সংবাদপত্র ও সাময়িকী

সংবাদপত্র ও সাময়িকী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলায় ইংরেজ আমলে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রাচীনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদ সংগ্রহের কাজে রাজ-কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। কৌটিল্যের তথ্য অনুযায়ী মৌর্য শাসনকালে এক শ্রেণির কর্মচারীর কাজ ছিল রাজ্যের যাবতীয় খবর রাজদরবারে পেশ করা। মুগল আমলে প্রচলিত নিউজলেটার, রাজকীয় বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য লিখিত যোগাযোগের কথাও ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করে থাকেন। এছাড়া মুগল আমলেই প্রশাসনিক জেলায় নিয়োজিত ছিলেন অন্তত একজন ওয়াকিয়া নবিশ, যার দায়িত্ব ছিল অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ ও সংকলন রাজদরবারে প্রেরণ করা।

আধুনিক অর্থে সংবাদপত্র বলতে যা বোঝায় তা উপমহাদেশে ৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় প্রথম চালু হয়। জেমস অগাস্টাস হিকি কর্তৃক প্রকাশিত দুই পাতার এই ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম ছিল বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার। হিকি ছিলেন মুদ্রণ ব্যবসায়ী। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে দুই হাজার রুপি খরচ করে তিনি কলকাতায় যে ছাপাখানা বসান সেখান থেকেই বেঙ্গল গেজেট মুদ্রিত হয়। পরবর্তী ছয় বছরে কলকাতা থেকে চারটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাগুলি ছিল ক্যালকাটা গেজেট, (ফেব্রুয়ারি ১৭৮৪), সরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত বেঙ্গল জার্নাল (ফেব্রুয়ারি ১৭৮৫), ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজিন অব ক্যালকাটা অ্যামিউজমেন্ট (এপ্রিল ১৭৮৫) এবং ক্যালকাটা ক্রনিকল (ফেব্রুয়ারি ১৭৮৬)। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত একটি লক্ষণীয় প্রবণতা ছিল, কোন পত্রিকার সঙ্গে কোম্পানি প্রশাসনের বিরোধ ঘটলে তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ। এই প্রক্রিয়াতেই ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে হিকির ছাপাখানা আটক করে বিক্রয় করে দেওয়া হয় এবং হিকিকে সর্বস্বান্ত করা হয়। বেঙ্গল জার্নাল এবং পরবর্তীকালে ইন্ডিয়ান ওয়ার্ল্ড-এর সম্পাদক উইলিয়ম দুয়েনকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রেফতার করা হয় এবং জোরপূর্বক জাহাজে চড়িয়ে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনি ঘটনা ঘটেছে বেঙ্গল হরকরা-র স্বত্বাধিকারী চার্লস ম্যাকলিয়েন (১৭৯৮), ক্যালকাটা জার্নাল-এর সম্পাদক জেমস সিল্ক বাকিংহাম (১৮২৩), পত্রিকাটির পরবর্তী সম্পাদক আর্নট (১৮২৩) এবং আরও অনেকের ক্ষেত্রে।

আঠারো শতকের শেষভাগ এবং উনিশ শতকের শুরুতে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির বিষয়বস্ত্ত ছিল হিকি-প্রভাবিত। বিদেশি সংবাদ, পার্লামেন্টের বিতর্ক, ইংল্যান্ডের পত্রিকা থেকে উদ্ধৃতি, স্থানীয় সমাজের খবর, সম্পাদকের কাছে লেখা চিঠি, সরকারি নোটিশ, পোয়েটস কর্নার, বিজ্ঞাপন, ফ্যাশন সংক্রান্ত খবর সবকিছুতেই ছিল হিকির গেজেটের অনুকরণ। খুব ব্যতিক্রমী দুই একটি দৃষ্টান্ত ছাড়া এদেশি জনগণ এবং সমাজ সম্পর্কে বিশেষ কোন সংবাদ থাকত না। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমস্ত পত্রিকাই ছিল ইংরেজি ভাষায় এবং ইউরোপীয়দের দ্বারা সম্পাদিত ও পরিচালিত।

উপমহাদেশে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে দিগ্দর্শন নামে বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এই মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন। একই বছর মে মাসে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা আরেকটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করে। এটি ছিল জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। এটি প্রায় ২০ বছর চালু ছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দেই বাঙালি মালিকানায় প্রথম সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেটি প্রকাশিত হয়, প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য, কারো কারো মতে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য। মাঝে মধ্যে এতে ইংরেজি ও হিন্দিতে কিছু নিবন্ধ মুদ্রিত হলেও সাধারণভাবে এর ভাষা ছিল বাংলা। হরচন্দ্র রায় ছিলেন বাঙ্গাল গেজেটি-র সম্পাদনাকার্যে গঙ্গাকিশোরের অন্যতম সহযোগী। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে জেমস সিল্ক বাকিংহাম সম্পাদিত ক্যালকাটা জার্নাল অর্ধ-সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক-এ রূপান্তরিত হয়। ক্যালকাটা জার্নালই ছিল উপমহাদেশের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।

১৭৮০-১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে সংবাদপত্রগুলি মূলত কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং শিল্প-সাহিত্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত ভূ-খন্ডটি তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের একটি অনুন্নত অংশ যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল অতি অল্প, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্বল আর মুদ্রণের সুযোগ ছিল অনুপস্থিত। তবু বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে জেলা শহর রংপুর থেকে প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র রংপুর বার্তাবহ প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুন্ডির জমিদার কালীচরণ রায় চৌধুরী। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত এই সাপ্তাহিকের সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিকের নাম ছিল ঢাকা নিউজ, এটি সম্পাদনা করতেন এ.আর ফোর্বস। ১৮৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ থেকে অন্তত চারটি সাপ্তাহিক বা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলি ছিল রংপুর দিকপ্রকাশ (রংপুরের কাকিনা থেকে প্রকাশিত), কবিতা কুসুমাবলী (ঢাকা), মনপঞ্জিকা (ঢাকা) এবং পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মোট ৩৮টি সংবাদপত্র ছিল, যার মধ্যে ১০টি প্রকাশিত হতো পূর্ববঙ্গ থেকে। এগুলি ছিল বঙ্গবন্ধু, ঢাকা প্রকাশ, মহাপাপ এবং বাল্যবিবাহ (ঢাকা থেকে); গ্রাম দূত, বালারঞ্জিকা, হিতসন্ধানী, বরিশাল বার্তা (বরিশাল থেকে), হিন্দু রঞ্জিকা (রাজশাহী) এবং রংপুর দিকপ্রকাশ (রংপুর)। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে যশোর থেকে প্রকাশিত হয় বিখ্যাত অমৃতবাজার পত্রিকা যেটি এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া আবির্ভাবের কারণে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় উঁচুমানের ইংরেজি অর্ধ-সাপ্তাহিক বেঙ্গল টাইমস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে মোট দশটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। এ সময়ে অধিকাংশ পত্রিকাই পরিচালিত হতো হিন্দু মালিকানায়। নিরক্ষর মুসলমান সমাজ ক্রমে শিক্ষিত হয়ে ধীরে ধীরে সংবাদপত্র জগতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করে।

১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় জাগরণ ও ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক তৎপরতার বছরগুলিতে বাংলাদেশ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্প বিকাশের ভিত্তি প্রস্ত্তত হয়। এ সময়ে বাংলা থেকে প্রকাশিত ১৭৩টি সংবাদপত্রের মধ্যে আনুমানিক ৬৫টি পূর্ববঙ্গ থেকে মুদ্রিত হয়। এদের অধিকাংশই ছিল মতামতধর্মী, যেগুলির উপজীব্য ছিল সাহিত্য, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা, সংস্কার এবং ধর্ম। পূর্ববাংলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত জ্যোতি। এর প্রকাশ শুরু হয় ১৯২১ সালের ৫ আগস্ট। এরপর ১৯২৯-এ চালু হয় দৈনিক, ১৯৩০-এ দৈনিক রাষ্ট্রবার্তা, ১৯৩৬-এ দৈনিক আযান এবং ১৯৪৬-এ দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-৭০) শুরুর দিকেও পূর্ববঙ্গের সংবাদপত্র শিল্প কেবল মিশনারি পর্যায় অতিক্রম করছিল। ভারত বিভক্তির সময় আব্দুস সামাদ সম্পাদিত দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান-ই কেবল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো। বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ভারত গমনের ফলে পূর্ববঙ্গে গুরুতর শূন্যতার সৃষ্টি হয় যা সংবাদপত্র শিল্পের জন্য ছিল ক্ষতিকর।

ভারত বিভাগের পর পূর্ববাংলায় প্রথম যে দৈনিকের আবির্ভাব ঘটে তার নাম ছিল পয়গাম (সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী)। এটি ১৯৪৭ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। একই সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশনা শুরু করে জিন্দেগী নামক অর্ধ-সাপ্তাহিক। মওলানা আকরম খাঁর কলকাতা-ভিত্তিক দৈনিক আজাদ-ও ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৯৪৮ সাল থেকে প্রকাশনা শুরু করে। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় প্রকাশিত হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার। আরও দুটি সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ যথাক্রমে ১৯৪৯ ও ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়। এগুলি এখনও বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে শীর্ষস্থানে আছে। পরবর্তী প্রকাশনাগুলির মধ্যে ছিল দৈনিক পাকিস্তান (পরে দৈনিক বাংলা), পূর্বদেশ এবং দ্য মর্নিং নিউজ। ভারত বিভাগের পরপর যে অশান্ত-অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে সংবাদপত্র শিল্প যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংবাদপত্রগুলি ছিল দ্বিধা ও শঙ্কাগ্রস্ত। পুরানোগুলি একের পর এক বন্ধ হওয়া শুরু করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে সংবাদপত্র ও সাময়িকীর সংখ্যা ২৫৯ থেকে ১৬০-এ হ্রাস পায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদপত্র শিল্প ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। বেশকিছু সংবাদপত্র এ সময় হারিয়ে যায়, অনেকগুলি ছিল দখলদার বাহিনীর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের অধীনে। তবে বেশ কয়েকটি পত্রিকা তখন মুক্ত এলাকা এবং ভারত থেকে প্রকাশিত হয়। এগুলির অধিকাংশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র ছাড়াই প্রকাশিত হতো। প্রায় সবগুলি ছিল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক। কয়েকটি একবার বা দুবার মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। অধিকাংশেরই, এমনকি নিজস্ব ভবন পর্যন্ত ছিল না। প্রকাশিত পত্রিকাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শাশ্বত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জয় বাংলা, সোনার বাংলা, বাংলার বাণী, বিপ্লবী বাংলা, দ্য নেশন, মুক্ত বাংলা, দ্য পিপল, দুর্জয় বাংলা, মুক্তি, একতা ইত্যাদি। স্বাধীনতা অর্জনে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে এগুলি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বস্ত্তত এগুলি ছিল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার এক নতুন ধারার প্রর্বতক। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ২৫ মার্চের অপারেশনে পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের গোলায় তিনটি দৈনিক পত্রিকার প্রেস ও অফিস ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলি হলো দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও দ্য পিপল। স্বাধীনতার পর এগুলির প্রকাশনা শুরু হতে কিছুটা সময় লাগে। দেশে পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণের সময়কালে সংবাদপত্রসমূহ নতুনভাবে সংগঠিত হতে শুরু করে। দেশের সংবিধানেও এ সময়ে সংবাদ মাধ্যম সম্পর্কিত বিধানাবলি সংযোজিত হয়। সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশে  এ সময়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সংখ্যা ও গুণগত মান উভয়েরই উন্নয়ন। মফস্বলকেন্দ্রিক সাংবাদিকতাও এ সময় শক্তিশালী হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মুহূর্তে বাংলাদেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ১০। স্বাধীনতার পরপর কয়েকটি পত্রিকার পরিচালনার ভার সরকারকে বহন করতে হয়েছিল। পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান (দৈনিক বাংলা) ও দ্য মর্নিং নিউজ এবং মালিকের অনুপস্থিতিতে দ্য পাকিস্তান অবজারভার (দ্য বাংলাদেশ অবজারভার), পূর্বদেশ এবং চিত্রালী সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হতো। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে সংবাদনির্ভর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিচিত্রা-র প্রকাশনা শুরু হয় দৈনিক বাংলা প্রকাশনী থেকে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবাদপত্রে নিয়োজিত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য আইন প্রণীত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকারিভাবে প্রকাশিত চারটি পত্রিকা ছাড়া সরকার অন্যসব পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। পত্রিকা চারটি ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস।

১৯৭৫ সালের পর থেকে পুরানো পত্রিকাগুলি একে একে আবার প্রকাশিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত সংবাদপত্র ছিল নিয়ন্ত্রিত। সরকারের সমালোচনামূলক খবর ছাপানোর অভিযোগে এ সময় প্রায় ৫০টি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে যায় যায় দিন নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পাঠক জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে এ পত্রিকাটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনাকে মেকআপ ও পরিবেশনার ভঙ্গিসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রভাবিত করেছে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন-এর ১৬, ১৭, এবং ১৮নং ধারা অবলুপ্ত করে সেন্সরশিপ ও প্রকাশনা নিষিদ্ধ সংক্রান্ত কালো আইনের বিলুপ্তি ঘটায়। এছাড়া এ সময় প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট-এরও সংশোধনী আনা হয়। বিশ শতকের নববইয়ের দশকে বিভিন্ন মতের রেকর্ড সংখ্যক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯৯৭ সালে সরকারি মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ টাইমস এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে টাইমস-বাংলা ট্রাস্টকে অবলুপ্ত ঘোষণা করা।

বাংলাদেশে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাগুলির মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রধান সকল পত্রিকা নিয়মিত সাইজের, আর দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকাই ট্যাবলয়েড আকারের। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই ডেস্কটপ পাবলিকেশন প্রযুক্তি বিকশিত হতে থাকে। দৈনিক পত্রিকাগুলি সাধারণত ছাপা হয় অফসেট মেশিনে। ১৯৯৫ সাল থেকে সংবাদপত্রে রঙিন ছবি মুদ্রণও চালু হয়েছে। নববইয়ের দশকের বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দৈনিক পত্রিকার মধ্যে ছিল ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ইনকিলাব, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, বাংলাবাজার পত্রিকা, মুক্তকণ্ঠ, প্রথম আলো, সংবাদ, মানবজমিন, সংগ্রাম, দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভার, দ্য ডেইলি স্টার, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং নিউ নেশন। ২০০০-এর দশকে সংবাদপত্র জগতে উল্লেখযোগ্য নতুন সংযোজন ছিল: যুগান্তর, সমকাল, যায়যায়দিন, আমারদেশ, নয়াদিগন্ত, কালেরকণ্ঠ, দি নিউজ টুডে, নিউ এজ এবং আমাদের সময়। বিভিন্ন জেলা শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিকসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত আজাদী ও পূর্বকোণ, বগুড়া থেকে করতোয়া, খুলনা থেকে পূর্বাঞ্চল এবং সিলেট থেকে যুগভেরী। স্বাধীনতার পর যে সকল সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে তাদের মধ্যে বিচিত্রা ও যায় যায় দিন ছাড়া উল্লেখযোগ্য হলো হলিডে, রোববার, সচিত্র সন্ধানী, পূর্ণিমা, ঢাকা কুরিয়ার, খবরের কাগজ, আগামী, সাপ্তাহিক ২০০০, সাপ্তাহিক এখন, সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র, শীর্ষকাগজ ও শৈলী। মহিলা পাঠকের পত্রিকা সাপ্তাহিক বেগম পাকিস্তান আমল থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। বেগম-এর অনুপ্রেরণায় ১৯৮৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে পাক্ষিক অনন্যা। সাংবাদিকতার প্রধান স্রোতের বাইরে বিশেষ বিষয়ের পত্রিকা প্রকাশের ধারা স্বাধীনতার পর থেকে গড়ে উঠেছে। এ ধারার উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ হলো চলচ্চিত্র, বিনোদন, ক্রীড়া, সাহিত্য, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, সমাজ, অর্থনীতি, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, অপরাধ ও কার্টুন।

বার্তা সংস্থার মাধ্যমেও এদেশে সাংবাদিকতা বিকশিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলের সরকারি বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি) স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে বেসরকারি খাতে ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (ইএনএ) নামে একটি বার্তা সংস্থা কাজ শুরু করে। আর্থিক সমস্যার কারণে আশির দশকে এটা বন্ধ হয়ে যায়। আশির দশকেই আরেকটি বেসরকারি বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) ১৯৮৮ সালে আবির্ভূত হয়ে সংবাদ মাধ্যমের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। নববইয়ের দশকে চালু হওয়া বার্তা সংস্থার মধ্যে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (বিএনএ), ঢাকাকেন্দ্রিক প্রোব বার্তা সংস্থা, নিউজ মিডিয়া এবং আবাস উল্লেখযোগ্য। সংবাদ মাধ্যমের সাথে যে সকল সরকারি সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতা আছে সেগুলি হলো বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, তথ্য অধিদপ্তর এবং বহিঃপ্রচার অনুবিভাগ। এর মধ্যে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সরকারি প্রকাশনা, পত্র-পত্রিকা নিবন্ধন, সরকারি বিজ্ঞাপন বিলিবণ্টন এবং পত্রিকার সার্কুলেশন নিরূপণ ও নিউজপ্রিন্ট বরাদ্দের সাথে জড়িত। অন্যদিকে তথ্য অধিদপ্তর সরকারি কর্মকান্ডের প্রেস কভারেজের দায়িত্বে নিয়োজিত।

১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইন্টারনেট অনলাইনে সংবাদপত্র ও সাময়িকীর প্রকাশ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের সাথে সম্পর্কিত আইন ও বিধিসমূহের মধ্যে আছে: সংবিধানের ৩৯, ৪৩, এবং ১০৮ নং ধারা; দন্ডবিধির ১২৪ (ক), ১৫৩ (ক), ১৫৩ (খ), ২৯২, ২৯৩, ২৯৫ (ক) এবং ৪৯৯ নং ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ (ক) ধারা; অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর ৩ নং ধারা; বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২ নং ধারা; প্রিন্টিং প্রেস ও পাবলিকেশন (ঘোষণা ও নিবন্ধন) অ্যাক্ট; দ্য টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট; দ্য পোস্ট অফিস অ্যাক্ট-এর ২৭(খ) নং ধারা; দ্য ইনডিসেন্ট অ্যাডভার্টাইজমেন্ট অ্যাক্ট-এর ৩ নং ধারা; ফরেন রিলেশান অ্যাক্ট-এর ২ নং ধারা; এবং কপিরাইট অ্যাক্ট।

সংবাদপত্র ও সাময়িকীর দেশব্যাপী সার্কুলেশন সংক্রান্ত কোন নির্ভরযোগ্য হিসাব না থাকলেও, দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইয়ার বুক ১৯৯৮-এর প্রাক্কলন অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে সারাদেশে দৈনিক সংবাদপত্রের সার্কুলেশন ছিল ২২,৩৭,৯৬০ এবং সাময়িকীর সার্কুলেশন ছিল ৯,৮৭,৮১০। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮ সালে সারাদেশে ৪১২টি দৈনিকসহ মোট ৭১২টি সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকার ৯০ শতাংশেরও অধিক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকার অনলাইন প্রকাশনা রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি অনেক পাঠক এসব সংবাপত্র এবং সাময়িকী পড়তে পারে।

বাংলাদেশে প্রায় ১,০০০ দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হলেও ২০০৮ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী গোটা দেশের মাত্র ২৫.০ শতাংশ লোক সপ্তাহে একবার পত্রিকা পাঠ করে থাকে। শহরাঞ্চলে পাঠক সংখ্যার হার তুলনামূলকভাবে বেশি (৪৩ শতাংশ) এবং পল্লী অঞ্চলে এই হার শতকরা মাত্র ১৬.০ ভাগ। সাপ্তাহিক পত্রিকার ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৩ শতাংশ। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, মাত্র ১২ শতাংশ পাঠক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন এবং মাত্র ৫৫ শতাংশ পাঠক মনে করেন যে দেশের পত্রিকাগুলির মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। এই আস্থাহীনতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি হস্তক্ষেপ, প্রি-সেন্সরশিপ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন মহলের বাধা, মালিকের খেয়াল-খুশি, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ও সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা। [হেলাল উদ্দিন আহমেদ এবং গোলাম রহমান]