সেন, কেশবচন্দ্র

সেন, কেশবচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৮৪)  উনিশ শতকের বাংলার বুদ্ধিজীবী ও ব্রাহ্ম নেতা। তিনি ১৮৮০ সালে ‘নব বিধান’ নামে সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে কেশব সেন বাংলার সমাজে এক গভীর ছাপ রেখেছিলেন। ধর্মীয় ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে কেশব সেন সর্বত্রই আত্মপরিচয় তুলে ধরেছেন ধর্মবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে নব-বৈষ্ণববাদ ও মাতৃ দেবী অর্চনার ব্যাখ্যাতা, বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক থেকে সংযত তত্ত্ববাদী, তীব্র নিয়মতান্ত্রিকতাবাদী থেকে কর্তৃত্ববাদের ধারক, জাতীয়তাবাদের সমর্থক থেকে ব্রিটিশ শাসনের সুফল প্রচারে জোরালো কণ্ঠস্বররূপে।

বিশ্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠাই ছিল কেশবের প্রধান অভীষ্ট লক্ষ্য। হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি গভীরভাবে একত্ববাদী ধর্মতত্ত্ব এবং থিওডর পার্কার, এফ.ডবি­উ নিউম্যান, আর.ডবি­উ এমারসন, মিস ফ্লান্সিস কোবে এবং অন্যান্যদের দৃঢ় প্রচারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। আমেরিকান একত্ববাদী ধর্মপ্রচারক সি.এইচ.এ ডাল একত্ববাদের গুরুত্ব দ্বারা কেশবকে প্রভাবিত করেন। এ ধরনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই কেশব ১৮৫৭ সালে ‘গুডউইল ফ্যাটার্নিটি’ নামে ছাত্রদের একটি একত্ববাদী ধর্ম সভার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন এ সভার প্রধান বক্তা। এ সংগঠনের একটি সভায় কেশব প্রথমবারের মতো দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচিত হন। একেশ্বরপন্থি বেদান্তবাদী দেবেন্দ্রনাথের প্রচারিত ধর্মতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে ১৮৫৭ সালে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন এবং ১৮৫৮ সালের মধ্যেই সংগঠনের একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। দেবেন্দ্রনাথ এ প্রতিভাবান বক্তা এবং সংগঠকের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের একজন অসাধারণ নেতা খুঁজে পান। ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন ‘এরপর হলো কেশবের যুগ’।

কেশবচন্দ্র সেন

১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত সময়ে কেশব তাঁর নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা এবং কর্মকান্ড দিয়ে ব্রাহ্ম সমাজকে নতুন জীবন প্রদান করেন। ১৮৬১ সালে কেশব ব্রাহ্ম সমাজের অঙ্গ হিসেবে দি ইন্ডিয়ান মিরর প্রকাশ করে এর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বিশ্বধর্মের চেতনা ছড়িয়ে দেন। তিনি সমাজের প্রাত্যহিক ও নিয়মানুগ ধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন। ১৮৬২ সালে আচার্য নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি স্বেচ্ছায় ধর্ম প্রচার প্রসারে মনোনিবেশ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সমাজে প্রয়োজন আত্মত্যাগী কর্মী। ‘বেতন’ শব্দটি ব্রাহ্ম সমাজের শব্দ ভান্ডার থেকে বাতিল করতে হবে। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৬ সালের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের ৩১টির মতো শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

সমাজের আচার্য হিসেবে কেশবচন্দ্র কিছু হিন্দু রীতি-নীতি যথা: বর্ণ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ ইত্যাদি বন্ধ করার ওপর জোর দেন। তিনি ছিলেন বিধবা ও আন্তবর্ণ বিবাহের একজন জোরালো সমর্থক। কেশবের নেতৃত্বে অনেক ব্রাহ্ম যুবক পৈতা পরার রীতি বন্ধ করে দেয়। ১৮৬২ এবং ১৮৬৪ সালে প্রথম বারের মতো যথাক্রমে বিধবা এবং আন্তবর্ণ বিবাহ সম্পন্ন হয়।

নারী শিক্ষা ছিল কেশবের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মক্ষেত্র। এটি কেশব পরিচালিত ‘ব্রাহ্ম বন্ধু সভা’র (১৮৬৩) অপরিহার্য আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। তিনি ‘বামাবোধিনী সভা’ ও ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’র (উভয়টিই ১৮৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত) সংগঠকদের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রচেষ্টাকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা দেন এবং নারীর নৈতিক এবং বৈষয়িক অবস্থার উন্নয়নে ‘বামা হিতৈষিণী সভা’কে (১৮৭১) পরিচালনা করেন।

এ ধরনের সামাজিক সংস্কার ও নারী মুক্তি অবশ্য দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবের মাঝে মতভেদের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যার পরিণতিতে ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। দেবেন্দ্রনাথ জাতীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে এবং এ ব্যাপারে হিন্দু সমাজকেও বিরোধী করে তুলতে চান নি। তিনি কোনো আমূল পরিবর্তন চান নি। ফলে ‘জাতীয় পরিচয়’ বিষয়টি তাদের মধ্যে তর্কের সূত্রপাত ঘটায়। কেশব দেবেন্দ্রনাথকে দায়ী করেন এই বলে যে, তিনি ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদকে আরেকটি হিন্দু বর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসী। এ পরিস্থিতে কেশব সেন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্রাহ্ম সমাজ উন্নয়নের জন্য ১৮৬৬ সালে একটি সমাজ গঠন করে তার নাম দেন ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজ’। আর এ কারণে পুরনোটি পরিচিত হয়ে উঠে ‘আদি সমাজ’ হিসেবে।

কেশবের সমাজ যুব সম্প্রদায়ের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৬৮ সালের মধ্যে পূর্ব ভারতের ৬৫টি শাখার প্রায় সবকয়টি প্রকৃতপক্ষে নতুন সমাজে যোগ দেয় এবং ১৮৭২ সালের মধ্যে সমগ্র ভারতে এর সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১০১-এ। এ দ্রুত জনপ্রিয়তা দেবেন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের উপর কেশবের বিশ্বজনীনতার বিজয় প্রমাণ করে। কেশব তাঁর এ বিশ্বজনীনতা প্রথম প্রচার করেন তাঁর নতুন নির্মিত মন্দিরে (১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট নির্মিত), যা ছিল হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ ও খ্রিস্টানদের গির্জার স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে নির্মিত। অনেকের মতে, এর মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মের প্রতি কেশবের আগ্রহ প্রকাশ পায়, যা ছিল দেবেন্দ্রনাথের কাছে সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়।

১৮৭২ সালের ‘নেটিভ (ব্রাহ্ম) ম্যারিজ অ্যাক্ট থ্রি’ পাস হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবের মাঝে ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পায়। এ অ্যাক্ট কেশবের সমাজ সংস্কারের সর্বোচ্চ সীমা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ আইনে ১৮৫০ সাল থেকে বিদ্যাসাগরের মতো উদারপন্থি সংস্কারকগণ কর্তৃক সকল সংস্কার যেমন: আন্তবর্ণ ও বিধবা বিবাহ সমর্থন, বাল্য বিবাহ, স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক দ্বিতীয় বিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ স্বীকৃত হয়। প্রবীণ সমাজ এ নাস্তিক্যধর্মী সিভিল ম্যারিজ অ্যাক্টকে বিজাতীয় হিসেবে বিবেচনা করে।

ইংল্যান্ড ভ্রমণের পর (মার্চ-সেপ্টেম্বর, ১৮৭০) কেশবের সংস্কার স্পৃহা আরও বৃদ্ধি পায়। ভারতের সামাজিক অবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে ভিক্টোরীয় যুগের ইংল্যান্ডকে উদ্দীপ্ত করতে গিয়ে কেশব এর সংস্কার কার্যাদি ও ‘উন্নত’ পারিবারিক জীবন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। ইংল্যান্ড থেকে ফেরার অব্যবহিত পরেই কেশবচন্দ্র ‘ইন্ডিয়ান রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন (নভেম্বর, ১৮৭০)। এর কর্মতৎপরতার পাঁচটি দিক ছিল বদান্যতা, (ভোগবিলাস-পানভোজনে) মিতাচার, নারীর বৈষয়িক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, মাতৃভাষায় গণশিক্ষা এবং সুলভে পাঠ সামগ্রী সরবরাহ। এ অ্যাসোসিয়েশনের ছায়াতলেই কেশব সমাজ সেবা কমিটি, মদ্যপান বিরোধী সঙ্ঘ, বালিকা বিদ্যালয়, বয়স্কদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়, পেশাভিত্তিক কারিগরি শিক্ষার জন্য শিল্প বিদ্যালয়, এবং কলকাতা ও এর উপকণ্ঠে চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ১৮৭০ সালের নভেম্বর মাস থেকে তিনি সাপ্তাহিক সুলভ সমাচার প্রকাশ করতে শুরু করেন, যার মূল্য ছিল মাত্র এক পয়সা। ১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ এর প্রচার সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে (২৭,২০২) এবং ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল বাংলায় সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত প্রবন্ধের মধ্যে ছিল, ‘প্রজাকুলের দুর্দশা’, ‘দরিদ্রের বিলাপ’, ‘কলকাতার শ্রমিকদের দুর্দশা’ ইত্যাদি। পত্রিকাটি জনগণের অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বের ওপরও জোর দেয়।

১৮৭২ সালটিকে কেশবের সমাজ সংস্কার তৎপরতার শীর্ষচূড়া হিসেবে গণ্য করা যায়। এর পর থেকে তিনি ক্রমশ প্রধান প্রধান ধর্মতত্ত্বের তুলনামূলক অধ্যয়ন ও ধ্যানমগ্নতায় নিজেকে নিবিষ্ট করেন। ১৮৭৫ সালে সন্ন্যাসীর আশ্রম হিসেবে সাধন কানন-এর প্রতিষ্ঠা এবং ব্রাহ্ম সমাজের কয়েকজন পন্ডিতকে ইসলাম, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে পড়াশোনা ও এগুলির অনুবাদের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে এ পরিবর্তন চোখে পড়ে।

ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের জীবনকে সর্বজনীন ধর্ম করার নিমিত্তে কেশবচন্দ্র ১৮৭৮ সালে ‘ভারত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের কর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৈব বার্তা বা আদেশ-এর ওপর নির্ভরতা এ সময় তাঁর ধর্ম বিশ্বাসের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৭৫ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত সময়ে কেশবচন্দ্রের সাথে রামকৃষ্ণ-এর নিবিড় ব্যক্তিগত সর্ম্পক গড়ে ওঠে এবং সম্ভবত রামকৃষ্ণের প্রভাবেই তিনি ব্রাহ্ম সমাজে যোগাভ্যাস, বৈরাগ্য এবং ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনার সূচনা করেন।

কেশবের সংস্কার কর্মকান্ডে অবক্ষয়ের ছাপ ফুটে ওঠে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার পরবর্তী কালের চিন্তা ভাবনায়। এককালে যিনি ছিলেন এর সমর্থক সে কেশবই নারীর উচ্চ শিক্ষা এবং সামাজিক স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক শুরু করেন। তিনি নারীদের বাইরের বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রস্ত্ততিমূলক উচ্চ শিক্ষার পরিবর্তে নারীসুলভ গুণের উন্নয়নের ব্যাপারে বেশি জোর দেন।

কেশবের এ নতুন সংরক্ষণশীলতা এবং ব্রাহ্ম সমাজে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব সমাজে ভিন্নমতাবলম্বী সৃষ্টি করে। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদীগণ ১৮৭৪ সালে ‘সমদর্শী’ (উদারপন্থি) দল গঠন করে এবং ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে ‘সমদর্শী সভা’ গড়ে ওঠে। এদের দাবি ছিল সাংবিধানিক অধিকার। উনিশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় জাতীয়তাবাদ চেতনা বৃদ্ধি পেলে এবং এতে প্রগতিশীল শ্রেণির অংশগ্রহণ কেশবের কাছ থেকে প্রগতিশীলদের আরও দূরে সরিয়ে দেয়। যখন দলটি তাদের গঠিত  ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এর (১৮৭৬) মাধ্যমে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু করে তখন কেশব এর বিরুদ্ধে দাঁড়ান। যদিও তিনি ১৮৬৬ সালের দিকে ভারতীয়দের পরাধীনতায় তীব্র যন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন এবং ১৮৭০ সালের দিকে জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎসাহ প্রদানে সচেষ্ট হয়েছেন, তথাপি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সমর্থনই ছিল তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করে গেছেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসন দৈব ইচ্ছার পরিপূরণ এবং কল্যাণধর্মী।

১৮৭৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জনসম্মুখে কুচবিহারের মহারাজার সাথে কেশবচন্দ্র তার নাবালিকা কন্যার বিবাহের ঘোষণা দিলে এ দু গ্রুপের মাঝে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। এ ঘোষণা যুক্তিবাদী ব্রাহ্মদের আতংকিত করে। ১৮৭৮ সালের ব্রাহ্ম বিবাহ আইন লংঘন করে কেশবচন্দ্র তার মেয়ের বিবাহকে ন্যায্যতা দেন এ বলে যে, এটি ‘ঈশ্বরের দূরদর্শিতা’। ফলে ভাঙন ছিল অবধারিত এবং ১৮৭৫ সালের ১৫ মে প্রগতিশীল গ্রুপ সাংবিধানিক ভিত্তিতে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ গড়ে তোলে। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত কেশব তাঁর সমাজের কোনো নাম দেননি।

এদিকে কেশব তাঁর সমাজ সংস্কারক চরিত্র ধরে রাখতে ১৮৭৯ সালের মে মাসে ‘আর্য নারী সমাজ’ গঠনের মাধ্যমে তাঁর সংস্কার কর্মকান্ড পুনরায় ফিরিয়ে আনেন। তবে এ সংগঠনের নামই ইঙ্গিত দেয় যে, এটি মৈত্রেয়ী, লীলাবতী, সীতা, দ্রৌপদী এবং অন্যান্যদের আদলে নিজেদের গড়ে তুলতে ব্রাহ্ম মহিলাদের অনুপ্রাণিত করে।

বিশ্বধর্ম অনুসন্ধান আবারও হয়ে ওঠে তাঁর সর্বাঙ্গীন উদ্দেশ্য। ১৮৮১ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নব বিধান’ প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংমিশ্রণে একটি নতুন সমন্বয়কারী ধর্ম গড়ে উঠেছিল এবং একই বছর এর মুখপত্র নিউ ডিসপেনসেশন প্রকাশ হতে শুরু করে। এ নতুন ধর্মে তিনি সংমিশ্রণ ঘটাতে চেয়েছিলেন এশিয়ার ‘সর্বেশ্বরবাদ’ ও ‘অতীন্দ্রিয়বাদ’-এর সাথে ইউরোপের বস্ত্তবাদ ও বিজ্ঞানকে। নব বিধানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সার গ্রাহিতা, সবকিছুর মধ্য থেকে ভালটি বেছে নেওয়া। এটি সকল ধর্মগ্রন্থ, পয়গম্বর এবং ধর্মীয় বিধিবিধানের মধ্যে সাযুজুয্য ঘোষণা করে। কেশবের মতে, ব্রাহ্ম ধর্ম একটি উদার মতবাদ যা সর্বস্থান ও সর্বসময়কে ধারণ করে।

১৮৮৩ সালে কেশব তাঁর সমাজের প্রাত্যহিক জীবনের সার্বজনীন আইন ও পথনির্দেশিকা হিসেবে নবসংহিতা সংকলন করেন। তাঁর সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূলেই ছিল বিশ্বধর্ম প্রতিষ্ঠা। ১৮৮৩ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁর শেষ ভাষণ ‘এশিয়াস মেসেজ টু ইউরোপ’-এ তিনি বৈজ্ঞানিক একতার ভিত্তিতে নব বিধানের প্রয়োজন পুনরুল্লেখ করেন যাতে সাম্প্রদায়িকতার সমাপ্তি ঘটে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে ঐক্য ফিরে আসে।

কিন্তু তাঁর সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও নববিধান জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কেশবের ভগ্ন স্বাস্থ্য এ কর্মকান্ডে বাধা প্রদান করে। ১৮৮৪ সালে ৮ জানুয়ারি কেশবের মৃত্যুর পর এটি নেতৃত্বের অভাবে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কেশব তাঁর অল্প কিছু অনুসারী রেখে যান।  [তৃপ্তি চৌধুরী]