সূর্যসেন, মাস্টারদা

সূর্যসেন, মাস্টারদা (১৮৯৪-১৯৩৪)  বিপ্লবী, ‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক। জন্ম ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। ডাক নাম কালু। বাবা রাজমনি সেন এবং মা শশীবালা দেবী। স্থানীয় দয়াময়ী বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার পর নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন এবং ১৯১২ সালে চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন।

সূর্যসেন যখন নোয়াপাড়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) কেন্দ্র করে বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। ক্রমে এই আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯১৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃঞ্চনাথ কলেজে বি.এ পড়ার সময় তিনি তাঁর এক শিক্ষক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তী কর্তৃক বৈপ্লবিক আদর্শে দীক্ষিত হন। অধ্যাপক শতীশচন্দ্র চক্রবর্তী যুগান্তর নামক বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী একটা বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। সূর্যসেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে ফিরে বিপ্লবী যুগান্তর দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করার কারণে তিনি পরিচিত মহলে ‘মাস্টারদা’ আখ্যা পান। চট্টগ্রামে তখন বিপ্লবী দলে কাজ করতেন আম্বিকা চক্রবর্তী, অনুরূপ সেন, নগেন সেন (জুলু সেন), চারুবিকাশ দত্ত সহ আরো অনেকে। কিন্তু তাঁদের তৎপরতা ছিল সীমিত পর্যায়ের। বাংলাদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর  এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। বহরমপুর থেকে ফিরে এসে সূর্যসেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিবাদমান দল দুইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

মাস্টারদা সূর্যসেন

ক্রমে তাঁর দলই চট্টগ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের ছাত্ররা ক্লাসবর্জন সহ সভা-সমাবেশ করে। সভায় সূর্যসেন তাঁর বক্তৃতায় ব্রিটিশ বিরোধী  মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী আফ্রিকা থেকে এসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষ উজ্জীবিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরাও ছাত্র ধর্মঘট, হরতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন, সভা-সমাবেশ বক্তৃতাসহ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে।

এ সময়ের দুটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। (১) ব্রিটিশ মালিকানাধীন জাহাজের শ্রমিকদের সফল ধর্মঘট এবং (২) ব্রিটিশ মালিকানাধীন সিলেট ও কাছাড়ের চা বাগান শ্রমিকদের ধর্মঘট ও চাঁদপুরে ধর্মঘটি শ্রমিকদের উপর পুলিশ এবং গোর্খা সৈন্যদের গুলিবর্ষণে অনেকের হতাহত হওয়ার ঘটনা। এ ঘটনার প্রতিবাদে আসাম-বেঙ্গল রেল ধর্মঘট শুরু হয়। এর ফলে চট্টগ্রামের কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপত ও শেখ-ই-চাটগ্রাম কাজেম আলী মাস্টারের পাশাপাশি মাস্টারদা সূর্যসেন এর নামও ছড়িয়ে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে তিনি স্কুলের শিক্ষকতা ত্যাগ করেন এবং দেওয়ানবাজার এলাকায় ‘সাম্যশ্রম’ নামের আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকেই তিনি কংগ্রেসের কাজ ও গোপনে বিপ্লবীদের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে গান্ধীজীর স্বরাজ অর্জিত না হলেও বাংলার বিপ্লবীরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে সংকল্পবদ্ধ হয়। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা মাস্টারদা এর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হন। বিপ্লব পরিচালনার জন্য নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল বলে তাঁরা প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের চট্টগ্রাম কোষাগার লুণ্ঠন করেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরই সূর্যসেন ও আম্বিকা চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বিপ্লবীদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। সূর্যসেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের জন্য ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করে শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য কসরতের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি নদীতে সাঁতার কাটা, নৌকা বা সাম্পান চালানো, গাছে আরোহণ করা, লাঠি খেলা, ছোরা নিক্ষেপ, মুষ্টিযুদ্ধের মত শারীরিক কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে নির্দেশ দেন। সেখানে তিনি বিপ্লবীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। চট্টগ্রামে তিনি ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ এর একটি শাখা গড়ে তোলেন।

১৯২৯ সালে চট্টগ্রামের জেলা কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এতে সূর্যসেন সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। একই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর লাহোর জেলে একটানা ৬৩ দিন অনশন করে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মারা যান। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা বাংলায় প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়। বিক্ষোভ মিছিল ও সভায় নেতা সূর্যসেন বিপ্লবের পরবর্তী কার্যক্রমের পরিকল্পনা সদস্যদের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবীরা স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। এর জন্য তাঁরা ‘মৃত্যুর কর্মসূচি’ ঘোষণা করেন।

প্রাথমিকভাবে হামলার দিন নির্ধারণ করা হয় ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পুলিশী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় এর তারিখ পিছিয়ে যায়। এ সময়েই গঠিত হয় সূর্যসেন এর গোয়েন্দা দল। গোয়েন্দা দলের বিপ্লবীরা চট্টগ্রামে বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তাঁদের প্রস্ত্ততি চলে। সূর্যসেন গোপনে ইস্তেহার প্রচার করেন। এতে তিনি কৌশল হিসেবে প্রচার করেন যে, ২১ এপ্রিল চট্টগ্রাম শহরের গান্ধী ময়দানে বিপ্লবীরা নিষিদ্ধ পুস্তক পাঠ করে আইন অমান্য করবেন। এতে সূর্যসেন সহ আরও কয়েকজন বিপ্লবীর নাম ছাপা হয়। কর্মসূচির প্রকৃত তারিখ ছিল ১৮ এপ্রিল।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিলের সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের দীর্ঘ সময়ের প্রস্ত্ততি ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফসল। প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে বিপ্লবের সূচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে হিংসাত্মক কর্মনীতি বা বিপ্লববাদ দেখা দেয়। খ্রিস্টানদের গুড ফ্রাইডেতে বিপ্লবীদের কর্মসূচি ছিল:

১. পুলিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। এই দলের নেতৃত্ব দেন অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষ;

২. অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখল। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন নির্মল সেন ও লোকনাথ;

৩. টেলিফোন-টেলিগ্রাফ ভবন দখল। আম্বিকা চক্রবর্তী এই দলের নেতৃত্ব দেন;

৪. ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ। দলের নেতৃত্ব দেন নরেশ রায়;

৫. চট্টগ্রামের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্বে ছিলেন উপেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য ও লালমোহন সেন;

৬. বিদ্রোহের খবর চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, অর্ধেন্দু গুহু, দীনেশ চক্রবর্তী ও হরলাল চৌধুরী।

বিপ্লবীদের ঘোষণাপত্রের প্রথমটিতে ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্দেশ্য, দ্বিতীয়টিতে ছিল দেশের যুবকদের প্রতি রিপাবলিকান আর্মিতে যোগ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদানের আহবান।

১৮ তারিখে গুড ফ্রাইডে থাকায় সেদিন ইউরোপীয়ান ক্লাবে ইংরেজ পদস্থ কর্মকর্তারা কেউ উপস্থিত ছিল না এবং অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগারে ভারী অস্ত্র মিললেও কোন গুলি পাওয়া যায়নি বলে এই দুটি ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা আসেনি। তবে সূর্যসেনের নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগৃহীত হয়। অস্ত্রাগারে আগুন লাগানোর সময় অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন বিপ্লবী হিমাংশু বিমল সেন। সূর্যসেন পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। তিনি দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, বিপ্লবী দল চট্টগ্রামে গিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করবে। সবাই এতে একমত হলে মাস্টারদা লোকনাথ বলকে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন ও বিপ্লব পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল এ সংঘটিত যুদ্ধে ১৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন। সূর্যসেন এর নেতৃত্বে দলটি পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। এদের ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। সূর্যসেনকে গ্রেফতার করতে না পারলেও সরকার ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইবুনালে শুরু করে। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে বোমা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম কারাগার ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেবার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।

এ ঘটনার পরে মাস্টারদা পটিয়ার নিকটে গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের একজন সূর্যসেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে একদল গোর্খা সৈন্য গোপন স্থানটি ঘিরে ফেলে। সৈন্যবেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সূর্যসেন ধরা পড়েন। সঙ্গে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, সুশীল দাস গুপ্ত ও মনিলাল দত্ত সহ আরও কয়েকজন বিপ্লবী।

‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার নতুন সভাপতি তারকেশ্বর দস্তিদার সূর্যসেনকে চট্টগ্রাম জেল থেকে ছিনিয়ে আনার প্রস্ততি নেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়। তারকেশ্বর এর সঙ্গে আরও কয়েকজনের গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৩ সালে সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারেকেশ্বর দস্তিদার এর ফাঁসির রায় হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কারাগারে উভয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়।  [মোহাম্মদ শাহ]