সুবাহ্

সুবাহ্ মুগল সাম্রাজ্যের প্রদেশ। সুবাহ্র দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকদের বলা হতো সুবাদার। উত্তর ভারতে মুগল অধিকার স্থিতিশীল হলে  আকবর তাঁর শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন এবং রাজত্বের ২৪তম বর্ষে (১৫৭৯-৮০ খ্রিস্টাব্দ) তার সাম্রাজ্যকে বারোটি (১২) সুবাহ্য় বিভক্ত করেন। সুবাহ্ সমূহ হলো- এলাহাবাদ, আগ্রা, অযোধ্যা, আজমীর, আহমেদাবাদ, বিহার (রাজধানী-পাটনা), বাংলা (রাজধানী- রাজমহল), দিল্লি, কাবুল, লাহোর, মুলতান এবং মালওয়া। পরে দাক্ষিণাত্যের বেরার, খান্দেশ ও আহমেদনগর (১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে এর নতুন নাম হয় দৌলতাবাদ এবং পরবর্তীতে নাম হয় আওরঙ্গাবাদ) অধিকৃত হলে সুবাহ্র সংখ্যা দাঁড়ায় পনেরোটি (১৫)। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে উড়িষ্যা ও কাশ্মির সুবাহ্র মর্যাদা পেলে, সুবাহ্র সংখ্যা হয় সতেরোটি। প্রথম সুবাহ্ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় উড়িষ্যা বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল পরে তা পৃথক সুবাহ্র মর্যাদা পায়। সম্রাট শাহজাহান-এর সময়ে সুবাহ্ এর সংখ্যা হয় বাইশটি (২২)। তিনি তাঁর রাজত্বের ৮ম বর্ষে তলঙ্গনা সরকারকে বেরার থেকে পৃথক করেন এবং একে একটি পৃথক সুবাহ্র মর্যাদা দেন। আওরঙ্গজেব ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিজাপুর এবং ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে গোলকুন্ডাকে নতুন সুবাহ্ ঘোষণা করেন। তাঁর সময়ে সুবাহ্র সংখ্যা ছিল একুশটি। ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহ্ আলমের সময়ে আর্কট প্রদেশটি মুগল সুবাহ্র অন্তর্ভূক্ত হয়।

সম্রাট আকবর কর্তৃক বাংলার একাংশ বিজয়ের পর মুগল শাসন ব্যবস্থায় প্রবর্তিত সুবাহ্ বাংলা একটি প্রশাসনিক এককে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় এ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। এই সময়ের মধ্যে সুবাহ্ বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে এর সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আবুল ফজল তাঁর  আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সুবাহ্ বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে কিছুটা বিভ্রান্তি থাকলেও এ বিবরণ থেকে সুবাহ্ বাংলার প্রাথমিক একটা তথ্যচিত্র পাওয়া যায়। যেমন-সুবাহ্ বাংলার সীমানা গড়হি (তেলিয়াগড়) থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য চারশ’ ক্রোশ (এক ক্রোশ= দেড় কিলোমিটার) উত্তরে পর্বতমালা থেকে সরকার মান্দরণের (হুগলি জেলা) দক্ষিণ সীমা পর্যন্ত প্রস্থে দু'শো ক্রোশ। উড়িষ্যা সুবাহ্ বাংলার সঙ্গে যুক্ত হলে দৈর্ঘ্যে আরও প্রায় তেতাল্লিশ ক্রোশ এবং প্রস্থ্যে আরও তেইশ ক্রোশ বৃদ্ধি পায়। সুবাহ্ বাংলার পূর্বে সমুদ্র এবং দক্ষিণে পর্বতমালা, পশ্চিমে বিহার এবং পূর্বে ভাটি অঞ্চল অবস্থিত যা বাংলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলার উত্তরে কোচ, কামরূপ ও কামতা রাজ্য। এই রাজ্যের সীমান্তেই আসাম অবস্থিত। সুবাহ্ বাংলার দক্ষিণ-পূর্বে আরাকান এবং এখানেই চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। আবুল ফজলের দেয়া তথ্যে যে ভুলটি ছিল তা হলো, বাংলার পূর্বে সমুদ্র না বরং ত্রিপুরা রাজ্য অবস্থিত ছিল এবং দক্ষিণে শুধুই সমুদ্র, পর্বতমালা ছিল না। অবশ্য আবুল ফজল ১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা শেষ করার প্রায় একযুগ আগে সুবাহ্ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল এবং বাংলা দুর্বলভাবে হলেও সুবাহ্ ব্যবস্থার অধীনে এসেছিল। সে সময়ে সুবাহ্ বাংলার আয়তন ছিল কম। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে আফগান শাসক  দাউদ খান কররানী মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলে বাংলা থেকে আফগান শাসনের অবসান হয় এবং মুগল শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু তখন সারা বাংলা মুগল আধিপত্য স্বীকার করেনি। কারণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আফগান সেনানায়ক এবং বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। তাছাড়াও বাংলায় অবস্থানরত মুগল সৈন্যদের একাংশও বিদ্রোহ করেছিল। ফলে আকবর প্রশাসনের অধীনে সুবাহ্ বাংলার বিস্তৃতি থেমে থাকে। ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের মৃত্যুর সময় সুবাহ্ বাংলার সীমানা ছিল, উত্তরে ঘোড়াঘাট, দক্ষিণ-পশ্চিমে সাতগাঁও ও বর্ধমান, পূর্বে করতোয়া নদী এবং বগুড়া জেলার শেরপুর মোর্চার বরাবর একটি সমান্তরাল এলাকা এবং পশ্চিমে রাজমহল। অর্থাৎ আবুল ফজল-এর বর্ণিত সুবাহ্ বাংলার সীমানা সতের শতকের শুরুতে প্রকৃতপক্ষে এমনটাই ছিল। যদিও তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম মুগলদের অধিনস্ত হয়নি। চট্টগ্রাম অঞ্চল সুবাহ্ বাংলার অধিনস্ত হয় ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর সময়ে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে  ইসলাম খান চিশতি বাংলার সুবাহ্দার নিযুক্ত হলে তাঁর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কৌশল বাংলার জন্য যথার্থভাবে কার্যকর হয় এবং সুবাহ্ বাংলার সীমানা বৃদ্ধি পায়। ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় আসেন এবং  ঢাকাকে সুবাহ বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর নাম করেন  জাহাঙ্গীরনগর।  মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক ত্রিপুরা, বিহারের ভাগলপুর এবং পূর্ণিয়ার কিছু অংশ সুবাহ্ বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আঠারো শতকে মেদেনীপুর বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত হলে মুগল সুবাহ্ বাংলার সীমানা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। যেমন, উত্তরে পর্বতমালা, উত্তর-পূর্বে আসামের হাজো, পূর্বে ত্রিপুরা, দক্ষিণে সমুদ্র, দক্ষিণ-পূর্বে  আরাকান, দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যা এবং পশ্চিমে বিহার।

১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ, সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খানকে বিহারের সুবাহ্দার নিযুক্ত করলে এই প্রথম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ তিনটি একক ভাবে একজন সুবাহ্দারের অধীনে আসে। কারণ ইতিপূর্বে বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাহ্দারী একজন সুবাহ্দার-এর ওপরে ন্যস্ত ছিল। এ সময় থেকে বাংলায় নায়েব পদটির সৃষ্টি হয়। সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান তাঁর সুবাহকে চারটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত করেন এবং একটিতে নিজ কর্তৃত্ব সরাসরি বহাল রেখে বাকি তিনটি বিভাগের প্রশাসনের দায়িত্ব নায়েব বা প্রতিনিধিদের ওপর ন্যস্ত করেন। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে  আলীবর্দী খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারী লাভ করেন এবং একপ্রকার স্বাধীনভাবে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কারণ ততদিনে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল।

কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সুবাহ্ বাংলার পৃথক গুরুত্ব পেত। বাংলার সুবাদারের পদ খালি হলে বিহারের সুবাদারকেই বাংলার সুবাহ্দার এর পদ প্রদানের প্রথা আকবরের সময় থেকে প্রচলিত হয়। ইসলাম খান চিশতী বিহার থেকেই বাংলার সুবাদার নিয়োগ হয়েছিলেন। অর্থাৎ বাংলার সুবাদারি লাভ করা ছিল পদোন্নতি লাভ করার মতো সম্মানীত একটি ব্যবস্থা। আকবরের সময়ে সুবাহ্ সৃষ্টির পর প্রত্যেক সুবায় একজন করে সিপাহসালার, দীউয়ান, বকশী, সদর,  কাজী, কোতোয়াল, মীর বহর এবং  ওয়াকিয়ানবিশের পদ সৃষ্টি করা হয়। ইতিপূর্বে মুগলদের প্রদেশের শাসনের শাসককে সিপাহসালার বলা হতো। সতের শতকে এসে একই পদ ‘সুবাহ্দার’ বা ‘সুবাহ্’ নাম ধারণ করে। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ দিকে তার নাম হয় ‘নাজিম’। মোগল শাসনের শেষ পর্যন্ত নাজিম শব্দটি চালু ছিল, যদিও সুবাহ্দার শব্দটি পুরোপুরি বাদ যায়নি। সুবাহ্দার অর্থ সুবাহ্র রক্ষক বা শাসক। প্রকৃতপক্ষে সুবাহ্দারেরা সম্রাটের নায়েব বা প্রতিনিধিরূপে সুবাহ্ শাসন করতেন। সুবাহ্র সাধারণ শাসন, প্রতিরক্ষা এবং ফৌজদারি বিচারের ভার সুবাহদারের ওপর ন্যাস্ত ছিল। প্রত্যেকটি সুবাহ্ আবার কয়েকটি সরকারে এবং প্রত্যেক  সরকারকে কয়েকটি পরগণা বা মহলে বিভক্ত করা হয়েছিল। আইন-ই-আকবরীতে সুবাহ্ বাংলার উনিশটি সরকারের নাম পাওয়া যায়।

সতের শতকের শুরুতে মুগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলে অধিকাংশ সুবাহ্ স্বাধীন হয়ে যেতে থাকে এবং কোন কোন সুবাহ্ মারাঠা ও ব্রিটিশদের অধীনস্ত রাজ্যে পরিণত হয়।  [নাসরীন আক্তার]