পাটলীপুত্র
পাটলীপুত্র আধুনিক পাটনা শহরের প্রাচীন নাম। খ্রিস্টপূর্ব তিন অব্দে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে পাটলীপুত্র ছিল পৃথিবীর বৃহত্তর শহরগুলির মধ্যে অন্যতম জনাকীর্ণ একটি শহর। দীর্ঘতম সময়ে টিকে থাকা শহর হিসেবে পাটনা বিভিন্ন শাসনামলে বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো। যেমন-পাটালীগ্রাম, পাটালীপুত্র, কুসুমপুর, পুষ্পপুরা, আজিমাবাদ এবং বর্তমানের পাটনা, যাকে বলা হয় প্রাচীন পাটলীপুত্রের নতুন রূপ। শহরটি মূলত অজাতশত্রু ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বে গঙ্গানদীর নিকটে একটি ক্ষুদ্রাকৃতির দুর্গ (পাটালীগ্রাম) আকারে নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে যা প্রাচীন মহাজনপদ সমূহের মধ্যে মগধ রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
নন্দ, মৌর্য, সুঙ্গ ও গুপ্ত থেকে শুরু করে পালদের সময় পর্যন্ত উত্তর-মধ্য ভারতীয় রাজবংশের শাসকদের প্রশাসনিক কেন্দ্র ও রাজধানী হিসেবে পাটলীপুত্রের গুরুত্ব ছিল। গৌতম বুদ্ধের সময়ে এটি পাটলীগ্রাম নামে পরিচিত হয়। গৌতম বুদ্ধ এ গ্রামেই তাঁর জীবনের শেষ সময় অতিবাহিত করেছেন। এখানেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো- প্রথমটি গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর সময় ও দ্বিতীয়টি সম্রাট অশোক এর রাজত্বকালে। পাটলীপুত্র মৌর্য শাসকদের অধীনে রাজধানীর মর্যাদা পাওয়ার পরই তা উন্নতির শীর্ষে অবতীর্ণ হয়। গুপ্ত রাজবংশীয় শাসনামল (৩-৪ শতক) থেকে পাল সাম্রাজ্য (৮-১০ শতক) পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পাটলীপুত্র রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলো। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর সফরকালে শহরটির প্রায় ভগ্নদশা দেখতে পান। শের শাহ শুরী তাঁর রাজধানী পাটলীপুত্রে স্থাপন করে নতুন নাম করেন পাটনা।
ঐতিহ্যগতভাবে হরিয়াংকা রাজবংশীয় শাসনের পত্তন হয় ৬৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এবং তাদের রাজধানী ছিলো রাজগৃহে। পরবর্তীকালে এই রাজগৃহই পাটলীপুত্র নাম ধারণ করে। ৪২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ নন্দ রাজবংশ কর্তৃক উৎখাত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হরিয়াংকা রাজবংশ টিকে ছিলো। এই সময়েই মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রে ভারতের দু’টি প্রধান ধর্মীয় ভাবধারার জন্ম হয়।
মৌর্য রাজবংশের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে (খ্রি.পূ. ৩২১-১৮৫) পাটলীপুত্র ভারতীয় উপমহাদেশের শক্তির আধার ও কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। পাটলীপুত্রকে কেন্দ্র করেই মৌর্যদের বিখ্যাত রাজা চন্দ্রগুপ্ত (খ্রি.পূ. ৩২২-৩০১) বঙ্গোপসাগর হতে আফগানিস্তান পর্যন্ত তাঁর রাজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে এক বিস্তৃত ভূ-খন্ড শাসন করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কৌটিল্যের তত্ত্বাবধানে, রাজধানী পাটলীপুত্রকে কেন্দ্র করে জটিল প্রশাসনিক ব্যবস্থা সহ একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবী বংশীয় রমনীকে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন যারা সে সময়ে পাটলীপুত্রের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিলো। স্থানটিকে রানী যৌতুক হিসেবে সঙ্গে আনলে চন্দ্রগুপ্ত তাকে রাজ্যের রাজধানীতে রূপান্তরিত করেন এবং স্থানকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশি অঞ্চলসমূহ জয়ের করে তিনি তাঁর শক্তি বৃদ্ধি করেন। চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর রাজত্ব করে বিশটিরও অধিক রাজ্যে গুপ্ত শাসনের প্রভাব বিস্তার করেন।
গুপ্ত যুগে (পাঁচ শতক) নালন্দা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌর্য শাসকদের অধীনে প্রাথমিক পর্যায়ের পাটলীপুত্রের অবকাঠামো ছিল কাঠের তৈরি। বহুতল বিশিষ্ট কাঠের দালান ও প্রাসাদসমূহ ছিলো বাগান ও পুকুর দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। শহরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল এর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। পরিখার আকারে পানির আধার সৃষ্টি করে প্রত্যেক রাস্তার পাশে এমন ব্যবস্থা করা ছিলো যা একাধারে শহরের প্রতিরক্ষা ও পয়ঃনিষ্কাশনের কাজ করতো। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসও পাটলীপুত্রকে ভারতের বিখ্যাত শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় দেখা যায় যে, শহরটি ছিল একটি সামন্তরিক ক্ষেত্র, যার দীর্ঘ অংশ ৮০ স্টেড (Stade, জার্মান একক) ও ক্ষুদ্র অংশ ১৫ স্টেড। একটি কাঠের তৈরি দেয়াল দ্বারা পুরো শহরটি ঘেরা। পর্যটকদের বর্ণনানুযায়ী, দেয়ালটিতে ছিলো ৫৭০টি টাওয়ার ও ৬৪টি তোরণ। দেয়ালের বাইরে ছিলো গভীর খাত যা একাধারে প্রতিরক্ষা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কাজ করতো। ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক এই কাঠের রাজধানীটিকে পাথরের তৈরি রাজধানীতে রূপান্তরিত করেন। ৩৯৯-৪১৪ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ের মধ্যে চীনা পরিব্রাজক ও পন্ডিত ফাহুয়ান ভারত ভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তেও পাথরের তৈরি শহরের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবক-এর সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলা, বিহার ও পাটনা অধিকার করে তাকে দিল্লী সালতানাতের অধিনস্ত প্রদেশে পরিণত করে। বখতিয়ার খলজি বাংলার বহু প্রাচীন বিদ্যাপীঠও ধ্বংস করে। পাটনা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরত্বে রাজগৃহে অবস্থিত নালন্দা মহাবিদ্যালয়টি তার মধ্যে অন্যতম। বাংলার বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোকে সেনাছাউনি বলে ভুল করে বহিরাগত আক্রমণকারী সর্বদাই তা ধ্বংস করেছে। নালন্দা অঞ্চলে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীগণ তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করে ও তার নাম করা হয় বিহার বা বিহার শরীফ (নালন্দা জেলা)। পরবর্তীকালে শের শাহের সময়ে মুসলিমদের সদর দপ্তর বিহার থেকে পাটনায় স্থানান্তরিত হয় ও সম্পূর্ণ মগধ অঞ্চলের নামকরণ হয় বিহার।
১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট আকবর আফগান প্রধান দাউদ খান কররানীকে দমন করার উদ্দেশ্যে পাটনায় আসেন। আকবরের রাজ্য সেক্রেটারি ও আইন-ই আকবরীর প্রণেতা আবুল ফজল পাটনাকে কাগজ, পাথর ও কাঁচ শিল্প উৎপাদনের জন্য সমৃদ্ধির সম্ভাবনানাময় অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি পাটনায় উৎপাদিত উচ্চজাতের চালেরও বর্ণনা দেন যা ইউরোপে পাটনা চাল নামে প্রসিদ্ধ ছিলো। মুগল সাম্রাজ্যের পতনের পর পাটনা নওয়াবদের অধীনস্ত হয় ও তা একটি সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। সতেরো শতকে পাটনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
অন্যান্য নিদর্শন ছাড়াও পাটালীপুত্রে উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন সমূহের মধ্যে রয়েছে মৌর্য যুগের (৩২২-১৮৫ খ্রি. পূ.) একটি ৮০ স্তম্ভ বিশিষ্ট হল। এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রাপ্ত প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ধ্বংসাবশেষ ও পুরাতাত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে যে, পাটালীপুত্র অজাতশত্রু, চন্দ্রগুপ্ত ও অশোক-এর সময়ে শুধু রাজধানীই ছিলো না, এটি ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্ততপক্ষে চারটি ধারাবাহিক রাজবংশীয় যুগের ইতিহাস ধারণ করে।
৮০ স্তম্ভ বিশিষ্ট সম্মেলনশালা ১৯১২-১৯১৫ সালের মধ্যে ডি.বি. স্পুনার কর্তৃক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে এখানে একটি মসৃণ পাথরের স্তম্ভ ও ব্যাপক সংখ্যক পাথরের খন্ডাংশ পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া এই খননকার্য ৭২টি ছাইভস্মের গহবর এবং প্রচুর পাথরকুচির অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে যা দ্বারা প্রমাণ হয় যে, উক্ত স্থানে অন্যান্য আরো স্তম্ভের অস্তিত্ব ছিলো। ১৯৫১-১৯৫৫ সালের মধ্যে কে পি যশোয়াল কর্তৃক খননকার্য সম্পাদনকালে অনুরূপ ৮টি ভস্মের গর্তের সন্ধান পাওয়া যাওয়ার পর উক্ত প্রত্নস্থলের নামকরণ হয় ৮০ স্তম্ভ বিশিষ্ট সম্মেলনশালা। প্রাপ্ত সকল প্রত্নবস্ত্ত মৌর্য যুগের। যদিও কোনো কোনো ঐতিহাসিক ৮০ স্তম্ভ হলের অস্তিত্বের সূত্র ধরে মনে করেন যে, ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে (খ্রি.পূ ২৭৩-২৩২)পাটলীপুত্তা এর (পাটলীপুত্র) অন্তর্গত অশোকর্মার এ স্থানেই তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আনন্দ বিহার পাটলীপুত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে কাঠের পাটাতন ও মাটির মূর্তি ছাড়াও ইটের ভিত্তির উপর নির্মিত বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে স্থানটি উদ্যান পরিবেশিষ্ট ও জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত দর্শনীয় স্থান।
আরোগ্য বিহার' খননকালে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শণ। এখানে প্রাচীনকালের ভারতীয় চিকিৎসক ধনন্তরীর কর্তৃত্বাধীনে নিয়ন্ত্রিত একটি আরোগ্য বিহারের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে যা প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ চর্চার সূত্রের সন্ধান দেয়।
দুরাখি দেবী মন্দির ১৮৯০-এর দশকে প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়াডেল কর্তৃক খননের ফলে একটি সূতপ এর উপরে উভয় পাশে নারী মূর্তি সংযোজিত বাঁকানো পাথরের রেলিং এর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। দুইমুখে নারী মূর্তি সংস্থাপিত থাকার ফলে মন্দিরের নামকরণ হয়েছে দুরুখী বা দুরুখ্যিয়া (দুইমুখ) দেবী মন্দির, যা ২-১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সুঙ্গ শিল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মুর্তিগুলির গাছের ডাল হাতে ধরে তা ভাঙনরত ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো যার নাম সালভঞ্জিকা (গাছের ডাল বা শাখা ভাঙা) এবং এর প্রতীকী অর্থ সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্যে আয়োজিত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে উপস্থিত যুবতী নারী। পরবর্তীকালে প্রত্নস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বে নয়াটোলা (কঙ্করবাগ) নামক স্থানে এই মূর্তিগুলোকে নিয়ে আসা হয় এবং মন্দির সদৃশ্য স্থানে রেখে তার পূজা দেয়া হয়। এসবের অনুরূপ একটি প্রতীকী মূর্তি বর্তমানে পাটনা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। যেহেতু পাটনা শহরের খুব সামান্য অংশেই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ হয়েছে, সেহেতু ধারণা করা যায় যে, পাটলীপুত্রের অসংখ্য প্রত্ননিদর্শন আধুনিক পাটনা শহরের মাটির নীচে এখনো রয়ে গেছে। [নাসরীন আক্তার]
গ্রন্থপঞ্জি Thapar, Romila (1990), A History of India, Volume 1, New Delhi and London: Penguin Books, Ancient City of Pataliputra, Patna Official website.