ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৯)  বাংলার সুলতান। বাংলায় প্রথম স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রাজধানী ছিল ঐতিহাসিক নগর সোনারগাঁয়ে। বাংলার প্রশাসনে এমন এক সময়ে এই যুগসৃষ্টিকারী পরিবর্তন সূচিত হয় যখন নব্য মামলুক শাসনের অবসানের পর সমগ্র বাংলা দিল্লির তুগলক সুলতানের করায়ত্ত ছিল।

ফখরুদ্দীন ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং খুব সম্ভবত তুর্কিদের কারাউনা গোত্রীয়। তিনি ছিলেন দিল্লির তুগলক সুলতানের অধীনে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা (ওয়ালি) বাহরাম খানের সিলাহদার (অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক)। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে বাহরাম খানের মৃত্যুর পর ফখরুদ্দীন সোনারগাঁয়ে শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করেন এবং স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করে ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন। স্বীয় মুদ্রায় ফখরুদ্দীন আল-সুলতানুল আযম ফখরুদ্দুনিয়া ওয়াদ-দ্বীন আবুল মুজাফফর মুবারক শাহ আল-সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন।

ফখরুদ্দীন ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে স্বাধীন সুলতান ঘোষণার অব্যবহিত পরে দিল্লি সুলতান মুহম্মদ তুগলকের নির্দেশে লখনৌতিএর শাসনকর্তা কদর খান, সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা (মুকতি) আইজ্জুদ্দিন ইয়াহিয়া তাদের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে বিদ্রোহী ফখরুদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। কারার (কোহ্-ই-জুদ) আমীর ফিরুয খান তাদের সৈন্য সাহায্য পাঠান। কদর খানের নেতৃত্বে এই সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফখরুদ্দীন পরাজিত হন এবং স্বীয় রাজধানী ত্যাগ করে সম্ভবত মেঘনার অপর তীরে অবস্থান নেন। কদর খান সোনারগাঁও অধিকার করেন। পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজধানীর বিপুল ধনসম্পদ এবং বহুসংখ্যক হাতী তাঁর হস্তগত হয় (১৩৩৯)।

বর্ষার শুরুতে মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা স্ব স্ব অঞ্চলে ফিরে যায়। কদর খান তাঁর বাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্যদের রাজস্ব আদায়ের কাজে মফস্বল এলাকায় পাঠিয়ে দেন। দিল্লি সুলতানের জন্য ধনসম্পদ আহরণ ও সঞ্চয়ের অজুহাতে লোভী ও অর্থ লিপ্সু কদর খান রাজধানী সোনারগাঁয়ে প্রাপ্ত সমুদয় ধনসম্পদ স্বয়ং আত্মসাৎ করেন। এমনকি তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদে সৈন্যদের বিধানমাফিক প্রাপ্য থেকেও তাদের বঞ্চিত করেন। অচিরেই কদর খান সোনারগাঁয়ে স্বীয় অবস্থানকে বিপদসঙ্কুল করে তোলেন। একদিকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁর সৈন্যরা ছিল ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত এবং অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী লখনৌতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের ব্যবস্থাও তিনি রক্ষা করতে পারেন নি। এদিকে সোনারগাঁও অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকেবহাল ফখরুদ্দীন তখন অপেক্ষা করছিলেন তাঁর প্রাকৃতিক রণকৌশল হিসেবে বর্ষার আগমনের জন্য। বর্ষা শুরু হতেই তিনি তাঁর নৌবহর নিয়ে অগ্রসর হন এবং জলপথে কদর খানকে সোনারগাঁয়ে অবরুদ্ধ করেন। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে কর্দমাক্ত ভূমি ও ভ্যাপসা গরমে অনভ্যস্ত কদর খানের বহুসংখ্যক সৈন্য ও যুদ্ধের ঘোড়া অসুস্থ হয়ে মারা যায়।

ফখরুদ্দীনের নৌবাহিনী কর্তৃক রাজধানী সোনারগাঁও অবরোধ স্বভাবতই কদর খানের পতন অনিবার্য করে তুলেছিল। কিন্তু ফখরুদ্দীন কোনো ঝুঁকি নিতে চান নি। তাই স্বীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি কুট-কৌশলের আশ্রয় নেন। কদর খানের সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষের সংবাদ পেয়ে ফখরুদ্দীন তাদের নিকট প্রস্তাব পাঠান যে, যদি তারা কদর খানকে হত্যা করে তার সঙ্গে এসে যোগ দেয় তাহলে তিনি রাজধানীতে সঞ্চিত সমুদায় ধনসম্পদ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। ধনসম্পদের লোভে কদর খানের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে কদর খানকে হত্যা করে (১৩৪০) এবং ফখরুদ্দীনের সঙ্গে যোগদানের জন্য অগ্রসর হয়। ফখরুদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীতে প্রবেশ করেন এবং সঞ্চিত ধনসম্পদ আয়ত্তে এনে তাঁর প্রতিশ্রুতি মতো সৈন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেন।

সোনারগাঁয়ে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করে ফখরুদ্দীন  লখনৌতি ও সাতগাঁর শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করার উদ্যোগ নেন। লখনৌতির শাসনকর্তা কদর খানের মৃত্যু এবং ফখরুদ্দীনের সঙ্গে যুদ্ধে সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা আইজ্জুদীন ইয়াহিয়া নিহত হওয়ার ফলে লখনৌতি ও সাতগাঁও উভয় প্রদেশই তখন ছিল শাসকশূণ্য। ফখরুদ্দীন তখন মুখলিস খানকে লখনৌতিতে তাঁর নায়েব নিযুক্ত করে লখনৌতি এবং এর অধীনস্থ অঞ্চল অধিকারের জন্য এক শক্তিশালী বাহিনীসহ প্রেরণ করেন। কিন্তু কদর খানের বাহিনীর আরিয-ই-লস্কর মালিক আলী মুবারক সৈন্য সংগ্রহ করে মুখলিস খানের অভিযান প্রতিহত করেন। যুদ্ধে মুখলিস খান পরাজিত ও নিহত হন। তাঁর গোটা বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। আলী মোবারক লখনৌতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সাতগাঁও দখলের জন্য ফখরুদ্দীনের প্রচেষ্টা সম্ভবত সফল হয় নি। তাঁর বাহিনী সাতগাঁ আক্রমণ করে সেখানে বেপরোয়া লুণ্ঠন চালায়। কিন্তু সাতগাঁয়ে তাঁর পক্ষে অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় নি।

লখনৌতি অধিকারে ফখরুদ্দীনের ব্যর্থতা, আলী মুবারকের নিকট তাঁর সেনাপতি মুখলিস খানের পরাজয় ও মৃত্যু এবং লখনৌতিতে আলী মুবারকের ক্ষমতা দখলের ফলে উভয়ের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষের সূচনা হয়। দুই নরপতি সমগ্র বাংলায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। এ দুই প্রতিদ্বন্দ্বির মধ্যকার সংঘর্ষ ছিল উভয়ের জন্যই একদিকে আক্রমণাত্মক ও অপরদিকে প্রতিরোধ প্রকৃতির। উন্নততর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে ফখরুদ্দীন বর্ষা মৌসুমে প্রায়শ লখনৌতিতে আক্রমণ চালাতেন এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রতিহত করতেন। আর তাঁর চেয়ে উন্নততর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে আলাউদ্দিন আলী শাহ (আলী মুবারক) আক্রমণ করতেন।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে যুদ্ধে ত্রিপুরারাজ রাজা প্রতাপ মাণিক্যকে পরাজিত করেন। এই অভিযানের পর তিনি চট্টগ্রাম অধিকারের উদ্দেশ্যে নোয়াখালীর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন। চট্টগ্রাম তখন ছিল ত্রিপুরা রাজের অধীন। ফখরুদ্দীন চাটগাঁও দুর্গের বিপরীতে কর্ণফুলীর অপর পারে একটি সুউচ্চ ও দুর্ভেদ্য দুর্গ দখল করেন। খুব সম্ভবত ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম জয় করেন। এ অভিযানে বদরউদ্দিন আল্লামার (বদর পীর) নেতৃত্বে বহুসংখ্যক সুফি দরবেশ সুলতানের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম জয়ের পর ঐ অঞ্চল একটি প্রদেশ (মুলক) হিসেবে ফখরুদ্দীনের সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুলতান শায়দা নামীয় এক সুফি দরবেশকে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা (নায়েব) নিয়োগ করেন।

বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলায় ফখরুদ্দীনের আধিপত্যের ফলে ত্রিপুরার রাজা সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ফখরুদ্দীনের দক্ষিণপূর্ব-মুখী অভিযানের ফলে আরাকানের রাজাও তাঁর রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং সম্ভবত সোনারগাঁয়ের সুলতানের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন।

ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় সফর করেন (১৩৪৬)। তিনি বাংলায় তাঁর ভ্রমণের এক মূল্যবান বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যান। এ বিবরণে বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য, অধিবাসীদের জীবনের বিভিন্ন দিক এবং দেশের সমৃদ্ধির প্রাণবন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি তাঁর বিবরণে ফখরুদ্দীনের চারিত্রিক গুণাবলির প্রশংসা করে তাঁকে একজন খ্যাতনামা নরপতি হিসেবে মূল্যায়ন করেন।

ইবনে বতুতা ফখরুদ্দীন মুবারক শাহকে বাঙ্গালাহর সুলতান হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং বলেন যে, চট্টগ্রাম তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বাঙ্গালাহ রাজ্যের পরিধি নির্ধারণে ধরে নেয়া যায় যে, ফখরুদ্দীনের রাজ্য প্রায় সমগ্র পূর্ববাংলা এবং দক্ষিণ বঙ্গের পূর্বাংশব্যাপী বিস্তৃত ছিল। ফখরুদ্দীনের রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। প্রদেশের নাম পূর্ববঙ্গে ছিল ইকলিম এবং দক্ষিণবঙ্গে মুলক। প্রদেশের শাসনকর্তার অভিধা সম্পর্কে একমাত্র সূত্র পাওয়া যায় যে, মূলক চাটগাঁও বা চট্টগ্রাম প্রদেশের শাসনকর্তার অভিধা ছিল নায়েব। প্রদেশগুলো সম্ভবত পরগণায় বিভক্ত ছিল। মুবারক আজিয়াল ছিল ইকলিম মুবারকাবাদের একটি পরগণা। এই পরগণা ও প্রদেশ দুয়েরই নামকরণ হয় ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের নামে।

ফখরুদ্দীনের অধীনে বাঙ্গালাহ রাজ্যের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় ইবনে বতুতার বর্ণনায়। তিনি তাঁর বিবরণে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের প্রাচুর্য্য এবং রমরমা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলেছেন, বলেছেন দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত চালের উদ্বৃত্ত মজুদ এবং বিদেশে চাল রপ্তানির কথা, আর প্রতিবেশী দেশ চীন ও জাভার সঙ্গে সোনারগাঁয়ের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের কথা।

সুলতান ফখরুদ্দীন ছিলেন ফকির ও সুফি দরবেশদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। সুলতানের স্থায়ী নির্দেশ ছিল যে, তাঁর রাজ্যে ফকিরদের নদী পারাপারের জন্য কোনো মাশুল বা ভাড়া প্রদান করতে হবে না, যেকোন আগন্তক, ফকির ও সুফিদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে এবং কোনো ফকির কোনো শহরে পৌঁছলে তাঁকে ন্যূনতম অর্ধ দীনার ভাতা প্রদান করতে হবে।

ইবনে বতুতা বর্ণিত এই খ্যাতনামা নরপতি, বিশিষ্ট সমর সংগঠক, বিজেতা ও কূটনীতিক স্পষ্টই ছিলেন দিল্লির অধীনতা পাশ থেকে বাংলার স্বাধীনতার সূচনার অগ্রনায়ক, আর তিনিই প্রসারিত করে দেন পরবর্তী দুই শতক ব্যাপী বাংলায় স্বাধীন শাসনের দিগন্তকে। বাংলায় সর্বাধিক সুদৃশ্য মুদ্রার রূপকার, চারুশিল্প ও হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারক, বহিরাগত ও ফকির-দরবেশদের উদার পৃষ্ঠপোষক, মসজিদ সমাধিসৌধ ও সড়ক নির্মাতা, আরাকানি মগদের অত্যাচার ও লুণ্ঠন থেকে রাজ্যের জনগণের রক্ষক এই মহান নৃপতি বাংলার ইতিহাসে এক উজ্জল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বহুমুখী গুণে বিভূষিত বাংলার এই সুলতানের   প্রধান কৃতিত্ব হলো, জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রাচুর্য এবং পণ্যের সস্তাদর নিশ্চিত করে তিনি তাঁর রাজ্যের জনগণের জন্য সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন। ১৩৪৯ খ্রিস্টাব্দে (৭৫০ হিজরি) সোনারগাঁয়ে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মৃত্যু হয়।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]

গ্রন্থপঞ্জি  Muazzam Hussain Khan, Fakhruddin Mubarak Shah of Sonarganw, Dhaka , 2005.