গৃহায়ন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
৪ নং লাইন: ৪ নং লাইন:
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ ৮০ হাজার গ্রামে বসবাস করে এবং বাকিরা প্রায় ৫২৫ টি ছোট-বড় শহরে বাস করে এবং যার মধ্যে ঢাকার মত সুবিশাল মেগাসিটিও রয়েছে। তাই বাংলদেশের গৃহায়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে গ্রামীণ ও নগর, দুটি ভৌগোলিক অবস্থাই বিবেচনা করা আবশ্যক।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ ৮০ হাজার গ্রামে বসবাস করে এবং বাকিরা প্রায় ৫২৫ টি ছোট-বড় শহরে বাস করে এবং যার মধ্যে ঢাকার মত সুবিশাল মেগাসিটিও রয়েছে। তাই বাংলদেশের গৃহায়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে গ্রামীণ ও নগর, দুটি ভৌগোলিক অবস্থাই বিবেচনা করা আবশ্যক।


[[Image:RuralArchitechure3.jpg|thumb|400px|right|পল্লী গৃহ]]
[[Image:RuralArchitechure3.jpg|thumb|400px|right|পল্লী গৃহ [''সৌজন্যে: আমানুল হক'']]]
'''''গৃহের ধরণ'''''  বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে দু’ধরনের গৃহ রয়েছে। গ্রামীণ বসত বাটী বা বাড়ির একটি উপাদান গৃহ এবং এর অন্যান্য উপাদানগুলি হচ্ছে উঠান (বা আঙ্গিনা), গৃহের চারপাশের গাছপালা ও একটি বা দুটি পুকুর। গ্রামীণ বসতি আবার একটি গ্রামের অংশ যেখানে বসতির বিন্যাস কখনো রৈখিক বা পুঞ্জীভূত। সাংস্কৃতিক ভূগোলবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রধানত সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহগুলিকে শ্রেণি বিন্যাস করেছেন। তাঁর মতে গ্রামীণগৃহের ধরণগুলি হলাে:
'''''গৃহের ধরণ'''''  বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে দু’ধরনের গৃহ রয়েছে। গ্রামীণ বসত বাটী বা বাড়ির একটি উপাদান গৃহ এবং এর অন্যান্য উপাদানগুলি হচ্ছে উঠান (বা আঙ্গিনা), গৃহের চারপাশের গাছপালা ও একটি বা দুটি পুকুর। গ্রামীণ বসতি আবার একটি গ্রামের অংশ যেখানে বসতির বিন্যাস কখনো রৈখিক বা পুঞ্জীভূত। সাংস্কৃতিক ভূগোলবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রধানত সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহগুলিকে শ্রেণি বিন্যাস করেছেন। তাঁর মতে গ্রামীণগৃহের ধরণগুলি হলাে:


৩২ নং লাইন: ৩২ নং লাইন:
{| class="table table-bordered table-hover"
{| class="table table-bordered table-hover"
|-
|-
| rowspan="2" | গৃহ ধরণ  ||  colspan="2" | মোট  ||  colspan="2" | নগরে ||  colspan="2" | গ্রামীণ
| rowspan="2" | গৃহ ধরণ  ||  colspan="2" | মোট  ||  colspan="2" | নগুরে ||  colspan="2" | গ্রামীণ
|-
|-
| সংখ্যা (’০০০) || শতকরা  || সংখ্যা (’০০০) || শতকরা || সংখ্যা (’০০০) || শতকরা
| সংখ্যা (’০০০) || শতকরা  || সংখ্যা (’০০০) || শতকরা || সংখ্যা (’০০০) || শতকরা
৪৫ নং লাইন: ৪৫ নং লাইন:
|-
|-
| মোট  || ২৫০৩৪  || ১০০.০  || ৫৭২৮  || ১০০.০  || ১৯৩০৬  || ১০০.০
| মোট  || ২৫০৩৪  || ১০০.০  || ৫৭২৮  || ১০০.০  || ১৯৩০৬  || ১০০.০
 
|}
''সূত্র''  জনসংখ্যা সমীক্ষা ২০০১, সংখ্যা ৩, আরবান এরিয়া রিপোর্ট (বিবিএস, ২০০৮) ।
''সূত্র''  জনসংখ্যা সমীক্ষা ২০০১, সংখ্যা ৩, আরবান এরিয়া রিপোর্ট (বিবিএস, ২০০৮) ।



১০:০০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

গৃহায়ন  বলতে মানুষের বসবাসের জন্য নানা সুবিধাদি সম্বলিত বাস্ত্তভূমির উন্নয়নকে বোঝানো হয়। জাতিসংঘের গৃহায়ন নীতিমালা অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য গৃহায়ন ধারনাটি শুধুমাত্র বাসস্থানের ভৌত কাঠামোকে বোঝায় না, একই সাথে সকল ধরনের প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবারও উপস্থিতি আবশ্যক। বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে মানব বসতি বা আবাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়। তখন থেকে পরিবেশ, অর্থ ও সামাজিক চাহিদা এবং এর সাথে ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ুগত বিষয়াবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গৃহের শৈলী ও ধরণ পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগেরও বেশি মানুষ ৮০ হাজার গ্রামে বসবাস করে এবং বাকিরা প্রায় ৫২৫ টি ছোট-বড় শহরে বাস করে এবং যার মধ্যে ঢাকার মত সুবিশাল মেগাসিটিও রয়েছে। তাই বাংলদেশের গৃহায়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে গ্রামীণ ও নগর, দুটি ভৌগোলিক অবস্থাই বিবেচনা করা আবশ্যক।

পল্লী গৃহ [সৌজন্যে: আমানুল হক]

গৃহের ধরণ বাংলাদেশে গ্রামীণ ও শহুরে দু’ধরনের গৃহ রয়েছে। গ্রামীণ বসত বাটী বা বাড়ির একটি উপাদান গৃহ এবং এর অন্যান্য উপাদানগুলি হচ্ছে উঠান (বা আঙ্গিনা), গৃহের চারপাশের গাছপালা ও একটি বা দুটি পুকুর। গ্রামীণ বসতি আবার একটি গ্রামের অংশ যেখানে বসতির বিন্যাস কখনো রৈখিক বা পুঞ্জীভূত। সাংস্কৃতিক ভূগোলবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রধানত সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের গ্রামীণ গৃহগুলিকে শ্রেণি বিন্যাস করেছেন। তাঁর মতে গ্রামীণগৃহের ধরণগুলি হলাে:

চৌশালা গৃহ যেখানে উঠান/ আঙ্গিনাকে কেন্দ্র করে চারপাশে চারটি গৃহ বা ভিটা থাকে, বৃতি গৃহ যা সম্পূর্ণভাবে বাঁশ, মাটি অথবা অন্যকোন উপাদানের তৈরি ও দেয়াল দিয়ে ঘেরা থাকে। আটটি ছাঁদ বিশিষ্ট আটচালা গৃহ যার চারটি ঘরের চাল মূল কাঠামোর উপর এবং বাকি চারটি ঘরের সাথে সংযুক্ত বারান্দার উপরে থাকে। পোস্তা গৃহ যা উঁচু ভিটার উপর তৈরি, অনেক সময় ধনী পরিবারের ক্ষেত্রে ভিটাটি পাকা হতে দেখা যায়; দিশালা নন্দ গৃহ যেখানে আঙ্গিনার দু’পাশে দুটি ঘর থাকে। সুস্থিতা বা সুষম ঘর যার চারপাশে বারান্দা থাকে; এবং উপজাতি বা আদিবাসী গৃহ। চৌশালা গৃহ বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় দেখা যায় এবং শহর এলাকাতেও এ ধরনের গৃহের জনপ্রিয়তা দেখা যায়। বর্তমান সময়ে বৃতি, আটচালা, দ্বিশালা, সুস্থিতা এবং পোস্তা গৃহগুলি খুব একটা দেখা যায় না। বৃতি গৃহ শুধুমাত্র উত্তর দিনাজপুর, আটচালা সাতক্ষীরা, দ্বিশালা সিলেট, সুস্থিতা শীতাকুন্ডু ও পোস্তা মিরসরাই অঞ্চলে দেখা যায়। আদিবাসী গৃহগুলি প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকাসহ কয়েকটি জেলায় দেখা যায় যেখানে আদিবাসীরা বাস করে। তাদের গৃহগুলির গঠন ও ব্যবহারের দিক থেকে স্বতন্ত্র এবং প্রধানত কাঠ ও বাঁশের তৈরি, অনেক সময় উচুঁ মঞ্চ/প্লাটফর্মের উপরে থাকে। সাঁওতালরা বাংলাদেশের আদিবাশি, তাদের ঘরগুলিকে মূলত আদিবাসী গৃহ বলা হয় যা কাদা মাটির তৈরি। বর্তমানে গ্রামীণ এলাকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় গৃহের ধরণ হচ্ছে দোচালা ঘর যার ছাদে দুটি টিনের ঢালু চালা থাকে এবং দেয়াল সাধারণত বাঁশের তৈরি। এছাড়া সম্পূর্ণ টিনের তৈরি দোচালা, চৌচালা এবং আধাপাকা ঘরও উল্লেখযোগ্য পরিমানে লক্ষণীয়।

অতি প্রাচীনকাল থেকে রাজা, মহারাজা, জমিদার এবং বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ শহর উন্নয়নের মাধ্যমে নগর আবাসনের সূচনা ঘটান। উপনিবেশিক কাল থেকেই উচ্চবিত্ত বাঙ্গালিদের মধ্যে নগরে বসবাসের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় স্থাপত্য নকশার অনুকরণে গৃহায়ন নির্মাণ উচ্চবিত্তের জন্য ফ্যাশনে পরিণত হয়। সরকারি এবং বেসরকারি খাতে পাকিস্তান আমলে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের আবাসনের জন্য আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। সরকার বৃহৎ এলাকাজুড়ে ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা এবং নতুন উপশহর তৈরি করেন। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য অধিক ঘনত্বের একতলা পাকা ‘নিউক্লিয়ার’ বা ছোট গৃহের আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয় যার একটি বড় উদাহরণ ঢাকার মিরপুর। দরিদ্র বসতিতে (বৈধ ও অবৈধ বস্তি) গ্রামীণ গৃহের মত কাঁচা ও আধাপাকা কাঠামো লক্ষণীয়।

আশির দশকে অ্যাপার্টমেন্ট ধরনের বিশেষ আবাসনের সূচনা হয় যেগুলি ছয়তলা থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে লিফ্ট বিশিষ্ট ১০-২০ তলা পর্যন্ত করা হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে বিত্তশালীদের বাড়িগুলি ছিল একতলা বাংলো শ্রেণির, অথবা দুইতলা ‘ডুপ্লেক্স’ এবং মাঝে মাঝে তিনতলা ‘ট্রিপ্লেক্স’ ধরনের। এসব ধরনের বাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। মেঝের আয়তন স্বল্প মূল্যের ইউনিটের ক্ষেত্রে ৩০০ বর্গফুটেরও কম দেখা যায় এবং এটা বিলাসবহুল বাড়ির ক্ষেত্রে আবার ৩০০০ বর্গফুটের অধিকও দেখা যায়।

গৃহায়নের উপাদান মূলত এক ধরনের পণ্য বা বস্ত্ত যা অনেকগুলি উপাদানের সমষ্টিগত অবস্থা। উপাদানসমূহ হলো ভূমি; অবকাঠামো ও উপযোগী সেবাসমূহ (utility); ভবন নির্মাণ উপকরণ; নকশা ও প্রযুক্তি; অর্থায়ন; এবং শ্রমিক, ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগ।

ভূমি  গৃহায়নের মৌলিক ও প্রধান উপকরণ। ভূমির মালিকানাও গৃহায়নের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক যা সরকারি, বেসরকারি/ ব্যক্তি পযার্য়ের অথবা সমবায় ধরনের হতে পারে। বর্তমানে দেশের মোট ভূমির (৩৫ মিলিয়ন একর) আনুমানিক শতকরা ২৭ ভাগ হচেছ অকৃষি ভূমি যা মূলত গৃহায়ন, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়। আবার এই ২৭ ভাগের মাত্র ৩ ভাগ (১.০৬ মিলিয়ন একর) হচ্ছে নগর এলাকায় এবং বাকি অংশটুকু গ্রামীণ এলাকায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে গৃহায়ন ও বসতির প্রয়োজনে বর্তমানে গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় প্রচুর কৃষি ভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে।

গ্রামীণ এলাকায় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ভূমির উপর গৃহ তৈরি হয়। অবশ্য ১৫% গ্রামীণ পরিবার যারা ভূমিহীন, তাদের ঘর নির্মাণেরও জায়গা নেই, তারা অন্যের ভূমির উপর আবাস নির্মাণ করে। গ্রামীণ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা খুব অল্প জায়গার উপর গৃহ নির্মাণ করে যার আয়তন অনেক ক্ষেত্রে মাত্র ৩৬০ বর্গফুট (আধা কাঠা), মধ্যবিত্তরা ২ থেকে ১০ কাঠা জায়গায় এবং ধনীরা আরো বৃহৎ আকারের জমিতে বাড়ি নির্মাণ করে।

অতি সম্প্রতি নগরে বসবাসরত পরিবারের উপর একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বড় শহরগুলিতে বস্তিতে বসবাসকারী ৮৩% পরিবার এবং বস্তিবাসী নয় এমন ৭৩% পরিবারের নিজস্ব কোন জমি নেই। দ্বিতীয় পর্যায়ের নগর ও শহরগুলিতে  দেখা যায় যে, দুই তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের নিজস্ব জমিতে বাড়ি নির্মাণ করেছে।

ভূমির মূল্য আবাসনের অন্যতম একটি নিয়ামক এবং ভূমির  মূল্য প্রায় সকল শহরে অতি দ্রূত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে ভূমির মূল্যের বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক বেশি। বিশ্বের অধিকাংশ শহরের তুলনায় ঢাকার আবাসিক ভূমির মূল্য বেশি, যেমন ঢাকার গুলশানে প্রতি কাঠা জমির মূল্য ৫০ মিলিয়ন টাকা (৭০,০০০ টাকা প্রতি বর্গফুট অথবা প্রতি বর্গমিটার ৯০০০ ডলারেরও অধিক)। ঢাকায় ভূমির মূল্য মোট অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যের ৫০-৯০%।

অবকাঠামো ও উপযোগী সেবাসমূহ গৃহায়ন ধারনাটি নিছক একটি বাড়ি বা গৃহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে ভৌত ও সামাজিক পরিবেশগত উপাদানগুলোও বিবেচ্য। এছাড়াও সঠিক এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত উপাদানসমূহ যেমন রাস্তা, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, স্যানিটেশন, আবর্জনা নিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ অন্যান্য সামাজিক সেবাসমূহও এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত। গ্রামীণ এলাকায় ৯০ ভাগেরও বেশি পরিবারের নিরাপদ পানির উৎস হচেছ টিউবওয়েল। মেট্রোপলিটন শহরগুলিতে বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারসমূহের মধ্যে ২৬% এবং বস্তি নয় এমন বসতিতে বসবাসকারী পরিবারসমূহের ৬০% পরিবার পাইপের পানি ব্যবহার করে। ছোট এবং মাঝারি শহরগুলিতে এখনো টিউবওয়েল হচেছ নিরাপদ পানির প্রধান উৎস।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে স্যানিটেশন ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলেও এখনো নগর এলাকায় ৫৬% পরিবার এবং গ্রামীণ এলাকার মাত্র ১৫% পরিবার আদর্শ স্যানিটারি সুবিধা (যেমন সুয়্যার-সংযুক্ত টয়লেট, সেপটিক ট্যাংক এবং ওয়াটার সিল্ড টয়লেট) পাচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের একটি হিসেব অনুযায়ী মাত্র দুই তৃতীয়াংশ শহুরে পরিবার এবং শতকরা দশভাগেরও কম গ্রামীণ পরিবার বিদ্যুৎ সেবার আওতাধীন। অতি সম্প্রতি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সামান্য উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে।

ভবন নির্মাণ উপাদান  ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী হয়ে থাকে। নির্মাণ উপকরণের ভিত্তিতে গৃহকে চার শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়; ক) ঝুপড়ি,  সাধারণত পাটখড়ি, খড়, বাঁশ দিয়ে তৈরি; খ) কাঁচা (অস্থায়ী), কাঁদা-মাটি, বাঁশ, ছন, কাঠ ও কোন কোন সময় ছাদ টিনের তৈরি; গ) আধা পাকা (মধ্যম স্থায়ী), যেখানে দেয়াল মূলত টিনের, মেঝে সিমেন্টের পাকা এবং ছাদ টিনের; ঘ) পাকা (স্থায়ী, কমপক্ষে ২৫ বছর স্থায়ীকাল), দেয়াল ও ছাদ দুটোই পাকা বা সিমেন্টের তৈরি। এই চার ধরনের গৃহগুলি আবার স্থায়িত্বের ভিত্তিতে শ্রেণি বিভাগ করা যায়। ঝুপড়ি এবং কাঁচা গৃহগুলি অস্থায়ী, আধাপাকাগুলি মধ্যম স্থায়ী এবং পাকা গৃহ স্থায়ী। গ্রামীণ এলাকায় কাঁচা গৃহ এবং শহর এলাকায় পাকা ও আধাপাকা গৃহের আধিক্য দেখা যায়।

সারণি ১ বাংলাদেশে নির্মাণ উপকরণভিত্তিক গৃহ ধরণ, ২০০১ ।

গৃহ ধরণ মোট নগুরে গ্রামীণ
সংখ্যা (’০০০) শতকরা সংখ্যা (’০০০) শতকরা সংখ্যা (’০০০) শতকরা
ঝুপড়ি ২২০২ ৮.৮ ৪৩৪ ৭.৬ ১৭৬৮ ৯.২
কাঁচা ১৮৬২৫ ৭৪.৪ ২৭৩২ ৪৭.৭ ১৫৮৯৩ ৮২.৩
আধা-পাকা ২৫৩৫ ১০.১ ১৩২১ ২৩.১ ১২১৪ ৬.৩
পাকা ১৬৭২ ৬.৭ ১২৪১ ২১.৭ ৪৩১ ২.২
মোট ২৫০৩৪ ১০০.০ ৫৭২৮ ১০০.০ ১৯৩০৬ ১০০.০

সূত্র জনসংখ্যা সমীক্ষা ২০০১, সংখ্যা ৩, আরবান এরিয়া রিপোর্ট (বিবিএস, ২০০৮) ।

গৃহায়ন সমস্যা নির্মাণ উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতার সাথে বিশেষভাবে জড়িত। কাঠ, বাঁশ, পাতা জাতীয় প্রথাগত উপকরণগুলি ধীরে ধীরে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। আরেকটি সাধারণ উপকরণ হচেছ কাঁদা-মাটি, যদিও এটি এখনো সহজলভ্য, তবে এর সংগ্রহ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। অধিকমত্ত কাঁদা-মাটি সব এলাকার জন্য উপযুক্তও নয়। গ্রামীণ এলাকায় টেকসই গৃহগুলি মূলত কাঠ ও সি আই শিট দিয়ে তৈরি। গ্রামীণ এলাকায় যারা সম্পদশালী তাদের ঘরগুলি সাধারণত পাকা।

শহর অঞ্চলে গরিবদের জন্য গৃহ নির্মাণে সাধারণত বাঁশ, বস্তা, খড়, পলিথিন শিট ইত্যাদি ব্যবহূত হয় (বস্তিবাসীদের ৯০% ঘর স্রক্যাপ উপকরণ দিয়ে তৈরি)। মধ্যম আয়ের এবং উচ্চবিত্তরা আরো টেকসই উপকরণ বাছাই করে। বনভিত্তিক নির্মাণ উপকরণগুলির প্রতিস্থাপন এবং আরো অধিক পরিমাণ উপকরণ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এসব উপকরণ বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে এবং অবশ্যই যেন টেকসই হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্যোগ প্রতিরোধের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।

ভবনের নকশা এবং প্রযুক্তি গৃহায়নের  অন্যতম উপাদান যা মানুষের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা  প্রকাশ করে। সম্প্রতি গৃহ বা ভবনের নকশা ও প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন এবং উন্নতি ঘটেছে। এমনকি গ্রামীণ গৃহেও এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়, সেখানে শহুরে নকশায় দ্বিতল বা ত্রিতল বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করতে দেখা যাচ্ছে।

নকশা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে নগর আবাসনে বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এ ধরনের ভবনে ব্যবহূত নতুন উপাদান লিফ্ট ,স্টীল, অ্যালুমিনিয়াম এবং কাঁচ। এসবের ব্যবহারের কারণে নতুন প্রযুক্তির গুরুত্ব বেড়েছে। এর সাথে নতুন প্রযুক্তি হিসাবে যোগ হয়েছে প্রি-ফেব্রিকেশনের। নতুন ভবনগুলির বেশির ভাগ ভূমিকম্পসহনশীল নয়। তবে বর্তমানে নতুন ভবন নির্মাণে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হচ্ছে।

গৃহায়ন অর্থায়ন গৃহায়নের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভূমি ক্রয় গৃহনির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ যার জন্য অর্থ প্রয়োজন। তাছাড়া ভূমি যদি পূর্ব থেকেই গৃহ নির্মাতার সংগ্রহে থাকে তখন ভবন নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় এবং উপযোগী সেবা সমূহের জন্যেও অর্থায়ন প্রয়োজন। আবাসনের জন্য অর্থায়ন বিভিন্ন উপায়ে হয়ে থাকে, যেমনঃ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সঞ্চয়; বৈদেশিক আয় বা রেমিটেন্স; সম্পত্তি বিক্রয়, যেমন- জমি বিক্রয়; জমির মালিক ও রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থা; বন্ধু বা আত্নীয়দের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ; ব্যাংক বা বন্ধকী সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ; এবং নিয়োগকর্তা বা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ।

বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন লিমিটেড (বিএইচবিএফসিএল) এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সরকারি ও বেসকারি ব্যাংকসমূহ গৃহ নির্মাণের জন্য ঋণ প্রদান করে। বেসরকারি অংশীদারি ব্যাংক, ডেল্টা ব্রাক হাউজিং (ডিবিএইচ) শুধুমাত্র নগরবাসীদের জন্য গৃহায়ন ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংক ছাড়াও বন্ধকী বা বীমা কোম্পানিগুলিও তাদের নিজেদের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ঋণ দিয়ে থাকে। গ্রামীণ এলাকায় প্রধানত ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়ে এখন ঋণ দেওয়া হয়। বৈদেশিক আয় বা রেমিটেন্স আবাসনের অর্থায়নের অন্যতম একটি উৎস। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আবাসনের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ পায়। এছাড়াও ব্রাক, আশা ও অন্যান্য এনজিও ঋণ প্রদান করে। কিন্তু এসব ঋণগুলি শর্তসাপেক্ষ হয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতাকে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সদস্য এবং নিজস্ব সঞ্চয় থাকতে হয়।

সরকার ও এনজিওর মাধ্যমে দাতাগোষ্ঠী গ্রামীণ ও শহুরে ভূমিহীনদের আবাসনের জন্য ঋণ প্রদান করে। এই ঋণ কার্যক্রমের আওতায় এখন প্রাকৃতিক দুর্যাগের কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্ত্তদেরকেও আনা হয়েছে।

ব্যাংকের ধরণ (যেমন- সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক) অনুযায়ী সুদের হার ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং একই সাথে ঋণের পরিমাণেরও তারতম্য ঘটে। শহর এলাকায় ঋণের হার ১৪.৫%-১৬.৫% এবং গ্রামীণ এলাকায় এনজিও দরিদ্রদের জন্য ২%-৫% হারে ঋণ দিয়ে থাকে।

বিএইচবিএফসিএল ব্যক্তি পর্যায়ে একটি বাড়ির বা গৃহের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা এবং একটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান করে। বেসরকারি ব্যাংক জমির অবস্থান এবং ঋণগ্রহীতার অতীত লেনদেন পর্যালোচনার মাধ্যমে আরো অনেক বেশি পরিমাণ ঋণ প্রদান করে থাকে এবং অনেক সময় এটা এক কোটি টাকার উপরেও হয়ে থাকে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যে জমি বা অ্যাপার্টমেন্টের জন্য ঋণ প্রদান করে, সে সম্পত্তিকে বন্ধক রেখে ঋণ প্রদান করে থাকে। বাড়ির নির্মাণ ব্যয় প্রধানত বাড়ির নকশা শৈলী, উপকরণ এবং গুণগত মানের উপর নির্ভর করে। যেমনঃ বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের জন্য প্রতি বর্গফুট দশ হাজার টাকা, মাঝারি মূল্যের গড়পরতা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, স্বল্প মূলের পাকা বাড়ির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট এক হাজার টাকা। আধাপাকা ঘরের ক্ষেত্রে এ খরচ ন্যূনতম পাঁচ শত টাকা।

শ্রম, ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোক্তা গ্রামীণ কিংবা শহুরে উভয় এলাকাতেই ঐতিহ্যগতভাবে বাড়ি নির্মিত হয়েছে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে। গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র বাড়ি-ঘর মূলত স্ব-নির্মিত এবং স্থানীয় শ্রমিক এবং মাঝে মাঝে ভাড়া করা কারিগরের সহযোগিতায় করা হয়। শহুরে গরিবদের ঘর হয়তো স্ব-নির্মিত অথবা স্বল্প খরচে ভাড়া করা শ্রমিকের সহায়তায় করা হয়। শহর অঞ্চলে অদক্ষ শ্রমিকের আধিক্য থাকলেও এদের বেশির ভাগই অভিগমনকারী দরিদ্র মহিলা। গৃহায়ন শিল্পে দক্ষ নির্মাণ কর্মী, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থাপনা সেবার তীব্র সংকট রয়েছে। নতুন গৃহায়ন এবং পুরাতন ভবনের পুনঃনির্মান মূলত প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ মানবসম্পদ, যেমন স্থপতি, প্রকৌশলী, ব্যবস্থাপনা কার্যনির্বাহী এবং বিক্রয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে। গত তিনদশক ধরে বিশেষ করে আধুনিক গৃহায়ন শিল্পের উত্থান ও সমৃদ্ধির জন্য এসব পেশাদার ব্যক্তিদের মূল্যায়ণ হচ্ছে। আবাসনের মানের গুণগত উন্নয়নের জন্য অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

গৃহায়নে সরকারের ভূমিকা সরকার গৃহায়ন প্রক্রিয়ায় যেসব উপায়ে অবদান রাখতে পারে তাহলো, সব আয়ের সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহ ও ফ্ল্যাট নির্মাণ; উচ্চ ও মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য গৃহায়ন ও সেবা প্রকল্প প্রণয়ন; স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য গৃহায়ন নির্মাণ; গ্রামীণ এলাকায় গুচ্ছগ্রাম উন্নয়ন; এবং যাদের জমি আছে তাদের সবার জন্য হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে সহজ সর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।

যদিও গৃহায়ন জনগণের মৌলিক অধিকার তথাপিও সরকার শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যাক মানুষদের জন্য এর ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। গৃহায়ন উন্নয়নে সরকারের অবদান চাহিদা অনুযায়ী অপ্রতুল। সরকারি প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগ (পিডব্লিউডি) এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (এনএইচএ) গৃহায়নের সাথে জড়িত। এর সাথে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসমূহ যেমন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) ও সিটি কর্পোরেশনসমূহসহ আরো কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গৃহায়ন প্রকল্প রয়েছে। মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) গৃহায়ন শিল্পের অবদান প্রায় শতকরা দশভাগ। [নজরুল ইসলাম ও সালমা এ শফি]

গ্রন্থপঞ্জি Nazrul Islam, Human Settlements and Urban Development in Bangladesh, University of Dhaka, Dhaka, 1997; Nazrul Islam, ‘Housing in Bangladesh’, in Journal of the Bangladesh Institute of Planners, Vol. 1, No. 1, 1990; Sirajul Islam Chowdhury,  Arthonitik Bhugol: Biswa O Bangladesh, University of Dhaka, Dhaka, 1988; National Institute Of Population Research And Training (NIPORT) and others, Bangladesh Urban Health Survey 2006, Dhaka, 2006; Bangladesh Bureau of Statistics, Population Census-2001, National Series, Volume-3, Urban Area Report, Dhaka, 2008.