বাঁশ

বাঁশ বহুল ব্যবহূত কয়েক প্রজাতির ফাঁপা কান্ড বিশিষ্ট ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। কাষ্ঠল বৃক্ষের ন্যায় বৈশিষ্ট্য থাকায় অনেক সময় এটিকে Bambusaceae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাঁশের বিস্তৃতি অত্যন্ত ব্যাপক। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট এর গুরুত্ব অপরিসীম, যা গৃহের অবকাঠামো নির্মাণ, মঞ্চ নির্মাণ, মই, মাদুর, ঝুড়ি, ফাঁদ, হস্তশিল্পসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য বিবিধ জিনিসপত্র তৈরির কাজে ব্যবহূত হয়। দেশের কোন কোন অঞ্চলে বাঁশের পাতা চালা ঘরের ছাউনিতে এবং গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। উষ্ণমন্ডলীয় এলাকার দেশসমূহে কাগজ তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে বাঁশ ব্যবহূত হয়ে আসছে। বাঁশঝাড়সমূহ ঝড়ো হাওয়া প্রতিরোধ এবং ভূমি ক্ষয়রোধ করে। কচি বাঁশের ডগা মুখরোচক সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী। এ ধরনের কচি ডগা স্থানীয়ভাবে বাঁশ কোরাল নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বর্ষার মৌসুমে বহুল পরিমাণে এটি খেয়ে থাকে। গৃহস্থালির কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয় বিধায় বাঁশকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারুবৃক্ষ (timber) বলা হয়। অধিকাংশ প্রজাতির বাঁশ বড় আকারের যৌগিক ধরনের উদ্ভিদ। এগুলি অনেক বৎসর যাবৎ অঙ্গজ প্রজননের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং কদাচিৎ ফুল ধারণ করে। বাঁশের ফুল ধারণের বিষয়টি অনিশ্চিত স্বভাবের, দীর্ঘদিন পরপর ফুল আসে। তিন বছর থেকে ১২০ বছরের চক্রে ফুল আসতে পারে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৫-৬০ বছরের ব্যবধানে বাঁশ ফুল ধারণ করে। বাঁশের অধিকাংশ প্রজাতিই জমকালো ফুল প্রদানের পর মৃত্যুবরণ করে।

বাঁশঝাড়

Melocanna baccifera ব্যতীত বাংলাদেশে উৎপন্ন সকল প্রজাতিই ঘন ঝাড়বিশিষ্ট। বাঁশের পর্বের মধ্যভাগ সুস্পষ্ট ফাঁপা, ব্যবহারিক দিক থেকে বাঁশ বলতে মূলত কান্ডকেই বোঝায়, কারণ সুপুষ্ট কান্ডগুলিই অধিকাংশ কাজকর্মে ব্যবহূত হয়। রাইজোম থেকে বাঁশের নতুন কুঁড়ি গজায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে। ভূনিম্নস্থ রাইজোম থেকে কচি কান্ডের কৌণিক ডগা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তুলনামূলকভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে (৩০-৬০ দিন) কচি ডগাগুলি পূর্ণ দৈর্ঘ্যে উপনীত হয়। এরপর গৌণ বৃদ্ধি চলতে থাকে এবং ২-৩ বছরের মধ্যে পরিপক্ক বাঁশে পরিণত হয়। পরিপুষ্ট বাঁশের রং ধূসর বা হলুদ।

বাংলাদেশের বাঁশের মধ্যে জংলি ও আবাদি প্রকৃতির ২৬টি প্রজাতি ও একটি ভ্যারাইটি সাতটি গণের অন্তর্ভুক্ত। বনভূমি অঞ্চলে বিস্তৃত বাঁশের প্রজাতিগুলি Bambusa burmanica, B. polymorpha, B. nutans, B. tulda, Dendrocalamus hamiltonii, D. longispathus, Melocana baccifera এবং Schizostachyum dullooa। M. baccifera স্ব-প্রজাতির পৃথক ও গভীর অঞ্চল সৃষ্টি করে। অন্য প্রজাতিগুলি বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট কুঞ্জে বিভক্ত দেখা যায়। সচরাচর প্রাপ্ত সাধারণ গ্রামীণ বাঁশ হচ্ছে Bambusa balcooa, B. cacharensis, B. comillensis, B. jaintiana, B. nutans, B. salarkhanii, B. tulda, B. vulgaris এবং Thyrsostachys oliveri। এসব প্রজাতির বাঁশ বীজের এবং অঙ্গজ পদ্ধতির সাহায্যে বংশবৃদ্ধি করে। ফুলবান বাঁশে বীজ উৎপন্ন হয়। B. balcooa ও B. vulgaris ব্যতীত পরিপুষ্ট বীজ বনে অঙ্কুরিত হয় অথবা নার্সারিতে ব্যবহার করেও চারা তৈরি করা যায়। বাঁশের চারা দেখতে ধান বা গমের চারার মতোই। সাধারণ শিকড়সমেত কান্ড রোপণের মাধ্যমেই বাঁশ চাষ করা হয়। একটি কান্ডের সর্বনিম্ন অংশসহ রাইজোমই হচ্ছে বাঁশের ‘মুথা’। বর্ষা মৌসুমের আগে এপ্রিল মে মাসে সাধারণত এগুলি সংগ্রহ করা হয়। এই ধরনের এক একটি ‘মুথা’ তিন বছরের মধ্যেই আহরণযোগ্য সুপুষ্ট বাঁশে পরিণত হয়। গাছের গোড়ায় মাটি ও ধানের তুষের মিশ্রণ প্রয়োগ করে ভাল উৎপাদন পাওয়া যায়। বাঁশের তেমন কোন রোগবালাই নেই, তবে B. balcooa এবং B. vulgaris এ আগামরা রোগ দেখা যায়।

অনাবৃত খুঁটি, বেড়া ইত্যাদিতে ব্যবহূত বাঁশে এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই উইপোকা এবং ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায়। বাঁশের কান্ড প্রক্রিয়াজাত করলে ১৫ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। সিসিবি (coper sulphate, sodium dichromate এবং boric acid ২:২:১ অনুপাতে) দ্রবণ বাংলাদেশের জন্য প্রয়োগযোগ্য একটি পদ্ধতি। বাঁশ দুটি পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করা যায়, যেমন কান্ডের কলারস অপসারণ করে এবং সংরক্ষণযোগ্য দ্রবণের শোধন পদ্ধতিতে।

মুলিবাঁশ  সাধারণ বাঁশের ঘনিষ্ঠ একটি প্রজাতি Melocanna baccifera। মুলিবাঁশ বয়স অনুপাতে ১০-২০ মি লম্বা ও ১.৭-৭.৫ সেমি চওড়া হয়ে থাকে। পাতা হালকা সবুজ, লম্বা, বল্লম আকৃতির। পত্রাবরণ পুরু। কচি বাঁশ সবুজ, বয়স্ক বাঁশ হলদে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মৌলভীবাজার জেলার জঙ্গলে স্বাভাবিকভাবেই জন্মে। উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন ছাড়া বাংলাদেশের সর্বত্রই মুলিবাঁশ চাষ করা যায়। এই বাঁশ নানা কাজে ব্যবহার্য। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ মুলিবাঁশ দিয়েই ঘর তৈরি করে। নানা ধরনের কুটির শিল্প, এমনকি সস্তা দামের আসবাবপত্র তৈরিতেও মুলিবাঁশ কাজে লাগে। এটি কাগজ ও মন্ড শিল্প এবং রেওনের কাঁচামাল।  [এম খায়রুল আলম এবং আবুল খায়ের]

আরও দেখুন বাঁশ শিল্প