হিন্দু মহাসভা
হিন্দু মহাসভা ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুদের একটি সংগঠন। এর উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন স্থানীয় হিন্দু আন্দোলনকে একত্র করা। এ ধরণের হিন্দু আন্দোলনের শিকড় উত্তর ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনে নিহিত ছিল এবং এদের বিস্তার ঊনিশ শতকে দেখা যায়। উত্তর প্রদেশের পন্ডিত মদনমোহন মালব্যসহ হিন্দু মহাসভার অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা ১৯২০-এর দশকে সংগঠনটিকে কংগ্রেসের আদলে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে এর শাখা ছিল। হিন্দু মহাসভা হিন্দু ও অস্পৃশ্যদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় কর্তব্যসমূহ, গোরক্ষা ও হিন্দি ভাষা বিস্তারের ওপর জোর দেয়। সংগঠনটি হিন্দুস্বার্থ রক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। বিশেষ করে কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশলের কারণে যখন হিন্দু স্বার্থ বিপন্ন বলে মনে করা হতো, তখনই এ মনোযোগ আরও বৃদ্ধি পায়।
১৯২৫ সালে কে. হেজওয়ার নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর.এস.এস) নামে একটি নতুন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। শুরু থেকেই আর.এস.এস জঙ্গি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে।
১৯২০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে বাংলায় হিন্দু মহাসভার কর্মকান্ড মুখ্যত অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও ‘অপবিত্র’ জনের শুদ্ধিকরণে কেন্দ্রীভূত ছিল। স্থানীয় কংগ্রেস সদস্যদের সমর্থন নিয়ে হিন্দু মহাসভার নেতারা অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়ন সাধনে ব্রতী হয়। বিশেষত ম্যাকডোনাল্ডের ‘Communal Award’-এর পরবর্তীকালে নীচুবর্ণের লোকদের মধ্যে হিন্দু মহাসভার কর্মকান্ড প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। হিন্দু মহাসভা আদমশুমারির সময় আদিবাসীদেরকে বর্ণ হিন্দুদের নামগ্রহণ করতে ও নিজেদেরকে ক্ষত্রিয় হিসেবে পরিচয় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। মালদা জেলায় হিন্দু মহাসভার সক্রিয় কর্মীরা আদিবাসী শ্রমিক ও বর্গাচাষীদেরকে মুসলিম জোতদারের জমিতে কাজ না করার আহবান জানায়। তারা আদিবাসীদেরকে একদিকে হিন্দু রাজনীতিবিদদের সঙ্গে হাত মেলাতে, অন্যদিকে মুসলিম মনিবদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে উৎসাহিত করে। তারা মনে করে এভাবেই উত্তরবঙ্গে বর্গাচাষীদেরকে হাত করার বামপন্থী প্রয়াস প্রতিহত করা যাবে।
১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে কয়েকটি নতুন হিন্দু সংগঠন হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার অভিযান শুরু করে। হিন্দু মহাসভা এদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। বেশ কিছু জেলায় মহাসভা কর্মীরা নিম্নবর্ণের নেতৃত্বের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করত। নিম্নবর্ণের মানুষকে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করার এ প্রয়াস শেষাবধি তাদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষের রূপ নেয়। এ সংঘর্ষ প্রায়শই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হতো। বর্ধমান, খুলনা, যশোর, ঢাকা ও নোয়াখালী জেলায় নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
১৯৪০-এর দশকে কংগ্রেস ও মহাসভার মধ্যে রাজনৈতিক মতানৈক্য দেখা দেয়। বঙ্গীয় কংগ্রেস বর্ণহিন্দুদের প্রার্থী নির্বাচিত করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মহাসভা ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন আদায় করে। কংগ্রেস নেতারা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে, কংগ্রেস হিন্দু স্বার্থ রক্ষায় হিন্দু মহাসভার চেয়ে অনেক বেশি পারঙ্গম। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে পরিণতিতে কলকাতায় যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, তাতে মহাসভার রাজনৈতিক আশা কিছু পরিমাণে পুনরুজ্জীবিত হয়। এ পরিস্থিতিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাংলায় হিন্দু মহাসভার একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। বস্ত্তত শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর প্রভাবেই বাংলার হিন্দুরা পশ্চিম বাংলায় একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচড়া দেওয়ার ফলে হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক দল গঠনে আগ্রহী হয়। হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলিকে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করার ধারণাকে হিন্দু মহাসভা সমর্থন করে। হিন্দু মহাসভা সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লোকদের দ্বারা হিন্দু তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করে। ১৯৪৬ সাল নাগাদ হিন্দু মহাসভা কলকাতার হিন্দুদের একটি বড় অংশকে মহাসভার হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থনে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়। এক অর্থে মহাসভা হিন্দু ভদ্রলোকদের জন্য বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম আধিপত্য প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী মঞ্চ হিসেবে আবির্ভূত হয়। [রাজশেখর বসু]
গ্রন্থপঞ্জি Judith M Brown, Modern India: The Origins of an Asian Democracy, Delhi 1984; Sumit Sarkar, Modern India, 1885-1947, New Delhi, 1990; Joya Chatterji, Bengal divided: Hindu communalism and partition, Delhi, 1995.