সিভিল সার্ভিস
সিভিল সার্ভিস ভারতের ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল প্রতিষ্ঠান ছিল সিভিল সার্ভিস। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস ছিল দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সরকারের ফসল। কিন্তু ভারতীয় সিভিল সার্ভিস তা ছিল না। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৭৬৫-১৮৫৮) এবং পরে ব্রিটিশ রাজের (১৮৫৮-১৯৪৭) উপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার প্রয়োজন ও পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে। ১৭৮৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূখন্ডগত মালিকানা প্রধানত ‘সুপারভাইজার’ নামে অভিহিত কোম্পানির স্থানীয় বাণিজ্যিক অফিসারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশীয় সংস্থাগুলোর দ্বারা পরিচালিত হতো। কোম্পানির সিভিল সার্ভেন্টদের বলা হতো কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভেন্ট। কোম্পানির শাসনের অবসান পর্যন্ত এবং তারপরও দীর্ঘদিন এ পদবিটি চালু ছিল। এ সার্ভিসের সদস্যরা ভারতে চাকরির জন্য ভারত সচিবের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হতেন বিধায় এ চাকরির নাম হয়েছিল কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিস (সিসিএস)।
সূচনা বঙ্গদেশে উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিষয়াবলি ব্রিটিশ রাজের সনদে নির্দেশিত শর্তাবলি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হতো। সনদের অধীনে কোম্পানি ‘পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে’ স্বীয় কর্মচারীদের উপর ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করত। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম, বধর্মান ও মেদিনীপুরে ভূখন্ডগত অধিকার লাভ এবং পরবর্তীকালে ১৭৬৫ সালে সুবাহ বাংলার উপর দেওয়ানি অধিকার লাভের ফলে ভূখন্ডগত অধিগ্রহণ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো এক ধরনের বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামো গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বঙ্গদেশে ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্সি কাউন্সিলের সভাপতি রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানি বিষয়ে বঙ্গদেশে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হয়ে দাঁড়ান। দেওয়ানি প্রশাসন পরিচালনার জন্য তিনি প্রাথমিক পর্যায়ের সিভিল সার্ভিস চালু করেন। এ সিভিল সার্ভিসের প্রধান ছিলেন চার সদস্যের একটি বাছাই কমিটির সভাপতি জন কার্টিয়ার। দেশীয় রাজস্ব সংগ্রাহকদের কাজকর্ম তদারকির জন্য জেলা পর্যায়ে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় সুপারভাইজার নিয়োগ করা হয়। দেশীয় নায়েব দেওয়ান সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খানের অনুষঙ্গ বা সহযোগী শক্তি হিসাবেই কেবল এ অস্থায়ী বা সাময়িক সিভিল সার্ভিস গঠন করা হয়। সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খানের নেতৃত্বাধীন দেশীয় সংস্থাগুলোই মূলতঃ কোম্পানির দেওয়ানি প্রশাসন দেখাশোনা করত। এ দেওয়ানি প্রশাসনকে সাধারণভাবে বলা হতো ডায়ার্কি (দ্বৈতশাসন)। নায়েব দেওয়ান ও কোম্পানির মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির ভিত্তিতেই প্রারম্ভিক পর্যায়ের সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন ক্লাইভ। এ ডায়ার্কি বা দ্বৈত শাসনের ফল হয়েছিল বিপর্যয়কর। এর পরিণতিতে ১৭৬৮-৬৯ সালের মহা মন্বন্তর সৃষ্টি হয়।
১৭৭২ সালে ডায়ার্কি বা দ্বৈতশাসনের অবসান হয়। এরপর বঙ্গদেশকে ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট বলে কোম্পানির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের ফোর্ট উইলিয়ম ও কাউন্সিলের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত ওয়ারেন হোস্টিংস রেগুলেটিং অ্যাক্ট বলে প্রতিষ্ঠিত নয়া আমলাতন্ত্রের প্রধান হয়ে দাঁড়ান। কাউন্সিল নামে অভিহিত চার সদস্যের একটি কমিটি তাকে পরামর্শ ও সহায়তা দিতেন। রেগুলেটিং অ্যাক্ট বলে বঙ্গদেশের জন্য গঠিত ক্ষুদ্র আমলাতন্ত্রিক কাঠামোর শীর্ষে ছিল এ কাউন্সিল। ক্ষমতার স্তর বিন্যাসে এ কাউন্সিলের পরেই ছিল রাজস্ব আদায়কারী দেশীয় জেলা কালেক্টর, যাদের বলা হতো দেওয়ান। তখনও নওয়াবি প্রতিষ্ঠানই বিচারবিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগ করত। দেওয়ানদের কাজকর্ম তদারককারী ইউরোপীয় জেলা সুপারভাইজারদের নামমাত্র বেতন দেওয়া হতো। সেটা পুষিয়ে দেয়ার জন্য তাদের ঘরোয়াভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমদিকের উপনিবেশিক রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিস ছিল একদিকে রাজস্ব আদায় এবং অন্যদিকে যুগপৎ ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা। নবগঠিত সিভিল সার্ভিস ছিল এমন এক ব্যবস্থা যার শীর্ষভাগে ছিলেন ইউরোপীয়রা এবং নিম্নস্তরে ছিলেন দেশীয়রা। সকল দেওয়ান বা স্থানীয় পর্যায়ের রাজস্ব প্রশাসকরা ছিলেন দেশীয়। ওয়ারেন হোস্টিংসের প্রশাসনিক ধারণাটির উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানি-রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিসে দেশীয় লোকদের সম্পৃক্ত করা। তিনি ফৌজদারি প্রশাসনের জন্য সদর নিযামত আদালত গঠন করেন এবং সে আদালত পরিচালনার সুযোগ দেন মূলত দেশীয় বিচারকদের। সদর দেওয়ানি আদালতও প্রধানত দেশীয় বিচারকদের বিশেষ করে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হতো। সংক্ষেপে বলতে গেলে বঙ্গদেশে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের জন্য সিভিল সার্ভিস উদ্ভাবন করতে গিয়ে হেস্টিংস একে ইউরোপীয় ও দেশীয়দের সমন্বিত একটি ব্যবস্থায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
সর্ব-শ্বেতাঙ্গদের সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন ১৭৯০ সাল নাগাদ এটি দৃশ্যমান হয়ে উঠে যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখন আর পূর্বাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের বাণিজ্যিক সংগঠন মাত্রই নয়, বরং সাম্প্রতিককালে উত্তর আমেরিকা ব্রিটেনের হাতছাড়া হওয়ার পর বাস্তবে এটা ব্রিটেনের নবঅর্জিত বিকল্প সাম্রাজ্যেও পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট হস্তক্ষেপ করে বসে এবং ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবঅর্জিত ভূখন্ডের উপর আপন অধিকার জাহির করে। ১৭৮৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয় যা সাধারণভাবে পিট্স ইন্ডিয়া অ্যাক্ট নামে অভিহিত। আইনে নতুন সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্দেশ করে কাউন্সিলের গভর্নর-জেনারেল হিসেবে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত অথচ জনপ্রিয় জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসকে নিয়োগ করা হয়। আইনে ভারতের বিষয়াবলির জন্য একটি বোর্ড অব কমিশনার গঠন করা হয় যা সচরাচর বোর্ড অব কন্ট্রোল হিসেবে পরিচিত। এতে থাকতেন রাজা কর্তৃক নিযুক্ত কন্ট্রোলার অব এক্সচেকার, একজন সেক্রেটারী অব স্টেট এবং চারজন প্রিভি কাউন্সিলর।
গভর্নর-জেনারেলের তিনজন কাউন্সিলর থাকতেন। তাদের একজন হতেন কমান্ডার-ইন-চীফ। এদের সবাই এখন কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে পরিচিত হতে লাগলেন। এই অফিসারদের সবাইকে নিয়োগ দিত কোর্ট অফ ডিরেক্টর্স। কোর্ট অফ কন্ট্রোলের পরামর্শে লর্ড কর্নওয়ালিস বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করেন এবং দায়িত্বশীল কাজ থেকে দেশীয় লোকজনকে উচ্ছেদ করে ইংরেজ কালেক্টরদের বসান। জেলা কালেক্টর ও জেলা জজদের সবাইকে কোম্পানির কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিনিয়র কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভেন্টদের নিয়ে গঠিত রেভেনিউ বোর্ডের কাছে জেলা কালেক্টরদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা হয়। জমিদারদের ঐতিহ্যবাহী পুলিশী ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। প্রতিটি জেলাকে রাজস্ব আদায়সহ সাধারণ প্রশাসনের জন্য একজন কালেক্টরের অধীনে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একজন পুলিশ সুপারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। জেলা জজ, জেলা কালেক্টর ও জেলা পুলিশ সুপার স্থানীয় পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসনে এক একটি স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায় এবং সর্বশীর্ষে থাকে রেভেনিউ বোর্ড। দেওয়ানি আদালত ও নিযামত আদালতকে শাসন ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষে পরিণত করা হয়। কাউন্সিলে গভর্নর জেনারেল ভারতীয় সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষে পরিণত হন। কাজকর্মে সুনামের অধিকারী কালেক্টরদের মধ্য থেকে বিচার বিভাগীয় অফিসারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এদেরকে পদমর্যাদার দিক দিয়ে প্রশাসনিক ক্যাডারদের উপরে স্থান দেওয়া হয় এবং বেতনও দেওয়া হয় বেশি। প্রশাসনে দেশীয় লোকজনকে সর্বনিম্ন ধাপে নামিয়ে দেয়া হয়। তাদের নামমাত্র বেতন দেওয়া হতো। সরকারি দায়িত্ব বলে কিছু ছিল না।
কর্নওয়ালিস কোডের অধীনে পুনর্গঠিত সিভিল সার্ভিসকে বলা হতো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিস। নবগঠিত কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয় বরং কোর্ট অব ডিরেক্টরদের এক একজন সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে নিয়োগ করা হতো। বঙ্গদেশে কোম্পানির সিভিল সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ডিরেক্টরের ক্যাডেট কোটার বিধিবদ্ধ সুবিধা ছিল। সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষানবিশী পর্যায় সম্পন্ন করার পর ক্যাডেটদের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কালেক্টর হিসেবে ও অন্যান্য নির্বাহী পদে নিয়োগ করা হতো।
সিভিল সার্ভিসের ভারতীয় করণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৩ সালে তার একচেটিয়া অধিকার আংশিকভাবে এবং ১৮৩৩ সালে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। ১৮৩৩ সালের আইনবলে কোম্পানি রাজা বা রানীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় একটি সংস্থায় পর্যবসিত হয়। এ আইনে নয়া উদারপন্থী পার্লামেন্ট কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসে (সিসিএস) চাকরি ও সার্ভিস প্রদানের আদলে দেশীয়দের ক্ষমতার ভাগ দেয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ১৮৫৩ সালের শেষ চার্টার অ্যাক্টের আগ পর্যন্ত কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসের দ্বার ভারতীয়দের জন্য বন্ধ ছিল। ১৮৫৩ সালের ওই চার্টার অ্যাক্ট বলে সিভিল সার্ভিসে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রিক্রুটমেন্টের ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়। তখন থেকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে সিসিএস-এ লোক নিয়োগের ব্যবস্থা চালু হয়ে যায়। ১৮৬১ সালের আইনবলে কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসের নতুন নামকরণ হয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস)। তবে আইসিএস-এ ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ব্যাপারটা মোটামুটি অসম্ভবই থেকে যায়। কারণ ভারতীয়দের লন্ডনে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হতো, আর সেটাও করতে হতো অত্যন্ত কম বয়সে এবং তাদের ইংল্যান্ডে দু’বছর শিক্ষানবিশ হিসেবে থাকতে হতো। আইসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য ইংল্যান্ড যাওয়া বিপুল খরচের ব্যাপারই শুধু ছিল না, সমুদ্র পাড়ি দেয়ার বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিধিনিষেধেরও সম্মুখীন হতে হতো। মুসলমানরা তখনও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে নি বলে তারা আইসিএস পরীক্ষা দিতে পারত না। ১৮৬৩ সালের আগ পর্যন্ত কোনো ভারতীয় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হতে পারে নি। সে বছর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম ভারতীয় হিসেবে আইসিএস সদস্য হন। একজন দু’জন করে ভারতীয়দের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হবার এ ধারাটি বিশ শতকের বিশের দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর আইসিএস পরীক্ষা যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় এবং আগের তুলনায় আরও বেশি সংখ্যক ভারতীয়কে সিভিল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার নীতি গ্রহণ করা হয়।
সিভিল সার্ভিসে অধিক সংখ্যক ভারতীয়ের যোগদানের সুবিধার্থে গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড লীটন (১৮৭৬-১৮৮০) ১৮৭৯ সালে একটি বিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যবস্থায় যেসব পদ আগে কভেন্যান্টেড সিভিল সার্ভিসের অধীনে ছিল তার এক-ষষ্ঠাংশ পদ প্রাদেশিক সরকারগুলোর মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা পূরণের বিধান রাখা হয়। এ নতুন চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অবশ্য কুলীন বংশীয় লোক হতে হতো। এটি ছিল একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যার উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় এলিট শ্রেণীর লোকদের ক্ষমতার ভাগ দেওয়া। কিন্তু এ ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায় নি। কারণ কুলীন বংশীয় প্রার্থীরা শিক্ষা দীক্ষায় উন্নত ছিল এমনটা কদাচিতই লক্ষ্য করা যেত। পরবর্তীকালে সিদ্ধান্ত হয় যে, কুলীন বংশীয় লোকদের সুবিধামত অধস্তন চাকরিতে বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসের বিচার বিভাগীয় শাখায় নিয়োগ দেওয়া যাবে।
ভারতে আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং সিভিল সার্ভিসে আরোও বেশি সংখ্যায় ভারতীয়দের অংশগ্রহণের ক্রমবর্ধমান দাবির প্রেক্ষাপটে একটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা সরকারি কর্মকমিশন গঠন করা হয়। স্যার সি. আইচিসনকে কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। সিনিয়র আইসিএস সদস্য ও পাঞ্জাবের প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর আইচিসন একটি পরিকল্পনা উদ্ভাবন করেন যা ১৮৮৯ সালে চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত এবং ১৮৯১ সালে বাস্তবায়িত হয়। নয়া পরিকল্পনায় সংবিধিবদ্ধ সিভিল সার্ভিস বিলুপ্ত করা হয়। সরকারের বেসামরিক অফিসারদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, ইম্পিরিয়াল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, প্রভিন্সিয়াল সিভিল সার্ভিস ও সাবোর্ডিনেট সিভিল সার্ভিস। প্রথমটির ক্ষেত্রে রিক্রুটমেন্টের ব্যবস্থা আগের মতো ইংল্যান্ডেই রাখা হয়। তবে বলা হয় যে, যেসব ভারতীয় ইংল্যান্ডে গিয়ে লন্ডনে পরীক্ষা দিতে পারবে তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া যাবে। অপর দুই সার্ভিসের ক্ষেত্রে রিক্রুটমেন্টের ব্যবস্থা ভারতেই করা হয় এবং অধিকাংশ প্রার্থীকে ভারতীয়দের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রাদেশিক পাবলিক সার্ভিসের জন্য লোক নিয়োগ তিনটি পদ্ধতিতে করা হতো, পরীক্ষার মাধ্যমে, মনোনয়নের মাধ্যমে এবং অধস্তন চাকরি থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে। ১৮৯৩ সালে কমন্সসভা সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাগুলো যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠানের একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হবার আগ পর্যন্ত প্রস্তাবটি কেবলমাত্র সাধু অভিলাষ হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। এ পরিকল্পনায় ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের নিচে প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস গঠন করা হয়, আর প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের অধীনে গঠন করা হয় সাবোর্ডিনেট বা অধঃস্তন সিভিল সার্ভিস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ রাজকীয় শক্তি এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এ যুদ্ধের পরিণতিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শক্তি ও মনোবল ক্ষুণ্ণ হলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও বৈপবিক আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে। এসব কারণে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠান ও অন্যূন তেত্রিশ শতাংশ সিভিল সার্ভেন্ট ভারতীয় প্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ এবং প্রতিবছর তাদের কোটা কমপক্ষে দেড় শতাংশ হারে বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে ইতোপূর্বে পার্লামেন্টে (১৮৯৩) যে প্রস্তাব নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাগুলো ১৯২২ সাল থেকে যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ইম্পিরিয়াল সিভিল সার্ভিস ও প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে সক্ষম হয়। ১৯৩৯ সালের মধ্যে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মোট ১২৯৯ পদের মধ্যে ৫৪০টি (৪১%) পদে ভারতীয়রা নিযুক্ত ছিল। অথচ প্রথম মহাযুদ্ধের আগে এ হার ছিল এক শতাংশের নিচে। প্রাদেশিক সার্ভিসসহ সিভিল সার্ভিসের নিয়মিত প্রতিযোগিতার পাশাপাশি সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলোর মনোনয়নের ভিত্তিতে আরো বেশি সংখ্যায় সিভিল সার্ভিসের সদস্য সংগ্রহ করত। সম্প্রদায়গতভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কার্যত ছিল না বললেই চলে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার ১৯২৫ সালে ভারতীয় ও বঙ্গীয় সিভিল সার্ভিসে কুলীন বংশীয় শিক্ষিত মুসলমানদের মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে খুব সামান্য সংখ্যকই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিল। ১৯৩৪ সাল নাগাদ ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে সাতটি সর্বভারতীয় সার্ভিস ও পাঁচটি কেন্দ্রীয় বিভাগ নিয়ে গঠিত ছিল যার সবগুলোই ছিল সেক্রেটারি অফ স্টেটের নিয়ন্ত্রণে এবং অন্যদিকে তিনটি কেন্দ্রীয় বিভাগ ছিল ইম্পিরিয়াল সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের যৌথ নিয়ন্ত্রণে। ভারত বিভাগের পর, সিভিল সার্ভিসের অংশ বিশেষের নতুন নামকরণ পাকিস্তানের ক্ষেত্রে করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। অপরদিকে ভারতীয় অংশের সার্ভিসের নাম পূর্ববর্তী ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসই বহাল থাকে।
সিভিল সার্ভিস কাঠামোর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারত অচিরেই একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে বহুলাংশে ছাড়িয়ে যায়। ব্রিটিশ ভারতের সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র (আইসিএস) কালক্রমে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রকৃত কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়েছিল এবং পার্লামেন্ট, সেক্রেটারি অফ স্টেট, ভারত কাউন্সিল, গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়ের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিভিল সা©র্ভসের উপর কর্তৃত্বের অধিকারী থাকার ভান করলেও বাস্তবে আমলাতন্ত্রই উপনিবেশিক রাষ্ট্রের সর্বাধিক কার্যকর সংগঠিত শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ হোক কি ভারতীয়ই হোক সবার চোখেই আইসিএস সদস্যরা দৃশ্যত ছিল ‘স্বর্গীয় সন্তান’। এরা ছিল বরাবরই প্রশ্রয়প্রাপ্ত ও সুবিধাভোগী এবং কার্যত সর্বদাই আইনের ঊর্ধ্বে। সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়করণের লক্ষ্যে পার্লামেন্ট ১৮৩৩ সালে আইন পাশ করে। কিন্তু আইসিএস অফিসাররা সে আইনটিকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় করে রাখতে সক্ষম হয়। ১৮৫৩ সালে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসকে ভারতীয়দের কাছে উন্মুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৮৬৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত কোনো ভারতীয় আইসিএস সদস্য হতে পারেন নি। এর প্রধান কারণ ছিল যে, ভারতীয় প্রার্থীদের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার জন্য ইংল্যান্ড যেতে হতো। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আইসিএস পরীক্ষা একই সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ভারতে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ‘স্বর্গীয় সন্তানরা’ ১৯২২ সালের আগ পর্যন্ত সেই ব্যবস্থা চালু করতে দেয় নি। প্রথম মহাযুদ্ধের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতির কারণে সেই ব্যবস্থাটি চালু হয়। গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড রিপন প্রবর্তিত সকল উদারনৈতিক সংস্কার আমলাতন্ত্রের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। [সিরাজুল ইসলাম]
সিভিল সার্ভিস (১৯৪৭ সাল পরবর্তী) ১৯৪৭ পরবর্তী অধ্যায়ে সিভিল সার্ভিসের উন্নয়নের ধারার বড় ধরনের বৈশিষ্ট্য হলো ১৯৪৭ সালের আগে সিভিল সার্ভিসের যে কাঠামো ও কার্যাবলির অস্তিত্ব ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাই পরবর্তী সময়ে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। সার্ভিসগুলো পুনর্গঠনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বহু কমিশন/কমিটি গঠিত হওয়া সত্ত্বেও সেই ঐতিহ্যই চলতে থাকে। বেশিরভাগ গবেষণায় এর কারণ হিসেবে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) ক্যাডারদের প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ ছাড়া অন্যান্য কারণও রয়েছে।
অন্য কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ও শাসনকার্য পরিচালনার প্রারম্ভিক সাংবিধানিক কাঠামোর অভাব, স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীসহ পাঁচটি প্রদেশের অস্তিত্ব, যে কারণে একটি কেন্দ্রীয় সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব লাভ করে এবং বিশেষভাবে যে কথাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো অল-পাকিস্তান সার্ভিস পূর্ববর্তী বছরগুলোর ঐতিহ্যের ধারায় গড়ে উঠেছিল।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি কাঠামো প্রধান দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল: (ক) সাবেক অল পাকিস্তান সার্ভিস, যেমন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি), পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তান (পিএসপি) এবং (খ) সাবেক সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস যার অন্তর্ভুক্ত ছিল পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস (পিএফএস), পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিস, পাকিস্তান মিলিটারি অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিস, পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিস, পাকিস্তান রেলওয়ে একাউন্টস সার্ভিস, পাকিস্তান কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ সার্ভিস, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস (সিএসএস), পাকিস্তান মিলিটারি ল্যান্ড অ্যান্ড ক্যান্টনমেন্ট সার্ভিস, পাকিস্তান পোস্টাল সার্ভিস, সেন্ট্রাল ইনফরমেশন সার্ভিস।
কেন্দ্রীয়ভাবে রিক্রুট করা অন্যান্য চাকরির মধ্যে ছিল সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস, টেলিগ্রাফ ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস এবং জিওলজিক্যাল সার্ভিস ইত্যাদি।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত প্রদেশটিতে প্রাদেশিক পর্যায়ে ২৭টি চাকরি বা ২৭ শ্রেণীর চাকরি ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস) প্রথম শ্রেণী, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএস) দ্বিতীয় শ্রেণী, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (জুডিসিয়াল), ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র পুলিশ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র এডুকেশন সার্ভিস, আসাম এডুকেশনাল সার্ভিস (প্রথম শ্রেণী), আসাম জুনিয়র এডুকেশন সার্ভিস (দ্বিতীয় শ্রেণী), ইস্ট পাকিস্তান এক্সাইজ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র এক্সাইজ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনকাম ট্যাক্স সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র এগ্রিকালচারাল ইনকাম ট্যাক্স সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান হেলথ সার্ভিস (আপার), ইস্ট পাকিস্তান হেলথ সার্ভিস (লোয়ার), ইস্ট পাকিস্তান সিনিয়র সার্ভিস অব ইঞ্জিনিয়ার্স, ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান হায়ার এগ্রিকালচারাল সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান হায়ার লাইভস্টক সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান লাইভস্টক সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান হায়ার ফিশারিজ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান ফিশারিজ সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান সিনিয়র ফরেস্ট সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র ফরেস্ট সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান ফুড এডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস, ইস্ট পাকিস্তান ফুড সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস ইত্যাদি।
সিএসপি ও পিএসপি ছিল অল পাকিস্তান ভিত্তিক চাকরি। তবে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অন্যান্য চাকরিও (সেন্ট্রাল সার্ভিস) ছিল। সেন্ট্রাল সার্ভিস শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে লী কমিশন। এর দ্বারা শুধু সেইসব সার্ভিসকে বুঝানো হতো যেসব সার্ভিসের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার লোক নিয়োগ করত এবং যেসব সার্ভিসের সদস্যদের শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় পর্যায়ের পদে নিয়োগ দেয়া হতো। কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমেও অল পাকিস্তান ভিত্তিক চাকরিতে লোক নিয়োগ করত। অবশ্য নিয়োগের পর সদস্যদের প্রাদেশিক পর্যায়ে চাকরিতেও পদায়ন করা যেত। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের পদগুলোতে শুধুমাত্র সেন্ট্রাল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগের বিধানটি পাকিস্তান অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিস এবং পাকিস্তান রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের মতো সরকারের কিছু কিছু চাকরির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল। পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টসের ক্ষেত্রে কিছু কিছু সদস্যকে প্রদেশগুলোর হিসাব নিরীক্ষকের অফিসে নিয়োগ দেয়া যেতে পারত যেরূপভাবে ষাটের দশকে রেলওয়েকে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে ও পশ্চিম পাকিস্তান রেলওয়েতে বিভক্ত করা হলে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগ দেয়া পাকিস্তান রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের সদস্যদের প্রাদেশিক রেলওয়েতে নিয়োগ দেয়া হয় যদিও তাদের নিয়োগ করা হয়েছিল কেন্দ্রীয়ভাবে। প্রতিটি সেন্ট্রাল সার্ভিসের ইতিহাস এবং চাকরির ধরণ নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস (পিএফএস) ১৯৪৭ সালে বৈদেশিক বিষয়ক বিভাগ, কমনওয়েলথ সম্পর্ক বিভাগ ও রাজনৈতিক বিভাগের সমন্বয়ে পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। এক বছর পর বৈদেশিক বিষয়ক ও রাজনৈতিক বিভাগ দুটিকে রাষ্ট্র ও সীমান্ত অঞ্চল মন্ত্রণালয় নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয়ে পুনর্গঠিত করা হয়।
পররাষ্ট্র বিষয় ও কমনওয়েলথ সম্পর্ক মন্ত্রণালয়ের সার্ভিস নিয়ন্ত্রণের আওতায় বিভিন্ন কুটনৈতিক কাউন্সিলর ও বাণিজ্যিক পদ পূরণের জন্য ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস (পিএফএস) ক্যাডার গঠন করা হয়। অবশ্য কুটনৈতিক মিশনগুলোর বাণিজ্যিক ও পরবর্তীকালে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস বহির্ভূত অফিসাররা পালন করতেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কমিশন বৈদেশিক মিশনগুলোতে চাকরিরত পিএফএস বহির্ভূত অফিসারদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখে। এ সব কমিশনের রিপোর্ট থেকে যেসব সুপারিশ বেরিয়ে আসে তা হলো:
(ক) কূটনৈতিক মিশনগুলোতে চাকরিরত পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস বহির্ভূত অফিসারদের পুরোপুরিভাবে কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে; (খ) পিএফএস কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে সরাসরি সংবাদ বিষয়ক ও বাণিজ্যিক দায়িত্বও নিতে হবে।
সরকার উপরোক্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত করে নি। কূটনৈতিক মিশনগুলোতে চাকরিরত পিএফএস বহির্ভূত অফিসাররা তাদের মূল মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় থেকে যায়। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস বহির্ভূত পদগুলোতে নিয়োগের জন্য পৃথক ক্যাডার গঠন করা হয়। এসব ক্যাডার হলো: সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস (১৯৫৯), সেন্ট্রাল ইনফরমেশন সার্ভিস (১৯৬৩) এবং ট্রেড সার্ভিস অব পাকিস্তান (১৯৬৯)। আহমদ কমিশন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান ও পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসকে দুই স্বতন্ত্র শ্রেণীতে একীভূত করার সুপারিশ করেছিল যেমন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (বৈদেশিক শাখা) এবং সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (অভ্যন্তরীণ শাখা)। সুপারিশটি বাস্তবায়িত হয় নি।
১৯৫৯ সাল পর্যন্ত পিএফএস রিক্রুটদের ফ্লেচার স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল ডিপ্লোম্যাসিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এরপর তাদের কোনো কূটনৈতিক মিশনের থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো এবং ফার্স্ট সেক্রেটারি কাউন্সিলর পদে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিদেশে তাদের চাকরি চালিয়ে যেতে হতো। এরপর তারা ডিরেক্টর হিসেবে পররাষ্ট্র দফতরে ফিরে আসতেন। ডিরেক্টর জেনারেল পদে পৌছলে তাদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। গভর্নর জেনারেল, পরে প্রেসিডেন্টকে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতদের শতকরা ৫০ ভাগ পদ পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের বাইরে থেকে পূরণ করার কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল।
একাউন্টস সার্ভিস একাউন্টস সার্ভিসের ঐতিহাসিক পটভূমি ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিসের মধ্যে নিহিত। ইন্ডিয়ান অডিট এন্ড একাউন্টস সার্ভিসের জন্ম আবার ভারত সরকারের একাউন্টস বিভাগ থেকে। ১৮৯৯ সালের পূর্বপর্যন্ত ভারতীয়দের এই বিভাগে নিয়োগ দেয়া হতো। ১৮৯৯ সালে এই বিভাগটি ইউরোপীয়দের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বিভাগের ৯ ভাগের ৪ ভাগ পদ ইউরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয় যার ফলে বিভাগটি সেক্রেটারি অফ স্টেটের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
পাকিস্তান মিলিটারি অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিস এই সার্ভিস ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত মিলিটারি ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে উদ্ভূত। ১৯০৯ সালে মিলিটারি ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টকে একটি সিভিলিয়ন ডিপার্টমেন্টে পুনর্গঠন করা হয় এবং ১৯১৩ সালের মধ্যে এটি সেক্রেটারি অব স্টেটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
পাকিস্তান রেলওয়ে একাউন্টস সার্ভিস এই সার্ভিস ছিল ১৯২৮ সালে গঠিত রেলওয়ে ফাইন্যান্স অ্যান্ড একাউন্টস সার্ভিসের উত্তরসূরী।
উপরোক্ত তিনটি হিসাব নিরীক্ষণ ক্যাডারের সদস্যদের চাকরির বৈশিষ্ট্য ছিল একই রকম। চাকরিতে প্রবেশের পর প্রথমে তাদের লাহোরে ফাইন্যান্স সার্ভিসেস একাডেমীতে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এর পর তারা নিজ নিজ সংগঠনে যোগদান করতেন। বিশ বছর চাকরির পর তারা প্রশাসনের সিনিয়র অবস্থানে এসে পৌছতেন। এ পর্যায় থেকে তারা ইকোনমিক পুলের অধীন পদগুলোতে নিয়োজিত হতে পারতেন এবং কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের চাকরিতে কিম্বা অর্থ ও বাণিজ্যের মতো অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে অন্যান্য সিনিয়র পদে প্রবেশ করতে পারতেন।
পাকিস্তান কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ সার্ভিস এ ক্যাডারের পূর্বসূরীর সন্ধান মেলে ব্রিটিশ ভারতের দুটি বিভাগের মধ্যে। এর একটি হলো কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগ এবং অন্যটি সেন্ট্রাল এক্সাইজ বা কেন্দ্রীয় আবগারী বিভাগ। গোড়াতে কাস্টমস বা শুল্ক বিভাগ ছিল একটি প্রাদেশিক বিভাগ। ১৯০৬ সালে এটি সেক্রেটারি অফ স্টেটের অধীন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত সার্ভিসে পরিণত হয়। সেন্ট্রাল এক্সাইজ বা কেন্দ্রীয় আবগারী বিভাগের দায়িত্ব ছিল চিনি, লবণ, দেয়াশলাই, সুপারি ও তামাকের উপর আবগারী শুল্ক সংগ্রহ করা। স্থল শুল্ক আদায়ের দায়িত্বও এই বিভাগের হাতে ছিল। ১৯৫৯ সালে সেন্ট্রাল ল্যান্ড কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ সার্ভিস প্রথম শ্রেণীতে সী কাস্টমস সার্ভিসের সঙ্গে একীভূত করে গঠন করা হয় পাকিস্তান কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ সার্ভিস। এই ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তরা ফাইন্যান্স সার্ভিসেস একাডেমীতে প্রশিক্ষণ লাভের পর সহকারি কালেক্টর পদে নিয়োগ লাভ করতেন। এরপর তারা কালেক্টর হিসেবে সিনিয়র পদে কিম্বা কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ডের সমপর্যায়ের পদে উন্নীত হতেন। এদের কেউ কেউ ইকনোমিক পুলেও যোগ দিতে পারতেন।
পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিস অপরাপর কেন্দ্রীয় সার্ভিসের ন্যায় পাকিস্তান ট্যাক্সেশন সার্ভিস ও ভারত সরকারের ১৯৪৪ সালে সৃষ্ট ইনকাম ট্যাক্স সার্ভিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল যদিও এ সার্ভিসের কার্যক্রম ১৯৪৪ সালের পূর্বেও চালু ছিল। শুরুতে এই সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যে পদোন্নতি প্রাপ্ত অফিসার অথবা প্রাদেশিক সার্ভিসের অফিসারদের মধ্য থেকে।
নিয়োগ দানের পর এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ফাইন্যান্স সার্ভিস একাডেমীতে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। এই একাডেমীতে প্রশিক্ষণের পর তাদের করাচিতে বিভাগীয় প্রশিক্ষণ অধিদপ্তরে আরো প্রশিক্ষণ নিতে হতো। এই সার্ভিসের চাকুরির বয়স ছিল কমবেশি অন্যান্য কেন্দ্রীয় সার্ভিসের অনুরূপ। তখনকার ইনকাম ট্যাক্স অফিসার পদবির কর্মকর্তারা ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার বা অনুরূপ পদে উন্নীত হতে পারতেন। তাদের কেউ কেউ ইকনোমিক পুলেও যোগ দিতে পারতেন।
পাকিস্তান মিলিটারি ল্যান্ড অ্যান্ড ক্যান্টনমেন্ট সার্ভিস এই ক্যাডারের জন্মও ব্রিটিশ আমলে। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ক্যান্টনমেন্টের এক ব্যাপক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলো ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যবস্থাপনায় ছিল। ১৯২৪ সালে ক্যান্টনমেন্ট প্রশাসনের বেশিরভাগ পদ বেসামরিক নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ক্যাডারের দুটি মৌলিক দায়িত্ব ভূমি শাখা ও ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী সার্ভিসের অফিসাররা পালন করতেন। ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী সার্ভিসের অফিসাররা পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। ক্যান্টনমেন্ট নির্বাহী সার্ভিসের অফিসাররা মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করত। এই স্থানীয় সরকার সংস্থা এখনকার মতো তখনও ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ বোর্ড নামে পরিচিত ছিল। দুটি শাখাকে একীভূত করে মিলিটারী ল্যান্ডস অ্যান্ড ক্যান্টনমেন্ট সার্ভিস গঠন করা হয়। এই ক্যাডারটি ক্ষুদ্র পরিসরের বিধায় অফিসারদের ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা সীমিত ছিল। শীর্ষস্থানীয় পদটি ছিল ডিরেক্টর বা পরিচালকের।
পাকিস্তান পোস্টাল সার্ভিস এই ক্যাডারের ঐতিহাসিক পটভূমির সন্ধান পাওয়া যাবে ভারত সরকারের ডাক বিভাগের মধ্যে যা ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গঠিত হয়। টেলিগ্রাফ বিভাগের ট্রাফিক শাখা ১৯১৪ সালে ডাকবিভাগের সঙ্গে একীভূত হয়। সেখানে চারটি প্রথম শ্রেণীর চাকরি ছিল যার মাধ্যমে বিভাগের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করা হতো। এগুলো ছিল সুপিরিয়র টেলিগ্রাফ সার্ভিস; ডাক ও টেলিগ্রাফ ট্রাফিক সার্ভিস; জেনারেল সেন্ট্রাল সার্ভিস এবং টেলিগ্রাফ ট্রাফিক সার্ভিস। জেনারেল সেন্ট্রাল সার্ভিসই ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান পোস্টাল সার্ভিস হিসেবে পরিচিত হয়।
ডাক বিভাগ এবং টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিভাগকে এ দুটি পৃথক শাখায় বিভক্ত করা হয় ১৯৬১ সালে। পৃথক করা বিভাগ দুটিকে দুই মহাপরিচালকের নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়। ১৯৬৫ সালে টেলিগ্রাফ ট্রাফিক সার্ভিসকে টেলিগ্রাফ প্রকৌশল সার্ভিসের সঙ্গে একীভূত করে এক পৃথক ক্যাডারে পরিণত করা হয়। ১৯৬৮ সালে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ট্রাফিক সার্ভিসকে পাকিস্তান পোস্টাল সার্ভিসের সঙ্গে একীভূত করা হয়। পাকিস্তান পোস্টাল সার্ভিসের একজন অফিসারের চাকরি জীবন সর্বনিম্ন পর্যায়ে সহকারি পোস্ট মাস্টার জেনারেল বা সমপর্যায়ের পদ দিয়ে শুরু হতো এবং তারপর তিনি পোস্ট মাস্টার জেনারেলের পদ পর্যন্ত উঠতে পারতেন। সাধারণত তার ক্যারিয়ার এই বিভাগের মধ্যে শেষ হয়ে যেত।
টেলিগ্রাফ ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস এই ক্যাডারের সদস্যদের সরকারি কর্ম কমিশন পৃথক ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষার মাধ্যমে রিক্রুট করত। অফিসারদের এই ক্যাডারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কারিগরি পদে নিয়োগ করা হতো।
সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস এই ক্যাডারের উৎপত্তির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে গণপূর্ত বিভাগের ইম্পেরিয়াল শাখায়, যার সুপারিশ করেছিল আইচিসন কমিশন। গণপূর্ত বিভাগের রেলওয়ে শাখাটি ১৯০৫ সালে বিলোপ করা হয়। তবে ইমারত ও সড়ক শাখা, সেচ শাখা ও রেলওয়ে শাখার সদস্যদের ১৯১৮ সাল পর্যন্ত একই ক্যাডারের সদস্য হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। ছয় বছর সময়ের মধ্যে দুটি স্বতন্ত্র ক্যাডারের আবির্ভাব ঘটে। এর একটি হলো ইন্ডিয়ান সার্ভিস অব ইঞ্জিনিয়ার্স (সড়ক, ইমারত ও সেচ শাখা নিয়ে) এবং অন্যটি স্টেট রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স। সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসের অফিসাররা অনেকটা অনন্যভাবেই এই বিভাগের পরিধির মধ্যে থেকে যায়।
সেন্ট্রাল ইনফরমেশন সার্ভিস এই ক্যাডার ১৯৬৩ সালে গঠন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারি মালিকানাধীন তথ্য মাধ্যমে এবং বিদেশে কূটনৈতিক মিশনগুলিতে কর্মরত অফিসারদের জন্য চাকরি কাঠামোর ব্যবস্থা করা। ১৯৭০ সালে এই ক্যাডারের নাম পরিবর্তন করে ইনফরমেশন সার্ভিস অব পাকিস্তান (আইএসপি) রাখা হয়। এই ক্যারিয়ারের চাকরি তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীন সংগঠনসমূহ যেমন বেতার ও টেলিভিশনের বিভিন্ন পদে এবং বিদেশে কূটনৈতিক মিশনসমূহের পদে সীমাবদ্ধ ছিল।
ট্রেড সার্ভিস অব পাকিস্তান ১৯৭০ সালে গঠিত। এটি কমবেশি ইনফরমেশন সার্ভিস অব পাকিস্তানের আদলে গঠিত। এই ক্যাডারের কর্মকর্তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করতেন এবং বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে বাণিজ্যিক পদেও নিয়োজিত হতেন।
সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট সার্ভিস কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে সেকশন অফিসার স্কীম নামে পরিচিত একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের সঙ্গে এই ক্যাডারের সৃষ্টি সম্পর্কিত। ১৯৫৯ সালে জি. আহমদ কমিটি এই স্কীম চালু করার সুপারিশ করেন। স্কীমটি চালু করার মূল লক্ষ ছিল, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তরগুলোকে এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, আন্ডার সেক্রেটারি ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট, ইত্যাদি পর্যায়ে কমিয়ে আনা। আরও প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সেকশন অফিসারদের (এসও) সীমিত কর্তৃত্ব দেয়া হবে যাতে করে তারা কেস বা বিষয়গুলো ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে না পাঠিয়ে নিজেরাই নিষ্পত্তি করতে পারেন। সেকশন অফিসারের ৭০ ভাগ পদ সুপারিন্টেন্ডেন্ট, সহকারি ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্যান্য চাকরিতে নিযুক্তদের মধ্য থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হতো এবং বাকি ৩০ ভাগ পদ পূরণ করা হতো সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে।
স্কীমটি চালু করার পর থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিতর্ক চলে আসছিল। ১৯৬২ সালের বেতন ও চাকরি কমিশন একে ‘অন্ধ গলির ক্যাডার’ বলে সমালোচনা করে। কমিশন আন্ডার সেক্রেটারি ব্যবস্থাটি পুনরুজ্জীবিত করার সুপারিশ করে। এই চাকরি ‘অন্ধ গলির চাকরি’ অর্থাৎ এমন চাকরিতে ভবিষ্যত উন্নতির আশা নেই এ যুক্তির ভিত্তি ছিল এই যে, সেকশন অফিসারদের ফিল্ড পর্যায়ের অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ডেপুটি সেক্রেটারি পদে পদোন্নতি দেয়া যেত না। ১৯৬৯ সালের চাকরি পুনর্গঠন কমিটি এ ব্যাপারে নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদটি পুনরুজ্জীবিত করার এবং সেকশন অফিসারদের আরও বিশেষজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা করার আহবান জানান। ১৯৬৭ সালের এম এইচ জুবেরী রিপোর্টে পাইকারী পরিবর্তন না এনে সামঞ্জস্য বিধানের আহবান জানানো হয়েছিল।
অন্যান্য সার্ভিস ১৯৪৬ সালে তোতেনহাম কমিটির সুপারিশ থেকে জেনারেল এডমিনিস্ট্রেটিভ রিজার্ভ (জিএআর) গঠন করা হয়। আন্ডার সেক্রেটারি/ডেপুটি সেক্রেটারি পদগুলো পূরণ করার জন্য সরাসরি নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন করে এটি গঠন করা হয়। গোড়াতে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্তরের লোকদের মধ্য থেকে প্রায় একশত অফিসার রিক্রুট করা হয়। ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান সরকার জিএআর-এর সরাসরি পদ্ধতি বহাল রাখে এবং আরোও একশত অফিসার রিক্রুট করে। আর্থিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অফিসারদের সমন্বয়ে জিএআর-এর অভ্যন্তরে একটি বিশেষ শাখাও গঠন করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পদগুলোর জন্য এসব অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।
জিএআর সদস্যরা বারংবার দাবি জানানো সত্ত্বেও তাদের একটা পৃথক ক্যাডার হিসেবে কখনই অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। ১৯৫২ সালে সরকার জিএআর-এ আর কোনো লোক নিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৯ সালে জি. আহমদ কমিশন জিএআর-এর পর্যালোচনা করে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জিএআর-এ আর কোনো রিক্রুটমেন্ট হবে না। কালক্রমে জিএআর-এর অস্তিত্ব লোপ পায়। ১৯৭০ সালে জিএআর-এ মাত্র ২৪ জন অফিসার ছিলেন।
বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশকে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়। তার ফলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের চাকরির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। সংবিধানে সিভিল সার্ভিস শব্দটা ব্যবহার করা হয় নি, তবে সকল শ্রেণীর সিভিল সার্ভেন্টকে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চাকরি সংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক অধ্যায় (১৩৬ নং অনুচ্ছেদে) অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। প্রথম, এই অনুচ্ছেদে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের চাকরির শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়, এতে সরকারকে সিভিল সার্ভিস পুনর্গঠন করার এবং সিভিল সার্ভিস সদস্যদের অসুবিধা ঘটতে পারে চাকরির এমন শর্তাবলি পরিবর্তন করারও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
পাকিস্তান আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই সিভিল সার্ভিসকে পুনর্গঠিত করার কাজেও সরকার হাত দেয়। এই লক্ষ্যে সরকার প্রশাসনিক ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি (এএসআরসি, ১৯৭৩) নামে একটি কমিটি গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম.এ চৌধুরী ছিলেন এই কমিটির প্রধান। চাকরি কাঠামো সম্পর্কে কমিটির সুপারিশ ছিল এই যে, (ক) সাবেক অল পাকিস্তান সার্ভিস, অন্যান্য কেন্দ্রীয় সুপিরিয়ার সার্ভিস এবং সাবেক প্রাদেশিক সার্ভিসের মধ্যকার পার্থক্য বিলোপ করতে হবে। উচ্চতর ও নিম্নতর শ্রেণীগুলোর মধ্যকার পার্থক্যও বিলোপ করতে হবে এবং প্রত্যেক পেশার গ্রুপে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন গ্রেডিং প্রথা চালু করতে হবে; (খ) বিভিন্ন গ্রুপের জন্য পদ সংরক্ষণের বর্তমান ব্যবস্থাও বিলোপ করতে হবে; এবং (গ) সকল সিভিল সার্ভেন্টকে একটি একক শ্রেণীহীন গ্রেডিং কাঠামোয় সংগঠিত করতে হবে। সমস্ত সার্ভিস এই কাঠামোর আওতায় থাকবে যেখানে দক্ষতা ও দায়িত্বের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উপযুক্ত সংখ্যক ভিন্ন ভিন্ন বেতন স্তর থাকবে এবং প্রতিটি পদের সঠিক গ্রেডিং সেই পদের বিশ্লেষণের দ্বারা নির্ধারিত হবে।
এসিআরসির সুপারিশসমূহ বাক্সবন্দী করে রাখা হয়। কি কারণে রাখা হয়েছিল প্রকাশ্যে জানা যায় নি। তার ফলে আগের পাকিস্তানি ক্যাডার প্রথাই চালু থেকে যায়। অবশ্য চাকরি পুনর্গঠনে সরকারের ক্ষমতাকে কার্যকারিতা দেয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে চাকরি (পুনর্গঠন ও শর্তাবলী) অধ্যাদেশ এবং এতদসংক্রান্ত একটা আইন জারি করা হয়। ১৯৭৬ সালে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকিং খাতসহ রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পের জন্য শিল্প ব্যবস্থা সার্ভিস (আইএমএস) নামে একটি ক্যাডার গঠন। এই ক্যাডারের রিক্রুটমেন্ট করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, তবে বিধিবিধান প্রণীত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। সরকারি কর্ম কমিশন এই মর্মে সরকারকে অভিমত দেয় যে আইএমএসকে সরকারের নিয়োজিত ক্যাডার বলে গণ্য করা যায় না। পরিশেষে ১৯৮২ সালের ১৪ নভেম্বর জারিকৃত এক বিজ্ঞপ্তি মারফত সরকার আইএমএসকে বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সাথে একীভূত করে।
১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের পর সে বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি দেশে সামরিক আইন জারী করা হয়। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার একটি বেতন ও চাকরি কমিশন গঠন করে। কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদের নামে এটি রশিদ কমিশন নামে পরিচিতি পায়। কমিশন নিম্নোক্ত গ্রুপে ১৪ স্তরের চাকরি কাঠামো সুপারিশ করে:
(ক) প্রশাসনিক, শীর্ষ ব্যবস্থাপনা ও বিশেষজ্ঞ গ্রুপ (‘এ’ লেভেল হিসেবে বর্ণিত); (খ) নির্বাহী ও মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপনা গ্রুপ (‘বি’ লেভেল হিসেবে বর্ণিত); (গ) আধিকারিক, পরিদর্শনমূলক, কারিগরী ও সহায়ক গ্রুপ; এবং (ঘ) মেসেনজারিয়াল ও কাস্টোডিয়ান গ্রুপ।
রশিদ কমিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদ্ভাবন করে। তাহলো সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) নামে একটি পৃথক ক্যাডার সৃষ্টি যেখানে রিক্রুটমেন্ট হবে উপ-সচিব পর্যায়ে এবং তা সকল ক্যাডারের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সরকারি কর্মকমিশন কর্তৃক পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে এই রিক্রুটমেন্ট হবে। ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সরকার এক সংবিধিবদ্ধ আদেশ বলে ১৪টি ক্যাডার গঠন করেন যেগুলোতে পূর্বেকার সকল সার্ভিসকে কর্ম ও দায়িত্ব অনুযায়ী আত্মীকরণ করে নেয়া হয়। ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট সরকার জারিকৃত এক সংশোধনী বিজ্ঞপ্তিবলে ক্যাডারের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ৩০-এ উন্নীত করে।
এসএসপিকে একটা পৃথক ক্যাডার হিসেবে গঠনের ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করে এবং ১৯৭৯ সালে সেই বিধি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে। তবে এসএসপিতে রিক্রুটমেন্টের জন্য লিখিত পরীক্ষার পাঠ্যসূচি নিয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের সাথে একমত হতে সরকারের দীর্ঘ ১০ বছর সময় লেগে যায়। এসএসপির ধারণা ও কাঠামোতে (ক) সচিবালয়ে নীতি ব্যবস্থাপনার পদগুলোতে সকল ক্যাডারের জন্য সমান সুযোগ এবং (খ) সার্ভিসের দক্ষ অফিসারদের একটি পুল গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। প্রকাশ্যে জ্ঞাত নয় এমন কিছু কারণে এসএসপিতে রিক্রুমেন্টের চেষ্টা ১৯৮৯ সালে ব্যর্থ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯ সালের ১২ জুলাই এসএসপি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিসিএস (প্রশাসন) ও বিসিএস (সচিবালয়) একীভূত করার ফলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ক্যাডারের সংখ্যা বর্তমানে ২৯-এ দাঁড়িয়েছে।
সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো এতে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রার্থীদের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে। বিভিন্ন শ্রেণীর প্রার্থীর জন্য এতে শতকরা ৫০ ভাগ পদ সংরক্ষিত রাখা আছে। এদের মধ্যে আছে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান সন্ততি (৩০ শতাংশ), মহিলা (১০ শতাংশ), উপজাতীয় (৫ শতাংশ) এবং ১০ শতাংশ জেলা কোটা হিসেবে সংরক্ষিত। ১৯৯৭ সালে ১৭ মার্চ সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এবং লোক প্রশাসন সংস্কার কমিশন (পিএআরসি, ২০০০) উভয়েই কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিকীকরণের সুপারিশ করেছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয় নি।
সিভিল সার্ভিসে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। সে বছর সংবিধানের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দুটি আদেশ (পিও) জারি করা হয়েছিল। প্রথম, সরকার বাংলাদেশ চাকরি আদেশ জারি করে যা পিও ৯ নামে বহুল পরিচিত ছিল; দ্বিতীয়, বাংলাদেশ সরকার (চাকরি ছাঁটাই) আদেশ ১৯৭২ যা ১৯৭২ সালের পিও ৯৭ নামে পরিচিত। এ দুই অধ্যাদেশ প্রয়োগের কারণে কতজন সিভিল সার্ভেন্ট চাকরি হারান সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই।
১৯৭৪ সালে আরও একটি আইন তৈরি করা হয়। এর নাম সরকারি কর্মচারী অব্যাহতিদান আইন। আইনটি এখনও বলবৎ আছে। এ আইনে সরকারি কর্পোরেশনের কর্মচারীসহ যেকোন সিভিল সার্ভেন্টকে পঁচিশ বছরের চাকরি সম্পন্ন করার পর আগাম অবসর চাওয়ার অধিকার দেয়া হয়েছে। এই আইনকে অনেক সময় সিভিল সার্ভেন্টদের কোনরকম কারণ না দর্শিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর জন্য সরকারের একটা হাতিয়ার হিসেবেই আখ্যায়িত হয়ে থাকে। অভিযোগ আছে যে বিভিন্ন সরকার স্রেফ রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
১৯৮২ সালের সামরিক সরকারের আমলেও শুদ্ধি অভিযান হয়েছিল। কথিত আছে যে, ৫৫৫ জন অফিসারকে চুলচেরা যাচাই বাছাই করে দেখা হয়েছিল। তবে কতজন চাকরি হারিয়েছিল প্রকাশ্যে জানা যায় নি।
সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিরত অফিসারদের চাকরিতে নেয়া সিভিল সার্ভিসের একটা বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের একটি নীতি বাস্তবায়নের পদ্ধতি কি হবে না হবে তাকে কেন্দ্র করে ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে ভাইস-প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে একটি কাউন্সিল কমিটি গঠন করা হয়। ঠিক হয় যে, সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক অফিসারদের নিম্নোক্ত মানদন্ডের ভিত্তিতে রিক্রুট করা হবে:
(ক) সরকারি অফিস বা শায়ত্বশাসিত সংস্থায় চাকরিরত; (খ) বিনা দোষে কিম্বা কোনো রকম কারণ না দর্শিয়ে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী থেকে নির্ধারিত সময়ের আগে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়া ব্যক্তি; (গ) ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি যার বয়স ৪৫ বছরের নিচে এবং (ঘ) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যাকে সরকারি অফিসে বা স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থায় চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
এর ফলে সেনাবাহিনীর সাবেক কিছু অফিসারকে ওই কমিটির মাধ্যমে শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পুলিশ, খাদ্য ও বাণিজ্য ক্যাডারের চাকরিতে নেয়া হয়। আরও কয়েকজনকে সরাসরি সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
নববইয়ের দশকে এবং তার পরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ও অন্যান্য সংগঠনের সহায়তায় বিভিন্ন সরকার সিভিল সার্ভিস বা সরকারি চাকরির সংস্কারের উপর গবেষণা কাজ পরিচালনা ও সম্পন্ন করে। একটা পেশাদার সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থা জোরদার ও কার্যকর করে তোলাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্যে। গবেষণার অন্তর্ভুক্ত ছিল:
(ক) লোক প্রশাসনের দক্ষতা সমীক্ষা (পিএইএস, ইউএসএআইডি, ১৯৮৯); (খ) লোক প্রশাসনের খাতওয়ারী সমীক্ষা (পিএএসএস, ইউএনডিপি, ১৯৯৩); (গ) যে সরকারের কাজ ভালো (বিশ্ব ব্যাংক, ১৯৯৬)। এরপর টুওয়ার্ডস বেটার গভর্নমেন্ট (১৯৯৩), এবং পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন রিফর্ম কমিশন রিপোর্ট (২০০০) শীর্ষক সমীক্ষাও পরিচালিত হয়।
আরোও সম্প্রতি ‘সাপোর্টিং গুড গভার্নেন্স প্রোগ্রাম (এডিবি ২০০৯)’ নামে একটি সর্বাঙ্গীন ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের অধীনে সিভিল সার্ভিস সংস্কার কর্মসূচির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরিচালিত সমীক্ষার পর যে সংস্কার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাহলো: (ক) ফিল্ড প্রশাসন সংস্কার, (খ) মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বিত করণ, (গ) ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, (ঘ) মোতায়েন ও উন্নয়ন নীতি। সংস্কার সম্পর্কিত আগের সমীক্ষার সুপারিশগুলো এখনও অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। অতীত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ সমীক্ষার সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হবে কিনা তা বলার সময় এখনও আসেনি। সিভিল সার্ভেন্টদের সততা ও দক্ষতা সম্পর্কে জনগণের সার্বিক ধারণা সন্তোষজনক নয়। সবদিক বিচার করে বলা যায় যে, সিভিল সার্ভিসে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নৈতিকতা নিচে নেমে গেছে, তাদের মধ্যে প্রণোদনার ঘাটতি আছে এবং প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্যের অভাব আছে। সিভিল সার্ভিসের রাজনীতিকরণের বিষয়টি গত দ’ুদশকে জনগণের বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব বিষয়ের কথা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল ও আওয়ামী লীগ নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহারে (২০০৮) সিভিল সার্ভিসকে রাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত রাখার অঙ্গীকার করেছিল। ইশতিহারে জোর দিয়ে আরও বলা হয়েছিল যে, মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে চাকরিতে পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। [এ.এম.এম শওকত আলী]