সিঁদুর

সিঁদুর বিবাহিতা হিন্দু নারীরা তাদের কপালে এবং সিঁথিতে ব্যবহার করেন। এটি লাল রংয়ের এক ধরনের পাউডার বা চূর্ণ। এটি বিবাহের একটি রীতি এবং স্পষ্টত তা প্রাচীন আদিবাসী সংস্কৃতির একটি আচার।

মানব সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি রীতি বিবাহের স্বীকৃতিস্বরূপ সিঁদুরের ব্যবহার প্রাচীন আদিবাসী সমাজে অবশ্য পালনীয় ছিল। আজও লোধা সমাজে কনের কপালে এবং সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে বিবাহ হয়। এ সময় পুরোহিত বা ‘দেহেরি’ ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায় যেন বর-কনে সুখে-শান্তিতে সংসার করে। এদের বিবাহে কোন মন্ত্রপাঠ করা হয় না। খড়িয়া সমাজে সকলের সামনে কনে সম্প্রদান হলে বর ও কনে নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে পরস্পরের কপালে সাত বার সিঁদুর লেপন করে। সঙ্গে সঙ্গে মালা বদল ও গাঁটছড়াও বাঁধা হয়। সিঁদুর দানের পরেই ধামসা-মাদল বেজে ওঠে।

সিঁদুর পরিহিত নারী

শবরদের বিবাহ দেয় ব্রাহ্মণ-পুরোহিত। কন্যা সম্প্রদান হলে বর কড়ে আঙুলে সিঁদুর নিয়ে কনের সিঁথিতে সাত বার লাগিয়ে দেয়। কনেও সেরকম বরের কপালে সাত বার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। এরপর মিলনের নিদর্শনস্বরূপ মালা বদল হয়। ভূমিজ সম্প্রদায়ের পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করে কন্যা সম্প্রদান করেন। পরে বর ডান হাতের কড়ে আঙ্গুল দিয়ে তিন বার কনের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। এ সময় বর ও কনের হাত এক করে দেওয়া হয় এবং তারপরই বর কনের হাতে বালা পরিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে গাঁটছড়াও বাঁধা হয়। হো জনগোষ্ঠীর বিবাহে সাধারণত চারটি বিষয়ের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। প্রথমত, বরপক্ষকে অতি অবশ্যই কন্যাপণ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বর অতি অবশ্যই কনের কপালে কিংবা সিঁথিতে সিঁদুর দেবে। তৃতীয়ত, বিবাহের পর বরের বাড়িতে পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে যে জমসং অনুষ্ঠান হয় সেখানে অতি অবশ্যই নববধূকে হাজির থাকতে হবে। চতুর্থত, বিবাহের পর কনের বাড়িতে এবং বরের বাড়িতে ভোজের ব্যবস্থা করে গ্রামের পাঁচ জনের কাছ থেকে সামাজিক স্বীকৃতি পেতে হবে। হো সমাজের বিবাহরীতির আরেকটি প্রথা হলো ছেলে তার বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্যে মেয়েকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কপালে সিঁদুর দেয়া। হাটে, বাজারে, মেলায় কিংবা অন্যকোন প্রকাশ্য স্থানে কোন মেয়ের কপালে কোন ছেলে যদি জোর করে সিঁদুর লাগিয়ে দেয় তবে সেই মেয়ে হবে তার বৈধ স্ত্রী। পূর্বে হামেশাই এ ধরনের ঘটনা দেখা যেত, কিন্তু বর্তমানে এমন কাজ সমাজে দূষণীয় বলে ধরা হয়।

বিরহো সমাজের বিবাহে বর ও কনের কড়ে আঙুল থেকে সামান্য এক ফোটা রক্ত বের করা হয় এবং সেই রক্ত একটুকরো কাপড়ে লাগিয়ে বর ও কনেকে দেওয়া হয়। তারা সেই রক্তমাখা কাপড়ের টুকরাটি পরস্পরের গলায় তিন বার ছোঁয়ায়। পরে বর মাটিতে তিন ফোঁটা তেল ফেলে তার উপর সিঁদুর ঢালে এবং সকলের সামনে কনের সিঁথি ও কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সিঁদুর দেওয়ার অর্থ বিবাহ সম্পন্ন হলো এবং পাত্রীর ওপর পাত্র পূর্ণ অধিকার পেল। মুন্ডা জনগোষ্ঠীর বিবাহে বর এবং কনে পরস্পরের কপালে সিঁদুর দিয়ে তিনবার দাগ কাটে আর মালা বদল করে। মাহালিদের বিবাহে বর কনের সিঁথিতে পাঁচবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়, তবে এর আগে অবশ্যই কনের বাবাকে পণের টাকা মিটিয়ে দিতে হয়। সাঁওতাল সমাজে বহু ধরনের বিবাহ আছে, তবে সব রীতিতেই সিঁদুর ব্যবহূত হয়। সাধারণত বর তিন বার মাটিতে সিঁদুর ফেলে পুবদিকে মুখ করে সূর্যদেবকে সাক্ষী রেখে কনের সিঁথিতে তিনবার সিঁদুর লেপে দেয়। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভালবাসা হওয়ার পর ছেলে কিংবা মেয়ের অবিভাবকরা যদি বিবাহে আপত্তি করে তাহলে ছেলে একদিন সুযোগ বুঝে জোর করে মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। মেয়েটি তখন আইনত তার স্ত্রী হয়ে যায়। সাঁওতালদের বিশ্বাস কোন মেয়ের সিঁথিতে মাত্র একবারই একটি ছেলে সিঁদুর দিতে পারে এবং তাতেই তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিধবা কিংবা স্বামী-পরিত্যক্তা মেয়ের সঙ্গে বিবাহ হলে ছেলে মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর দেয় না, একটা সাদা ফুলে তিন বার সিঁদুর লাগিয়ে খোপায় গুঁজে দেয়।

বিবাহিতা নারীর সিঁথির সিঁদুর আয়তির লক্ষণ হলেও সমগ্র ভারতের সকল অঞ্চলের মহিলারা এই চিহ্ন ধারণ করেন না। বিবাহকালীন ও বিবাহোত্তর আচার ব্যবহারে বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে অন্য ভাষাভাষী হিন্দুর অনেক তফাৎ। বাঙালি সধবার শাঁখা-সিঁদুর অপরিহার্য ভূষণ। স্বামী মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিবাহিতা নারী শাঁখা-সিঁদুর ফেলে দিয়ে আপন বৈধব্য ঘোষণা করে।

আদিবাসী সমাজে সৌভাগ্য ও বিজয়ের প্রতীক হিসেবে সিঁদুরের ব্যবহার হয় এবং এই বোধ থেকেই একটি অপহূতা কন্যার কপালে সিঁদুর লাগিয়ে তার ওপর অধিকার ঘোষণা করা হয়। প্রাচীনকালে সিঁদুর কপালে লাগিয়ে বশীকরণ করা হতো। ডাকাতরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে ও কেউ কেউ কোন দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে সাফল্য এবং রক্ষাকবচ হিসেবে কপালে সিঁদুরের টিপ লাগিয়ে নিত। প্রাচীনকালে নারীরা তাদের ঠোঁট লাল করার জন্য সিঁদুর ব্যবহার করত, যেমন এ যুগের মেয়েরা লিপস্টিক ব্যবহার করে।  [এনামুল হক]