সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক

সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক  একটি সম্প্রদায়ের মৌলিক নীতিমালা, যেগুলো সে সম্প্রদায়ের সকল সদস্যকে পারস্পরিক মেলবন্ধনে আবদ্ধ করে এবং একইভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একটি রাষ্ট্রের কাঠামোতে আবদ্ধ রাখে। কোনো কোনো সময়ে এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে এবং দেখা দেয়ও; এসব বিরোধের ন্যয়সঙ্গত সমাধান করা না হলে তা সুদূর প্রসারী পরিণাম বয়ে আনে।

ঐতিহাসিকভাবে, এদেশের সম্প্রদায়গুলোর বৈশিষ্ট্য এবং পারস্পরিক সম্পর্ক চিহ্নিত করার সবচেয়ে উপযুক্ত মানদন্ড হিসাবে ধর্মকে গ্রহণ করা যায়। এর কারণ এই যে, বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও উপ-ব্যবস্থা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সাহিত্য ও দর্শন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ধর্মই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। পূর্বে ধর্মই ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ ও শাসনের জন্য দিকনির্দেশনার প্রধান উৎস। অবশ্য, বাংলার আদি ইতিহাসই এদেশের জনগণকে তাদের জাতগোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। খ্রিস্টীয় যুগ শুরু হওয়ারও অনেক পূর্বে যখন বাংলায় আর্যায়নের ধারা অব্যাহত ছিল, তখন জনগণের পরিচয় শনাক্ত করার প্রধান মানদন্ড ছিল জাতিত্ব (ethnicity)। দেশের শাসন-ক্ষমতার অধিকারী আর্যদের চোখে এদেশীয় অনার্যরা ছিল ব্রাত্য জাতি অর্থাৎ আর্য সংস্কৃতির চেয়ে অনেক নিম্নমানের প্রাকৃত সংস্কৃতির ধারক জনগোষ্ঠী। একইভাবে, পরাভূত প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর চোখে আর্যরা ছিল ভিন্ন সংস্কৃতি তথা সংস্কৃত সংস্কৃতির ধারক জাতি  বা সম্প্রদায়। যদিও আর্য ও অনার্যরা কিছুকালের জন্য পরস্পরের মধ্যে একটা দূরত্ব বা ব্যবধান বজায় রাখে, এমনও প্রমাণ পাওয়া যায় যে প্রাকৃত সংস্কৃতি তার আত্তীকরণ ক্ষমতাবলে সংস্কৃত সংস্কৃতিকে তার অঙ্গীভূত করতে সক্ষম হয় এবং তদ্বারা প্রভূত পরিমাণে লাভবান হয়। ধারাবাহিক আত্তীকরণপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বঙ্গীয় সমাজের বৃহত্তর অংশকে আর্য-সদৃশ করে তোলা হয়, অথচ এ প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতের সাংস্কৃতিক প্রাধান্য পুরোপুরি বজায় থাকে, যা আর্য আগ্রাসনের মুখে শুধু যে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে তা নয়, বাংলা সহ বহু দেশীয় ভাষার উদ্ভব ঘটায়।

উপর্যুক্ত আর্যায়ন প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত মূল নৃগোষ্ঠী পর্যায়ের (এথনিক) জাতিগুলোকে (আর্য ও অনার্যদের) একটি বর্ণসোপানে বিভক্ত করে। তথাপি আর্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরেও জাতি টিকে ছিল। জাতিগুলোর আরোপিত উৎকৃষ্টতা বা নিকৃষ্টতার ভিত্তিতে প্রতিটি প্রধান বর্ণ তার মধ্যে কতিপয় উপবর্ণ গড়ে তোলে। যখন জনগণকে বর্ণ এবং জাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তখন আঞ্চলিকতাকে কখনো এর একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয় নি, যদিও একথাও সত্য যে বাংলার বিশেষ এলাকা প্রধানত অধ্যুষিত ছিল একটি বিশেষ জাতি দ্বারা।

এদেশের সামাজিক সংগঠনের অন্তর্গত বর্ণপ্রথার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, কোনো বিশেষ বর্ণের লোক অন্য বর্ণের বৈধতা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করে নি। কারো পক্ষে বর্ণ পরিবর্তন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছিল বিধায় অন্য বর্ণ ও ধর্মের প্রতি সহনশীলতা বাস্তব কারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা বিপুলসংখ্যক ব্রাহ্মণকে মন্ত্রী ও স্থানীয় প্রশাসকের পদে নিয়োগ দান করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। পালদের উত্তরসূরি সেন রাজারাও একই পথ অনুসরণ করেন। তাই রাজবংশের পরিবর্তন ঘটলে কদাচিৎ সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখা দিত। গ্রামীণ সমাজে কাঠামোগতভাবে সম্প্রদায় ছিল অধিকতর বাস্তবধর্মী। যেহেতু গ্রাম পর্যায়ে সামাজিক উৎপাদনকার্যে নিয়োজিত জনগণের কোনো বর্ণকে বিচ্ছিন্ন করা সহজসাধ্য ছিল না, সেহেতু জনগণ একই দেবতা বা দেবীকে গ্রামের উপাস্য হিসাবে গ্রহণের মাধ্যমে আন্তঃসম্প্রদায় ঐক্য প্রতিষ্ঠার কৌশল উদ্ভাবন করে, যে দেবতা বা দেবীকে বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই পূজা করত।

দীর্ঘকাল ব্যাপী বিভিন্ন শাসনামলে প্রাকৃত, আর্য, ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন সূত্র থেকে উৎসারিত সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া এবং পারস্পরিক প্রভাব এক মহান আন্তঃধর্ম এবং আন্তঃবর্ণ সমন্বয়ধর্মী ঐতিহ্য গড়ে তোলে, যার আওতায় বাংলার সকল জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতির জনগণ গুরুতর কোনো বিরোধে লিপ্ত না হয়ে একত্রে বাস করে এসেছিল, যদিও এই অঞ্চলের রাজাকে ঘন ঘন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু এসব যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হতো আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য, ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সংহতি বিনষ্ট করার জন্য নয়। এমনকি, তুর্কি-আফগানরা এদেশে এসেছিল ধর্মযোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং এসেছিল এদেশ জয় করার উদ্দেশ্যে। পন্ডিতগণ এ বিষয়ে একমত যে, মুসলিম সুফি-সাধক ও পর্যটকগণই বাংলার অসংখ্য অমুসলমানকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। মুসলিম শাসকগণ এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালন করেন নি। তারা তাদের পূর্বসূরি পাল ও সেন রাজাদের মতো স্থানীয় জনগণকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দানের মাধ্যমে দেশ শাসনে অংশীদার করেন এবং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ভূমি দান করে সহায়তা প্রদান করেন।

মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে বৃহত্তর বাংলা রাজনৈতিকভাবে ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে একটি ছিল বঙ্গ। এ ছাড়া পূর্ব বাংলায় আরও রাজ্য ছিল, যেমন হরিকেল (সিলেটে অবস্থিত বলে অনুমান করা হয়), সমতট (কুমিল্লা অঞ্চলে অবস্থিত), পট্টিকেরা (কুমিল্লা-নোয়াখালি) এবং চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল)। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যগুলো ছিল কাজাঙ্গাল (দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা), তাম্রলিপ্তি (মেদেনীপুর), সুহ্মভূমি (বর্ধমান, হুগলি ও হাওড়ার অংশবিশেষ)। মধ্যবঙ্গ ছিল কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ এলাকা), বরেন্দ্র (রাজশাহী এলাকা), গৌড় (মুর্শিদাবাদ, বিরভূম, মালদহ ও বর্ধমান) এবং পুন্ড্রবর্ধন (বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী এলাকা)। ধারণা করা হয় যে, এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়টি রাজ্য উপজাতীয় জনগণ দ্বারা উপজাতীয় পদ্ধতিতে শাসিত হতো এবং অন্য রাজ্যগুলো গোত্রীয় পদ্ধতিতে শাসিত হতো, কারণ এই এলাকায় তখনো সম্প্রসারণবাদী রাজতন্ত্র গড়ে ওঠে নি। পনেরো ও ষোল শতকে, বিশেষত হোসেনশাহী বংশের রাজত্বকালে (১৪৯৮-১৫৩৮) যখন প্রায় গোটা বাংলাদেশ একটি একক স্বাধীন শাসনকর্তার অধীনে আসে, তখন তুর্কি-আফগান শাসকদের অধীনে পর্যায়ক্রমে বাংলার রাজনৈতিক একীভবন ঘটে। হোসেনশাহী শাসকগণও একীভূত রাজ্যের নামকরণ করেন শাহ-ই-বাঙ্গালা, যা ছিল পরবর্তীকালের ‘সুবা বাংলা’ এবং আরও পরবর্তী কালের ‘বাংলা’র পূর্বসূরি।

লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, সমকালীন অন্য অনেক রাজনীতির মতো বাংলার রাজনীতিতে রাজনৈতিক একীভবনের সাথে ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির একই রকম একীভবন যুক্ত ছিল না। তুর্কি-আফগান শাসকগণ ছিলেন খুবই বিচক্ষণ, যেকারণে তারা তাদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানকে বিজিত সম্প্রদায়গুলোর উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেন নি, বরং পূর্ববর্তী শাসনামলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক মিলনের মহান ঐতিহ্যকে তারা সযত্নে লালন করেছেন। মুলক শাহীর (রাষ্ট্রের) সকল সম্প্রদায় যেন তাদের নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস ও জীবনপদ্ধতি নিয়ে সম্প্রীতিপূর্ণ পরিবেশে এক সাথে বাস করে সেদিকে কেন্দ্রীয় সরকার লক্ষ্য রাখত। সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্থানীয় সকল বর্ণ ও ধর্মসম্প্রদায়ের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার নিজস্ব ধর্ম ও রীতিনীতি অনুযায়ী জীবনযাপনের অনুমতি দেওয়া হতো, অন্যরা এতে কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারত না। এভাবে সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামহিন্দুধর্ম পারস্পরিক সহনশীলতার পরিবেশে একে অপরের সংস্পর্শে এসেছিল। উভয় ব্যবস্থাই লক্ষণীয় কোনো বিরোধ ব্যতীত পরস্পরকে প্রভাবিত করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। একটি সক্রিয় শক্তি হিসাবে সমন্বয়বাদ দুটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার সংকটজনক বিরোধগুলো শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে ফেলেছে এবং পরিণামে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের মিলন ঘটিয়েছে। ভক্তি আন্দোলন এবং সত্যপীর ও বদরপীরের ভক্তিবাদ হচ্ছে দুটি ধর্মের অবাধ মিথস্ক্রিয়ার ফলশ্রুতি। লোকবিশ্বাস এতটাই অগ্রসর হয়েছিল যে, তা ইসলাম ও হিন্দুধর্মের সাধু-দরবেশদের একই রূপে বিভিন্ন রূপের প্রকাশ বলে গণ্য করে।

আন্তঃসম্প্রদায় সমন্বয়বাদ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মহান ঐতিহ্য বরাবর অক্ষুণ্ণ ছিল। মুগল শাসনামলে তা আরও শক্তি অর্জন করে। মুগল রাষ্ট্র স্থানীয় হিন্দু অভিজাত শ্রেণীকে ক্ষমতা ও সম্পদের অংশীদার করে রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে। এ পর্যায়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কার রাজনৈতিক একত্রীভবন দ্বারা প্রভাবিত হয় নি এবং সুবা বা প্রদেশের কাজ ও চাকুরিগুলো কম-বেশি সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগকে রাখা হয় মুগল সামরিক অভিজাতদের এখতিয়ারে, আর রাজস্ব প্রশাসন, ভূমি নিয়ন্ত্রণ, সিভিল সার্ভিস, স্থানীয় প্রশাসন ও সরবরাহ বিভাগ ছিল হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল স্থানীয় হিন্দু বণিক, মূর, মারোয়াড়ি, ইউরো-এশীয় বণিক এবং সমুদ্রবাণিজ্যে নিয়োজিত ইউরোপীয়দের হাতে। এ ধরনের ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণের যে ঐকমত্য ছিল তা এ সত্যেরই প্রমাণ বহন করে যে, মুগল শাসনামলে এদেশে গুরুতর ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক বিরোধ কদাচিৎ দেখা দিত। তথাপি, কখনো কখনো হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, এমন কি দাঙ্গাও সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। দুর্গাপূজা ও মহরম উপলক্ষে ধর্মীয় শোভাযাত্রার মসজিদ মন্দির এবং অন্যান্য পবিত্র স্থান অতিক্রমণ, গরু জবাই করা, মসজিদের সামনে উচ্চশব্দে গান বাজানো ইত্যাদি ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা স„ৃষ্টর সাধারণ কারণ। কিন্তু এ ধরনের উত্তেজনা খুব কম ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল স্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দিত। মোহতাসাম, ফৌজদার, কোতোয়াল, জমিদার, আমিল, কানুনগো এবং কাজিগণ সরকারি নির্দেশ মোতাবেক সামাজিক মনোবল ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। সরকার বিভিন্ন এলাকায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ এলাকার মধ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক গোলযোগসহ সকল অপরাধের জন্য দায়ী করতেন।

বাঙালি মুসলমানরা প্রধানত সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু নবাবী আমলে বাংলার শাসকশ্রেণী ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। মুগল শাসনামলের শেষদিকে শিয়া-সুন্নি বিরোধও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই বিরোধ ছিল মহরমের অস্বাভাবিক অবস্থার ফল এবং বরাবরই ছিল ক্ষণস্থায়ী। এছাড়া হিন্দুদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক বিরোধ দেখা দিত। মুগল শাসনামলে অসংখ্য সমন্বয়বাদী সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের উদ্ভব (বৈষ্ণববাদ একাই এ ধরনের ২৮টি উপ-সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছিল) ব্রাহ্মণ্য নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করতে সাহায্য করে। ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীরা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন এবং তদনুযায়ী আচরণ করতে গিয়ে প্রায়ই ক্ষমতাধর সম্প্রদায়ের বিরোধিতার সম্মুখীন হতো। এছাড়া রাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ সর্বদাই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সম্পর্কে সতর্ক থাকতেন এবং সাম্প্রদায়িক বিরোধ যেন তীব্রতর হয়ে বিরাট আকারের সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভ ও অস্থিরতার সৃষ্টি না করে সেদিকে নজর রাখতেন।

সতেরো শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে ইউরোপীয় ও ইউরো-এশীয় নৌ-বণিকগণ যোগ দিলে বাংলায় সাম্প্রদায়িক গঠনবিন্যাস ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। বাণিজ্য উপলক্ষে বাংলার বিভিন্ন স্থানে পর্তুগীজ, ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, গ্রিক, আর্মেনীয় প্রভৃতি ইউরোপীয় এবং ইউরো-এশীয় বণিকদের বাণিজ্যিক উপনিবেশ ও শাখা স্থাপন বাংলার সমাজ ও অর্থব্যবস্থায় নতুন উপাদান যুক্ত করে। কলকাতা, চন্দননগর, চুচুঁড়া, শ্রীরামপুর ও হুগলির মতো স্থানে সাম্প্রদায়িক ধারায় ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক শহর গড়ে ওঠে। যদিও ইউরোপীয়গণ এবং তাদের সহযোগী দেশীয় বণিক ও আমলাগণ এদেশের হাট বাজার, আড়ং, ডক ও বাণিজ্যজাহাজ-সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পরিপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করত, তথাপি তারা শ্বেতাঙ্গদের এলাকা থেকে দূরে বাস করাই শ্রেয় মনে করত। বাংলায় ইউরোপীয়দের প্রতিটি শহর স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠে দুটি অংশ নিয়ে, শ্বেতাঙ্গ শহর এবং কৃষ্ণাঙ্গ শহর। এ দুটি শহরের মধ্যে কোনো ভৌত ও সাংস্কৃতিক সংযোগ ছিল না এবং এরা ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করা যায়, এরূপ বিচ্ছিন্নতা মূলত গড়ে উঠেছিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সামাজিক-ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন বর্ণগোষ্ঠীর চাহিদার তাগিদে শহরে অবস্থানরত দেশীয়দের জন্য ‘ফিরিঙ্গি’দের থেকে স্থানিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে, যাদেরকে তারা অস্পৃশ্য বলে গণ্য করত। আবার, ফিরিঙ্গিরাও তাদের নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, খাদ্যাভ্যাস, গৃহসংস্থান, পরিবহন, আপ্যায়ন, বিনোদন ইত্যাদির তাগিদে দেশীয়দের থেকে দূরবর্তী অবস্থানে বাস করার ইচ্ছা পোষণ করত। অবশ্য, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভাষা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কিন্তু আঠারো শতকে শহর এলাকায় যে ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল, উনিশ শতকে তা একটি সাম্প্রদায়িক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ইতোপূর্বে ইউরোপীয়রা শহরের দেশীয় অংশে তাদের সহযোগীদের দ্বারা আয়োজিত মেলা ও উৎসবে অংশগ্রহণকে সাম্প্রদায়িক ও ব্যক্তিগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে নিয়েছিল। তারা পূজা ও বাইজির নাচ (নৃত্যানুষ্ঠান)-এ আমন্ত্রিত হতো, যেগুলোতে তারা প্রবল উৎসাহ নিয়ে অংশগ্রহণ করত। গৃহস্থালির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের প্রায় সকলেই দেশীয় আয়া ও চাকর নিয়োগ করত এবং তাদের অনেকে দেশীয় মহিলাকে বিয়ে করত। কিন্তু উনিশ শতকে সামাজিক পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গের সাথে কৃষ্ণাঙ্গের বিয়ে ও আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠার রীতি কার্যত লুপ্ত হয়ে যায় যখন ব্রিটিশরা সম্প্রদায় হিসাবে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক দিয়ে ভারতীয়দের চেয়ে উচ্চতর বলে গণ্য করত। তখন ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক ঔদ্ধত্য এত বেশি বৃদ্ধি পায় যে তারা ভাবতে শুরু করে, ভারতীয়দের ‘সভ্য’ করে তোলা তাদের পবিত্র দায়িত্ব।

উনিশ শতকে ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় বিভাগসমূহে (অসামরিক চাকুরি, পুলিশ, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী ইত্যাদিতে) কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত রেলওয়ে, অন্তর্দেশীয় ও বহির্দেশীয় নৌবাহ (navigation), বৃক্ষরোপণ, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রকৌশল কর্মকান্ড, শিক্ষা, মিশনারি, ভূমিনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিতে ইঙ্গ-ভারতীয়রা নিয়োজিত হতো। যদিও অভ্যন্তরীণভাবে ইঙ্গ-ভারতীয়দের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাস ও পদসোপান বিদ্যমান ছিল, তথাপি দেশীয়দের তুলনায় তারা ছিল গাত্রবর্ণ, আয়, জীবনপদ্ধতি, সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও অভ্যাসের দিক দিয়ে একটি সমরূপ (homogeneous) সম্প্রদায়।

ইঙ্গ-ভারতীয়রা সর্বদাই শাসক হিসাবে ছিল অত্যন্ত সচেতন এবং তারা উচ্চ জাতি হিসাবে গর্ব বোধ করত। তাই তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তুলেছিল একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়। পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে গঠিত ক্লাব, রেলওয়ে ও স্টীমার সেলুন, শপিং অর্কেড, ক্রীড়াসমিতি, থিয়েটার ইত্যাদি দেশীয়দের মনে এই ধারণার জন্ম দেয় যে সাম্প্রদায়িকভাবে ইঙ্গ-ভারতীয়রা সকল দিক দিয়ে তাদের থেকে পৃথক। দেশীয়রা ব্যথিত হয় যখন তারা দেখতে পায় যে আইনের চোখেও ইঙ্গ-ভারতীয়রা নিজেদের একটি পৃথক শ্রেণীতে পরিণত করেছে। দন্ডবিধির আওতায় শাসক সম্প্রদায়ের উপর দেশীয় বিচারকদের কোন বৈধ কর্তৃত্ব ছিল না।

উদারমনা গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপন (১৮৮০-১৮৮৪) এই পার্থক্য দূর করতে প্রয়াসী হলে ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায় তা প্রতিরোধ করে। রিপনের সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ভারতীয়দের আন্দোলন শাসক ও শাসিত সম্প্রদায়ের সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঘটায়। এই বিরোধ স্বাজাত্যপ্রীতির রূপ পরিগ্রহ করে। ওহাবী মুসলমান এবং জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। শ্বেতাঙ্গ শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন বিভিন্ন রূপ ধারণ করে; এগুলোর কোনটা ছিল শান্তিপূর্ণ এবং কোনটা ছিল প্রচন্ড। উনিশ শতকে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্কার আন্দোলন ছিল পরোক্ষভাবে খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগ অনুসরণে গৃহীত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি। স্বদেশী আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন এবং অবশেষে ভারত ছাড় আন্দোলন ছিল শ্বেতাঙ্গ শাসকদের ঔদ্ধত্যের সমুচিত রাজনৈতিক জবাব।

ব্রিটিশদের বর্ণবাদ ভিত্তিক শাসন এদেশের আত্তীকরণমুখী ও সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ফলে বর্ণবাদী ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ঘৃণা পরবর্তীকালে হিন্দু ও মুসলমানদের সম্পর্ককেও তিক্ত করে তোলে। ফলে হিন্দু-মুসলমানের যুগপ্রাচীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদারুণ অবনতি ঘটে এবং বিশ শতকে এসে দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক সংঘাতময় হয়ে দাঁড়ায়, যা পরিণামে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার বিভক্তি অনিবার্য করে তোলে। বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা বাংলা বিভাগকে দুটি বিপরীত মেরু থেকে মূল্যায়ন করেছিল। ১৯০৯ সালের ভারতশাসন আইন মোতাবেক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন ছিল দুই সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা এবং সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ।

হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে ভাঙন এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের কিছু বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যার ভয়াবহ স্মৃতি কখনো মুছে যাবে না। দাঙ্গা হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরণের ঘটনা এবং তা পুরনো সম্পর্ককে অকার্যকর ও মূল্যহীন প্রমাণ করে। বাংলার ইতিহাসে দুর্গাপূজা, মহরমের মিছিল ও গরু জবাই উপলক্ষে সাময়িক ও অল্পকাল স্থায়ী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক শ্লোগান নিয়ে সংগঠিত, দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং বহু বিস্তৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল বিশ শতকেরই ঘটনা। পূর্বকালে উত্তেজিত জনতাই সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত এবং তা প্রশমিত করত সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ১৯৪০-এর দশকে নেতারা নিজেরাই (অবশ্য সবাই নয়) দাঙ্গায় জনতাকে পরিচালনা করতেন। এসময়ে দাঙ্গাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে সংগঠিত রূপ ধারণ করে। এর চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে ১৯৪৬ সালে কলকাতার ব্যাপক হত্যাকান্ডে। কলকাতার এই মহাহত্যাযজ্ঞ ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলার বিভাজন অপরিহার্য করে তোলে।

বাংলাবিভাগের পর পূর্ববাংলা থেকে বহুসংখ্যক হিন্দু এবং ভারত থেকে বহুসংখ্যক মুসলমান দেশত্যাগ করে। তখন ভারত থেকে বাংলায় আগত বাংলাভাষী মুহাজিরগণ  অবিলম্বে বাংলার মূল সমাজের সাথে মিশে যায় এবং নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু অবাঙালি মুহাজিরগণ তাদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যের কারণে একটি পৃথক সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে আবির্ভূত হয়। সরকারি নীতি অনুযায়ী অবাঙালি মুহাজিরদের জন্য পৃথক আবাসিক এলাকা নির্ধারিত হওয়ায় এবং অঘোষিতভাবে হলেও তাদের জন্য চাকুরিতে অগ্রাধিকার কোটা নির্ধারিত হওয়ায় তাদের স্বাতন্ত্র্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবাঙালি মুহাজির নামের ধ্বজা তুলে তারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে চেষ্টা করে। এদের অধিকাংশই ছিল দক্ষ শ্রমিক এবং পেশাজীবী। কাজেই স্বাভাবিকভাবে এরাই নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্ট সুবিধাবলি ভোগ করছিল। মিল-কারখানা ও দোকানগুলোতে এরাই প্রাধান্য বিস্তার করে। কিন্তু বাংলার মূল জনগোষ্ঠী উদার মনোভাব নিয়ে এসব ঘটনা মেনে নেয় নি। শীঘ্রই বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে বিরোধ ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। নতুন সম্প্রদায়ের মূল অংশ গঠিত হয় বিহারিদের দ্বারা, যারা ছিল মুহাজিরদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

১৯৫০ সালে জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি হিন্দু-মুসলমান বিরোধ প্রভূত পরিমাণে নিরসন করে। কিন্তু তার পরেও ১৯৫০-এর দশকে যেসব এলাকায় মুহাজিরদের অবস্থান কেন্দ্রীভূত ছিল, সেসব এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে। যেসব মুহাজির ভারতে তাদের সম্পদ হারিয়ে বা রেখে এসেছিল, তারা পূর্ব বাংলায় হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করাকে রাজনৈতিকভাবে বৈধ বলে মনে করে। কিন্তু একথা সত্য যে, ১৯৪০-এর দশকের দাঙ্গাগুলোর মতো সুসংবদ্ধ দাঙ্গা এখানে আর সংঘটিত হয় নি। ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান এবং বাঙালি-মুহাজির সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যায়, তবে মাঝে মাঝে কিছু উত্তেজনা দেখা দিলেও যেকোন বহু সম্প্রদায়বিশিষ্ট দেশের জন্য তা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিস্ফোরুন্মুখ হয়ে পড়ে। বিহারিরা একটি সম্প্রদায় হিসাবে প্রকাশ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ অবলম্বন করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়। ফলে স্পষ্টতই দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিহারিরা এই ভেবে শংকিত হয়ে পড়ে যে, যুদ্ধকালে তাদের দ্বারা নির্যাতিত জনগণ এবং মুক্তিবাহিনী পরবর্তীকালে তাদের প্রত্যাঘাত করতে পারে। তাই যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই সচ্ছল বিহারিরা তাদের পরিবার ও সম্পত্তিসহ পাকিস্তান ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অভিবাসন করে। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বে যারা দেশত্যাগ করতে পারে নি তারা ছিল হতভাগ্য। ক্রুদ্ধ বাঙালিদের রুদ্র রোষ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য তাদের অধিকাংশকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। তারা নিজেরা পাকিস্তানি বলে দাবি করে, কিন্তু এখনো পাকিস্তান তাদেরকে পাকিস্তানি বলে স্বীকৃতি দেয় নি। কাজেই এখনো তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ক্যাম্পে বাস করে। একথা সত্য যে, তাদের অনেকে এসব ক্যাম্প থেকে গোপনে পালিয়ে গিয়ে বাঙালিদের সঙ্গে মিশে গেছে অথবা নীরবে দেশত্যাগ করে পাকিস্তান, ভারত বা অন্য কোথাও চলে গেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করে নি। স্বাধীনতা লাভের পরপরই বাংলাদেশে নতুন এক সাম্প্রদায়িক সমস্যার উদ্ভব ঘটে। পাকিস্তানের ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধান ধর্মীয় ও উপজাতীয় সংখ্যালঘুদের পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তারা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন অনুযায়ী সংখ্যালঘুর অধিকার ভোগ করেছে। কিন্তু যেহেতু বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, সেহেতু ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান কোনো ধর্মীয় বা উপজাতীয় সংখ্যালঘুকে কোনো পৃথক মর্যাদা প্রদান করে নি। সংবিধানের যে বিধান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত সকল মানুষকে এক জাতি বলে গণ্য করেছে এবং ধর্ম ও উপজাতিত্ব নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল অধিবাসীকে বাঙালি বলে অভিহিত করেছে, কতিপয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে চাকমারা তাকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা বাঙালি হিসেবে নিজেদের শনাক্ত করতে অস্বীকার করে। তারা দাবি করে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসরত চাকমা এবং অন্য উপজাতীয় সংখ্যালঘুরা পৃথক সম্প্রদায়, বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাঙালি নয়। অতীতে তাদের দাবির ভিত্তি ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক। ঐতিহাসিকভাবে, চাকমাদের এলাকা মুগলদের দখলে চলে যাওয়ার পর থেকে তারা স্বশাসিত জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ভোগ করে আসছিল। তারা ১৯০০ সালে ব্রিটিশের প্রণীত আইন এবং পাকিস্তানের ১৯৬২ সালের সংবিধানের প্রতি ইঙ্গিত করে, যা সংখ্যালঘু হিসাবে তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। চাকমা সম্প্রদায়ের দাবিগুলো শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাজনৈতিক শাখা শান্তিবাহিনীর দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে। এ যুদ্ধে শান্তিবাহিনী কর্তৃক গেরিলা যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করায় উভয় পক্ষে অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়। অবশেষে একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়, যার শর্ত অনুযায়ী শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে এবং পাহাড়িদের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্তে শান্তির পথ বেছে নেয়।  [সিরাজুল ইসলাম]