দত্ত, কালিকিংকর

দত্ত, কালিকিংকর (১৯০৫-১৯৮২)  ইতিহাসবিদ। তিনি দক্ষিণ বিহারের (বর্তমানের ঝাড়খন্ড-এর) সাঁওতাল পরগনার পাকুর মহকুমার ঝিকরহাটি গ্রামে বাঙালি কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পাকুর রাজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক সদানন্দ দত্তের পুত্র, কালিকিংকর দত্ত ১৯২১ সালে পাকুর রাজ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তাঁর পরবর্তী জীবন পিতার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়।

কালিকিংকর ১৯২৫ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ (মুর্শিদাবাদ জেলা) থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রিলাভ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে, বহরমপুরে থাকাকালীন তিনি ঐ সময়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কালিদাস নাগের সংস্পর্শে আসেন এবং ইতিহাসের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। তিনি ১৯২৭ সালে এম.এ পাস করে পাটনা কলেজে গবেষণা শুরু করেন। আঠারো শতকের বাংলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসের ওপর গবেষণামূলক কাজের জন্য তাঁকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্টুডেন্টশিপ বৃত্তি প্রদান করা হয়। ১৯৩৬ সালে তাঁর Studies in the History of the Bengal Subah, 1740-70 (Volume- I) নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯ সালে Alivardi Khan and His Times শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

কালিকিংকর ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পাটনা কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি উক্ত কলেজে অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভ করেন এবং ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ঐ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৫৮-৬০ সময়কালে তিনি উক্ত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি পাটনার কে.পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংগঠিত করেন। তিনি ১৯৬০ সালের মে মাস থেকে ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিহার স্টেট আর্কাইভসের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৯৬২ সালের মার্চ থেকে ১৯৬৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। একজন পেশাদার ঐতিহাসিক এবং শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেও তিনি নিজেকে বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতি এবং গ্রাজুয়েট’স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যাবলির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন।

কালিকিংকর দত্ত প্রায় ৩০টি গ্রন্থ রচনা করেন এবং অ্যাকাডেমিক জার্নাল ও সাময়িকীতে বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তাঁর প্রধান গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে: Alivardi and His Times, The Santal Insurrection, Shah Alam II and The East India Company এবং The History of Freedom Movement in Bihar। সকল গ্রন্থ থাকা সত্ত্বেও সম্ভবত তিনি Advanced History of India গ্রন্থের লেখক হিসেবে সমধিক পরিচিত (আর.সি মজুমদার এবং এইচ.সি রায়চৌধুরী এ গ্রন্থের অপর দুই সহযোগী লেখক)।

এছাড়াও কালিকিংকর দত্ত বিভিন্ন পদমর্যাদায় রিজিওনাল রেকর্ডস সার্ভে কমিটি অব বিহার এবং বিহার রিসার্চ সোসাইটির সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সঙ্গেও ঘনিষ্টভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৩ সালে তিনি এ সংগঠনের শাখা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৫৮ সালে এর সাধারণ সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ইন্দো-ব্রিটিশ হিস্ট্ররিক্যাল সোসাইটি অব মাদ্রাজ-এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৬৮ সালে যদুনাথ গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ১৯৮২ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

কালিকিংকর দত্ত ঐতিহাসিক উপাত্তের সঠিক উপস্থাপনায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তাঁর রচনাশৈলী ছিল প্রাঞ্জল। তাঁর ঐতিহাসিক উৎসের উপর দক্ষতা ছিল অনন্য এবং তিনি বিমূর্ত তাত্ত্বিকতার চেয়ে বাস্তব প্রমাণের উপর অধিকতর আস্থা্শীল ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে পাটনায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [রাজশেখর বসু]