঙ্গীরনগর রিভিউ নামে একটি জার্নাল বের করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ পানির জলাশয়। শীতের মৌসুমে এখানে প্রচুর অতিথি পাখি আসে এবং অতিথি পাখি দেখতে অনেক পর্যটক আসেন। ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত। সিনেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিধিবিধান প্রণয়ন ও বাজেট অনুমোদনের সর্বোচ্চ সংস্থা। অর্থকমিটি বার্ষিক বাজেট তৈরি করার পর সিনেট যাচাই-বাছাই করে তা অনুমোদন করে। ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য সিনেট তিন সদস্যের একটি প্যানেল তৈরি করে। এই প্যানেল থেকে চ্যান্সেলর চার বছরের জন্য একজন ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেন। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং ট্রেজারারও নিয়োগ দেন চ্যান্সেলর। নিয়মতান্ত্রিকভাবে চ্যান্সেলর হন রাষ্ট্রপতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক প্রধান হলেন ভাইস চ্যান্সেলর। ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক আর্থিক তহবিল দেখভাল করেন। একাডেমিক কাউন্সিল, অ্যাডভ্যান্স স্টাডিজ বোর্ড, অনুষদ এবং কোর্স সংক্রান্ত কমিটি একাডেমিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিভিন্ন অনুষদের ডিন এক বা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে ডিন হওয়ার জন্য কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক হতে হয়। বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তবে চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য কম পক্ষে সহকারী অধ্যাপক হতে হয়। বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের কার্যকালের মেয়াদ তিন বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক অফিসার হলেন রেজিস্ট্রার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার খুবই সমৃদ্ধ। গ্রন্থাগারটিতে প্রায় ১লাখ ২০ হাজার বই আছে। গ্রন্থাগারে রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি কেন্দ্রীয় মসজিদ, ১টি জিমনাসিয়াম, ১টি সুইমিংপুল এবং ১টি ক্যাফেটেরিয়া এবং ছাত্রছাত্রীদের চিকিৎসার জন্য ১টি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, ও কর্মচারিদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। নতুন কলা ভবনের সম্মুখে নির্মিত ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু শহীদ মিনারের একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনায়তন হিসেবে রয়েছে একটি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র। ৩০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দানের জন্য রয়েছে স্টুডেন্টস সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ২টি নামকরা ভাস্কর্য। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ‘সংসপ্তক’ এবং সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে ‘অমর একুশে’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রয়েছে ১৬টি আবাসিক হল। এর মধ্যে ৮টি ছাত্রদের এবং ৮টি ছাত্রীদের।
বর্তমানে (জানুয়ারি ২০২৩) বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১২,৯৩৮ (এম.ফিল ১০২৪ জন ও পিএইচ.ডি ১২৭৯ জন), শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৭২১ জন, কর্মকর্তার সংখ্যা ৩৬৫ জন, এবং কর্মচারির সংখ্যা ১৩৯০ জন। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতি ছাত্রছাত্রীকে আবাসিক হলে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। এ জন্য প্রতি ছাত্র মাসিক ১০০ টাকা স্টাইপেন্ড পেত। আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় হওয়াতে বর্তমানে ১ম বর্ষ সম্মান ক্লাস থেকে ৪র্থ সম্মান (৪ বছর) ও ১ বছর স্নাতকোত্তর ক্লাসের জন্য মেধার ভিত্তিতে শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্রছাত্রীকে প্রতি মাসে ৫০০/- টাকা করে বছরে মোট ৬০০০/- টাকা স্টাইপেন্ড হিসেবে দেয়া হয়। [মেসবাহ-উস-সালেহীন]