সেন, সমর

সেন, সমর  (১৯১৬-১৯৮৭)  কবি, সাহিত্যিক। জন্ম ১৯১৬ সালের ১০ অক্টোবর কলকাতার বাগবাজারে। পিতা অরুণ সেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। প্রথিতযশা গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর পিতামহ।

সমর সেন কাশিমবাজার স্কুল থেকে ম্যাট্রি্ক (১৯৩২), স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আই.এ (১৯৩৪) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (১৯৩৭) ও স্নাতকোত্তর (১৯৩৮)। মার্কসবাদী নেতা রাধারমণ মিত্র ও বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য লাভ করার ফলে সমর সেনের রাজনৈতিক মনন গঠিত হয়। তবে তিনি মার্কসের সাম্যবাদী মতবাদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করলেও সরাসরি মার্কসীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেননি।

সমর সেন কিছুকাল অধ্যাপনা করেন কাঁথির প্রভাতকুমার কলেজ এবং দিল­ীর কমার্সিয়াল কলেজে। কর্ম জীবনের বৃহৎ অংশ কেটেছে তাঁর সাংবাদিকতায়। স্টেটস্ম্যান, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, নাও প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতা করেন। Frontier (ফ্রন্টিয়ার) ও নাও পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। কলকাতা -এর সংবাদ বিভাগে, বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এবং মস্কোর প্রগতি প্রকাশনালয়ে অনুবাদক হিসেবেও তিনি কর্মরত ছিলেন।

সমর সেন

‘আমি রোমান্টিক কবি নই, আমি মার্ক্সিস্ট’-এভাবেই তিনি মার্কসবাদের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ঘোষণা করেন। নাগরিক জীবনের স্বভাব, অভাব ও অসঙ্গতির বিদ্রূপাত্মক চিত্রায়ণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। আলোর জন্য অনাবিল অস্থিরতা থেকেই তিনি অন্ধকারময় জীবনের বিবিধ বিপর্যয়ে বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, যদিও তাঁর এ ক্ষোভের প্রকাশ কখনও খুব তীব্র হয়নি। তাঁর বিদ্রূপের ভাষা তীক্ষ্ণ, ভঙ্গি মর্মান্তিক, লক্ষ্যভেদী। মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি হিসেবেই তিনি স্বশ্রেণীর স্বরূপ উন্মোচনে স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

সামন্ততন্ত্রের প্রতি আসক্তি, উপনিবেশের শৃঙ্খল, আর্থিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক-আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীলতার অভিঘাত মধ্যবিত্তকে বিচলিত করে। স্নেহ-প্রেম প্রভৃতি মানবিক অনুভূতির আড়ালে মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা ও পাশবিকতার মর্মঘাতী রূপ তুলে ধরেছেন তিনি কবিতায়। মধ্যবিত্তের মানসিক বৈকল্যের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণ সবল, স্বতঃস্ফূর্ত এবং ব্যক্তিচিহ্নিত। সমকালের নানা টানাপড়েনের চিহ্ন তাঁর কবিতায় লক্ষণীয়। কিন্তু তাঁর কবিতা দুঃসময়ের কাছে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। কবির এ অনুভব ও উপলব্ধির অনুঘটক হিসেবে সক্রিয় থেকেছে মার্কসবাদপ্রসূত ইতিবাচক জীবনপ্রত্যয়। তাঁর কবিতার মর্মবস্ত্ততে লক্ষ করা যায় এরকম আশাবাদ: ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় স্তব্ধ প্রগতির চাকা বিপ্লবোত্তর শ্রেণীহীন সমাজেই সচল হবে। এ লক্ষ্যে তিনি কবিতায় ক্রমাগত পুঁজিবাদপ্রসূত ক্ষয়িষ্ণু সমাজকাঠামোর অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরেন, যা তাঁর জীবনদৃষ্টি ও শিল্পভাবনার স্মারক। ছন্দহীন জীবনের জলছবি অাঁকতে গিয়ে কবিতায় তিনি গদ্যের রূঢ় বাস্তবতায় নিমজ্জিত হয়েছেন, যাতে কাব্যের স্নিগ্ধতাও অনুপস্থিত নয়। তাঁর প্রকাশ-কৌশল অনাড়ম্বর, কোনো রকমের ভূমিকা ছাড়াই তিনি অবলীলায় আপন অভিজ্ঞতার কাব্যিক বুননে পাঠককে সম্পৃক্ত করেন। ফলে পরিচিত পৃথিবীই তাঁর কবিতার আধার হয়ে ওঠে।

তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি মধ্যে কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ (১৯৪০), নানা কথা (১৯৪২), খোলা চিঠি (১৯৪৩), তিন পুরুষ (১৯৪৪) প্রভৃতি প্রধান। তাঁর আত্মজীবনী বাবু বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। ১৯৮৭ সালের ২৩ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। [তারেক রেজা]