হরিহরার গড়

হরিহরার গড়  একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলা সদর থেকে ৩ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে হরিহরা মৌজায় অবস্থিত। হরিহরা ও পূর্বপার্শ্বস্থ নাগপাড়া গ্রামের ব্যাপক এলাকা জুড়ে প্রায় ৫০টি উঁচু ভিটার সমন্বয়ে হরিহরার গড় বিস্তৃত। এ গড়ের উত্তরাংশে নিম্নভূমিতে পরিখাবেষ্টিত বৃহদাকার কয়েকটি ভিটা হরিহর রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ বলে চিহ্নিত। পাকিস্তান আমলেও ভিটাগুলি ঝোঁপ-জঙ্গলে আবৃত ছিল। স্বাধীনতার পর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভিড়ে লোকজন ভিটাগুলি পরিষ্কার করে সেখানে বসতি গড়ে তোলে। গড় এলাকায় সর্বত্র প্রাচীনকালের বাসিন্দাদের ব্যবহূত নানা ধরনের মৃৎপাত্র ও মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায়। কয়েকটি ভিটায় বসতবাড়ি নির্মাণকালে মাটির নিচে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দালান কোঠার অনেকগুলো ভিত পাওয়া যায়। টকটকে লাল রংয়ের পোড়া ইট ছাড়াও এসব দালান কোঠার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রচুর টেরাকোটা পাওয়া যায়।

বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের স্থাপত্যে ব্যবহূত টেরাকোটার ন্যায় এগুলো নানা ধরনের ফুল-ফল, লতা-পাতা ও জ্যামিতিক নকশায় তৈরি। এখান থেকে সংগৃহীত বেশকিছু টেরাকোটা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে। (চিত্র দ্র.) এখানকার উঁচু ভিটাগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন, রাজার ভিটা, মন্ত্রির ভিটা, মাধব সন্ন্যাসীর ভিটা, জোড়াভিটা, বটগাছী ভিটা ইত্যাদি। রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ভিটার উত্তর পার্শ্বে ১৯৭৬ সালে পুকুর খননকালে শাঁনবাধানো ঘাটের কয়েকটি সিঁড়ি এবং অসংখ্য ইট ও টেরাকোটার সঙ্গে মাটির তৈরি প্রচুর তৈজসপত্র, কাঠখন্ড এবং প্রাণীর হাড় পাওয়া যায়।

হরিহরার গড়ে প্রাপ্ত টেরাকোটা

২০০৭ সালে একই ভিটায় পশ্চিমাংশে মাটি খননকালে ৫ ফুট চওড়া দেয়ালসহ দালানের একটি কক্ষের কোণা আবিষ্কৃত হয়। (চিত্র দ্র.) এছাড়া এ দেয়ালের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি অষ্টকোণ টাওয়ারের নিম্নভাগ দেখতে পাওয়া যায়। প্রাপ্ত দেয়াল ও টেরাকোটাগুলোর বৈশিষ্ট্য এর দুই কিমি দক্ষিণে অবস্থিত হিতামপুর শাহী মসজিদের অনুরূপ বিধায় একটি সুলতানি আমলের মসজিদের ধ্বংসাবশেষ বলে ধারণা করা যায়। রাজার ভিটার পশ্চিমে অবস্থিত মাধব সন্ন্যাসীর ভিটা থেকেও অনুরূপ প্রচুর ইট ও টেরাকোটা পাওয়া যায়।

হরিহরার গড়ের সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিউয়েন সাঙ সমতট এলাকায় যে ৩০টি বৌদ্ধ সংঘরাম প্রত্যক্ষ করেন, পুরাতত্ত্ববিদ পরেশনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মতে তন্মধ্যে একটি ছিল শৈলকুপায়। এতদঞ্চলে হরিহরার গড় ছাড়া এত প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান আর নেই। কাণ্যকুঞ্জের কোলাঞ্চনগর থেকে আগত সৌপায়ন গোত্রীয় নাগবংশ শৈলকুপায় রাজধানী স্থাপন করে এ অঞ্চলে রাজত্ব করত। এ বংশের আদিপুরুষ ছিলেন শিবরায় নাগ। তাঁর পুত্র রাজা কর্কট নাগ তারাউজিয়াল পরগনার অধীশ্বর ছিলেন। তিনি ও তাঁর ভাই জটাধর নাগ মহারাজা বল্লাল সেনের সমসাময়িক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথায় বিরক্ত শুক্লাম্ভর নাগ তেরো শতকে শৈলকুপা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নাগপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন এবং কালক্রমে ছোট নদীর তীরে রাজধানী গড়ে তোলেন। এ বংশের রঘুনাথ রায় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন। তিনি রাজা মানসিংহের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। এই রঘুনাথ রায়ের পৌত্র হরিরাম নাগপাড়ার উত্তর-পশ্চিমে নিম্নভূমিতে পরিখাবেষ্টিত সুউচ্চ ও বৃহদাকার ভিটায় রাজবাড়ি তৈরি করেন। তাঁর নামানুসারে হরিহরার গড়ের নামকরণ হয়ে থাকবে।

গৌড়ের সুলতানি শাসকদের সময়ে তারাউজিয়াল পরগণার হিন্দু শাসকেরা করদ রাজ্যে পরিণত হয়। পনের শতকের শুরুতে শৈলকুপার বিখ্যাত ছয়গম্বুজ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা দরবেশ আরব শাহের প্রচেষ্টায় এতদঞ্চলের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। ষোল শতকের প্রারম্ভে শৈলকুপার অদুরে হিতামপুর ও হরিহরায় আরও দুটি পাকা মসজিদ নির্মিত হয়। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি রঘুনাথ রায় মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হবার পর মুগল ফৌজদার ইনায়েত খাঁর রঘুর রাজ্য বাজেয়াপ্ত করেন। পরাজিত শাসকের বংশধরেরা নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ায় হরিহর রাজপুরী শ্রীহীন হয়ে পড়ে। সতের শতকে এ অঞ্চলের ছোট ছোট নদীগুলো ভরাট হয়ে যায়। সম্ভবত ব্যাপক মহামারীর কারণে হরিহর রাজপুরী জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।  [মো: আলমগীর]

গ্রন্থপঞ্জি  Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. 70, Kolkata 1901; বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা, ৯ম বর্ষ, ডিসেম্বর ১৯৯১; সচিত্র বাংলাদেশ, ১১ বর্ষ ১৭ সংখ্যা, আগস্ট ১৯৯০; শতীশচন্দ্র মিত্র, যশোর খুলনার ইতিহাস, ২য় প্রকাশ ১৯৬৬; প্রফেসর হাবিবা খাতুন, ‘উলুঘ খান জাহান’, নিবন্ধমালা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৫ খন্ড, জুন ১৯৮৯।