টর্ট
টর্ট কারও কর্তব্যবিচ্যুতির কারণে ঘটিত অপরের ক্ষতিজনিত দীউয়ানি অপরাধ। আইনি কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অবহেলা বা কর্তব্যবিচ্যুতির কারণে এধরনের ক্ষতি ঘটে থাকে। চুক্তিভঙ্গের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। অবহেলা, অশালীনতা, অবৈধ প্রবেশ, ভুলবশত কারারুদ্ধকরণ এ ধরনের কাজের দৃষ্টান্ত। পনের শতকে সাধারণ আইনের আওতায় ইংল্যান্ডের বিচারকগণ সর্বপ্রথম টর্ট প্রতিবিধানের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ক্রমশ ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে টর্ট প্রতিকারের জন্য যথাযথ আইন প্রণীত হয়। অপরাধীকে অপরাধে নিরুৎসাহিত করা এবং ব্যক্তিগত ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় হলো টর্ট আইনের উদ্দেশ্য। এ প্রতিকার কেবল কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধেই নয়, পৌরসভা বা আইনগতভাবে গঠিত যেকোন সংস্থার বিরুদ্ধেও প্রযোজ্য। কোনো ব্যক্তি দৈহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে এবং দীউয়ানি আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পরে। অবহেলা, উপদ্রব, স্বেচ্ছায় মিথ্যা বিবরণ প্রদান, অবৈধ প্রবেশ, ভুল কারাবন্দিকরণ, প্রবঞ্চনা বা মানহানি ইত্যাদির জন্যও এসব মামলা হতে পারে।
আইনসঙ্গত কাজ হিসেবে শহরের আবর্জনা ও বর্জ্য অপসারণে ঢাকা মিউনিসিপাল করপোরেশনের অবহেলা টর্ট জাতীয় অন্যায়। অনুরূপভাবে কোনো চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসায় অবহেলা করলে এবং সেজন্য রোগীর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে কিংবা কোনো উকিলের অবহেলার দরুন মক্কেলের সম্পত্তির ক্ষতি হলে এগুলোও টর্ট বলে গণ্য হবে। ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বা অন্যত্র পথেঘাটে ময়লা রাখা অথবা ট্যানারির বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলা অপকর্মের নজির। ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে উৎসাহ যুগিয়ে তার মাধ্যমে অন্যের ক্ষতিসাধনও টর্ট হিসাবে গণ্য হবে। কারও জমিতে অবৈধ প্রবেশও টর্ট। নিজের জমির ফলের গাছের ডাল অন্যের এলাকায় ঝুলে থাকলে অথবা একজনের জমির পানি অন্যের জমিতে গিয়ে পড়লে কিংবা মালিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেয়াদশেষে ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকলে তা টর্ট হবে। কোনো ব্যক্তি শক্তিপ্রয়োগ বা ভীতিপ্রদর্শন করে অবৈধভাবে অন্য কারও চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে সে কাজ মিথ্যা কারাবন্দিত্ব হিসেবে গণ্য হবে।
বাংলাদেশে গুরুতর দুর্ঘটনা আইন ১৮৫৫ বলে অন্যায় কাজ, অবহেলা বা ত্রুটিজনিত কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ টর্ট জাতীয় কাজের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে এবং মৃতের স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা ও সন্তান ক্ষতিপূরণ লাভ করতে পারে। শ্রমিক ক্ষতিপূরণ আইন ১৯২৩ অনুসারে মালিকের অবহেলার কারণে কোনো শ্রমিক আহত হলে মালিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। পরিসীমা আইনের আওতায় কারও জলপ্রবাহের বৈধ অধিকারহরণ বা পানি ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা কোনো ক্ষতি ঘটালে পানিসেচ আইন ১৮৭৬ বলে তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে চলার পথ বা জলপথে বাধা সৃষ্টির প্রতিকারকল্পে পরিসীমা আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা দায়ের করা যায়। যেকোন ক্ষতিসাধন, অবৈধভাবে কার্যসম্পাদন ও কর্তব্যচ্যুতির জন্যও ক্ষতিপূরণের মামলা করা চলে। কৃষি ও স্বাস্থ্য-বিষয়ক আইন ১৯২০ এর অধীনে অধিগৃহীত নয় এমন জমির অধিকার এবং মৎসচাষ, পানি নিষ্কাশন, পানি ব্যবহার, সম্পত্তির অন্যান্য অধিকার ব্যাহত হলে সেক্ষেত্রে এ আইনের আওতায় ক্ষতিপূরণের মামলা রুজুর অবকাশ রয়েছে। বিনির্দিষ্ট ত্রাণ আইন ১৮৭৭ অনুসারে অপরাধীর বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ ও স্থগিতাদেশের মামলা করা যায়।
বাংলাদেশে টর্ট জাতীয় কাজের (কর্তব্যচ্যুতি) জন্য নিম্নোক্ত কয়েকটি আইনের আওতায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়: (১) গুরুতর দুর্ঘটনা আইন, ১৮৫৫; (২) সেচ আইন, ১৮৭৬; (৩) বিনির্দিষ্ট ত্রাণ আইন, ১৮৭৭; (৪) সুখাধিকার আইন ১৮৮২; (৫) কৃষি ও স্বাস্থ্যরক্ষা উন্নয়ন আইন, ১৯২০; (৬) মহিলাদের ক্ষতিপূরণ আইন, ১৯২৩; (৭) ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অধ্যাদেশ, ১৯৮৩। [এ.এম মাহমুদুর রহমান]