হাঁস

হাঁস (Duck)  Anseriformes বর্গের Anatidae গোত্রের লিপ্তপদ (web-footed) জলচর পাখি। হাঁসদের অনেক প্রজাতি পরিযায়ী, আবার কিছুসংখ্যক এক জায়গায় স্থায়িভাবে বসবাস করে। এদের পায়ের তিনটি আঙুলই ত্বক দ্বারা পরস্পর যুক্ত। সকল হাঁসের ঠোঁট চ্যাপ্টা। ঠোঁটের কিনারা চিরুনির মতো খাঁজকাটা। ফলে এরা খাদ্যবস্ত্তকে পানি থেকে ছেঁকে তুলতে পারে। তুলনামূলকভাবে হাঁসের ঘাড় লম্বা ও দেহ নাদুসনুদুস কিন্তু ছিমছাম। ডানা জোড়া সাধারণত লম্বা ও আগা চোখা যা দীর্ঘক্ষণ ওড়ার পক্ষে সহায়ক। হাঁসের ঘাড় ও পা রাজহাঁস (goose) ও মরালের (swan) ঘাড় ও পায়ের তুলনায় অনেক খাটো। হাঁসের ডিমে দাগ থাকে না। সদ্যপ্রসূত হাঁসের ছানার দেহ কোমল পালক (down feathers) বা ছোট ছোট পালকে ঢাকা থাকে। হংসী নিজ বুক থেকে কোমল পালক টেনে তুলে বাসার কিনারা সবসময় কোমল পালকে সাজিয়ে রাখে। এসময় এরা ডানা থেকে উড়াল পালক (flight feathers) নির্মোচন করে; ফলে হাঁসেরা মাসখানেক বা পরবর্তী প্রজননকাল পর্যন্ত উড়তে পারে না। হাঁসেরা দুই ভাগে বিভক্ত: ভাসা হাঁস (Dabbling ducks) ও ডুবুরি হাঁস (Diving ducks)। অধিকন্তু আছে চখা বা চক্রবাক।

হাঁস

ভাসা হাঁস পানির উপরে চরে খায়। সাধারণত ডুব দেওয়া পছন্দ করে না, তবে ডুব দিতে পারে যখন বয়স কম বা উড়তে অসমর্থ। প্রায় সকল হাঁসের পাখনায় পাখনা মুকুর (wing speculum) আছে যা উজ্জ্বল শুভ্রবর্ণ মুকুর ফালির মতো দেখায়। স্ত্রী হাঁসের দেহের বর্ণ সাধারণত বাদামি, কিন্তু পুরুষ হাঁসের রঙ বিশেষত প্রজনন ঋতুতে বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দেহের রঙের ক্ষেত্রে পুরুষ হাঁসের জীবনেও ভাটা আসে যখন ওদের হংসীর মতো দেখায়। হাঁসের পেছনের আঙ্গুল ছোট ও খাটো এবং খন্ডবিভক্ত নয়।

ভাসা হাঁস পানির উপরিভাগ থেকে কেবল ছেঁকে খাদ্য তোলে না, একই সঙ্গে মাথা, ঘাড় ও বুকের ঊর্ধ্বাংশ প্রায় ৯০ ডিগ্রি কোণে পানিতে ডুবিয়ে তল থেকেও খাদ্য সংগ্রহ করে। এভাবে এরা  হ্রদ, বিল, পুকুর ও মোহনার অগভীর অঞ্চলের তলার কাদা থেকে জলজ উদ্ভিদের বীজ ও কন্দ এবং কৃমি ও শামুকজাতীয় প্রাণী সংগ্রহ করতে পারে। ডুবুরি হাঁসের সব প্রজাতি Anas গণভুক্ত। বাংলাদেশের এই গণভুক্ত প্রায় এক ডজন হাঁসের মধ্যে একটি বাদে আর সবই পরিযায়ী। এদের মধ্যে সহজদৃষ্ট: ম্যালার্ড (Anas platyrhynchos), পিনটেইল (Anas acuta), পান্তামুখী বা খুন্তে হাঁস (Anas clypeata), গ্যারগ্যানে/নীল পাখনা টিল বা ছোট বুনোহাঁস (Anas querquedula), গ্যাডওয়াল/পিয়ং হাঁস (Anas strepera) এবং উইজিওন/লালশির (Anas penelope)। এদেশের পোষা হাঁসগুলির আদি পুরুষ ম্যালার্ড বা নীলশির বুনোহাঁস।

দাগা-ঠোঁট হাঁস (Spotbill Duck) বা পাতিহাঁস (Anas poecilorhyncha) বাংলাদেশের বাসিন্দা। গৃহপালিত এই হাঁসের ঠোঁটের আগা হলুদ রঙের। উপরের চোয়ালের গোড়ায় থাকে দুটি লাল দাগ। অন্যান্য স্থায়ী বাসিন্দা হলো কটন টিল/বালিহাঁস (Nettapus coromandelianus), লেসার হুইসলিং টিল/ছোট সরালি (Dendrocygna javanica) লার্জ হুইসলিং টিল/বড় সরালি (Dendrocygna bicolor)। তিনটি পাখিই গাছের কোটরে বাসা বানায় বলে এদের গেছোহাঁসও (Tree Duck) বলা হয়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে বালিহাঁস দেখা যায়। বড় আকারের আরও দুটি হাঁস বাংলাদেশের বাসিন্দা। সেগুলি কম্বডাক/নুকতা বা বুঁচা হাঁস (Sarkidiornis melanotos) ও সাদা পাখনা কাঠহাঁস বা বাদিহাঁস (Cairina scutulata)। বুঁচা হাঁস কখনও কখনও দেখা যায় পদ্মা ও যমুনার চরাঞ্চলে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাসালং উপত্যকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এখনও কয়েক জোড়া বাদিহাঁস আছে বলে জানা যায়। এরা পানির নিচে সাঁতার কেটে মাছ ধরে এবং সিভিট, উরি আম ও চীনা করই প্রভৃতি গাছে বাসা বানায়। বাদিহাঁস বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকাভুক্ত।

ডুবুরি হাঁসের পেছনের আঙুল প্রশস্ত ও কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত। হাঁস স্বচ্ছন্দে ও দ্রুত সাঁতার কাটতে এই আঙুল ব্যবহার করে। এরা পানির নিচে ডুব দিয়ে ও সাঁতার কেটে খাদ্য সংগ্রহ করে। এদের প্রধান খাদ্য মাছ, চিংড়ি, জলজ কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য ছোট জলজ প্রাণী। হংস ও হংসীর ডাক আলাদা। হংসের শরীরে কালো পালক থাকে। সকল পোচার্ড (Anthya spp) পানিতে ডুবসাঁতার কাটে। বাংলাদেশে পোচার্ডের ছয়টি প্রজাতি আছে। এগুলির মধ্যে সচরাচর দেখা যায়: টাফটেড পোচার্ড বা টাফটেড ডাক/বামুনিয়া হাঁস, (Aythya fuligula), হোয়াইট আইড পোচার্ড বা ফেরুজিনাস ডাক/রাঙামুরি বা ভুতিহাঁস (Aythya nyroca) ও কমন পোচার্ড/সাধারণ ভুতিহাঁস (Aythya ferina)। দলের অন্যরা হলো বেয়ারস পোচার্ড/বড় ভুতিহাঁস (Aythya baeri) ও স্কপ-ডাক বা শপ হাঁস (Aythya marila)। বাংলাদেশে বড় ভুতিহাঁসের দেখা পাওয়ার রেকর্ড মাত্র হাতে গোনা। বাদবাকি প্রজাতির হাঁসগুলি দক্ষিণের নদীমেহানা থেকে দক্ষিণ-পূর্বের বিলসমুহের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। লালঝুঁটি পোচার্ড বা রাঙামুরি (Netta rufina) একই সঙ্গে ভাসা ও ডুবুরি। এই হাঁস হাওর ও বড় বিলে বেশ চোখে পড়ে।

বড় আকারের অন্য দুটি পরিযায়ী হাঁস: রাডি শেলডাক (Tadorna ferruginea) ও কমন শেলডাক/শাচখা বা শাহচখা (Tadorna tadorna)। বৃহত্তর বরিশাল, বৃহত্তর নোয়াখালী ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার চরাঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে রাডি শেলডাক চোখে পড়ে। [আলী রেজা খান]

বুঁচা হাঁস (Comb duck)  Anseriformes বর্গের, Anatidae গোত্রভুক্ত অতি বিপন্ন এক প্রজাতির বড় হাঁস, Sarkidiornis melanotos। এটি নুকতা হিসেবেও পরিচিত। পুরুষ হাঁসের চঞ্চুর গোড়ায় একটি মাংসল গাঁট বা চিরুনির মতো মাংসখন্ড থাকে। প্রজননকালে গাঁটটি বেশ স্ফীত হয়। দেহের উপরিভাগ নীলচে কালো। পিঠের পিছনভাগ ধূসর।

বুঁচা হাঁস

মাথা ও ঘাড়ে সাদার উপর কালো রঙের ফুটকি। ডানার গৌণ পালক ব্রোঞ্জ রঙের। বক্ষের অর্ধেক জুড়ে একটি কালো রঙের ফালি। স্ত্রী হাঁস অপেক্ষাকৃত মলিন ও ছোট। এ হাঁস দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭৬ সেমি। এরা উড্ডয়নে দক্ষ, হাঁটায় ও ডুবসাঁতারে নিপুণ। দিনে গাছে নিশ্চিন্তে স্থির বসে থাকে; পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৪-১০, কখনও ২৫-৩০টি। মুখ্যত উদ্ভিদভোজী; খাদ্য দানাশস্য, জলজ উদ্ভিদের বীজ ও ধান; কখনও ব্যাঙ ও কীটপতঙ্গ খায়। পানির ধারে প্রাচীন বৃক্ষের কান্ডে মাঝারি উচ্চতায় প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কোটরে বাসা বাঁধে। বাসা ঘেরহীন বা কাঠি, ঘাস, শুষ্ক পাতা ও পালকের ঘেরযুক্ত।

বাসা বাঁধার মৌসুম জুলাই-সেপ্টেম্বর। একগুচ্ছে ডিমের সংখ্যা ৭-১৫। দেশের বড় বড় জলাভূমিতে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ জলাভূমিতে এদের দেখা যায়। পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন (দক্ষিণ-পূর্বাংশে) এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও দেখা যায়।  [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]

বাদি হাঁস (White–winged duck)  Anseriformes বর্গভুক্ত Dendrocygnidae গোত্রের (পূর্বে Anatidae গোত্রভুক্ত ছিল) একটি অতি বিপন্ন হাঁস (Cairina scutulata)। এদের দেহের উপরিভাগ চকচকে কালচে, অঙ্কীয়ভাগ ঘন বাদামি, মাথা ও গলায় কালো ফুটকিযুক্ত সাদা রঙের পালক রয়েছে।

বাদি হাঁস

ডানার গোড়ায় এক টুকরো বড় সাদা রঙ। ডানার সাদা দাগ ও দেহের নিচের ঘন বাদামি রঙ দেখে একে একই আকারের Comb duck থেকে আলাদা করা যায়। দৈর্ঘ্যে ৬৬-৮১ সেমি; স্ত্রী হাঁস আকারে পুরুষ হাঁস থেকে ছোট। জোড়ায় জোড়ায় থাকে বা  ছোট দলে ৫-৬টি হাঁস থাকে। দিনে বনাঞ্চলের নির্দিষ্ট ডোবায় আশ্রয় নেয়, জলাভূমিতে আহারের জন্য সন্ধায় উড়ে যায়। বন্য অবস্থায় এদের আহারের অভ্যাস সম্বন্ধে জানা যায় না; বন্দী জীবনে ওরা সর্বভুক, অবশ্য প্রাণিজাতীয় খাদ্য অধিক পছন্দ। গাছের গর্তে বাসা বাঁধে। গর্তে কখনও সামান্য কয়টি কাঠি, ঘাস ও পাতা বিছানো থাকে। একবারে ৭-১০টি ডিম পাড়ে, ডিমে তা দেয় প্রায় ৩০ দিন ধরে।

দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাসালং-এ সংরক্ষিত বনভূমির বদ্ধ জলাশয় বা ধীর প্রবাহিত জলধারার স্যাঁতসেঁতে চিরহরিৎ মিশ্র বনাঞ্চলে এরা বাস করে। আবাস ধ্বংস ও শিকার এদের জন্য বড় হুমকি। এই প্রজাতি ভারত, মায়ানমার, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, ক্যাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও পাওয়া যায়।  [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]