শ্বেতপত্র ১৯৭১

শ্বেতপত্র ১৯৭১  পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট প্রকাশিত এই শ্বেতপত্রে বিবৃত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে সামরিক সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের ব্যাখ্যা ও বিবরণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালের ঘটনাবলি, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের ২৫ মার্চ রাত থেকে সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতা এবং যুদ্ধকালীন নিজেদের অবস্থানকে দেশে বিদেশে বৈধতা দেয়ার লক্ষ্যে এই শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়। এই শ্বেতপত্রে একদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্র হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড ও অপরাধের যুক্তি তৈরি করার চেষ্টা করে এবং অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ ও কর্মীদের ভূমিকার নেতিবাচক উপস্থাপনার মাধ্যমে ঘটনার বিকৃতি দ্বারা অসত্যকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায়।

শ্বেতপত্রে ভূমিকা, উপসংহার এবং পরিশিষ্ট ব্যতীত এর চারটি অধ্যায়ে একাত্তর পূর্ববর্তী ঘটনাবলি এবং মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামীদের ভূমিকা এবং পাকিস্তান সরকারের অবস্থানের বর্ণনা পাওয়া যায়। ভূমিকার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট যে, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শ্বেতপত্রটি প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার মুখ রক্ষার চেষ্টা করেছে। এতে বলা হয়, ‘এই শ্বেতপত্র পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সংকটময় ঘটনাবলির সর্বপ্রথম পূর্ণ বিবরণ। আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোভাবের দরুন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা একটি ফেডারেশন গঠনের মূল বিষয়সমূহের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে এই সংকটের উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জনগণের রায়কে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপান্তরের প্রয়াস পান।’ ভূমিকায় এই কয়েকটি ছত্রে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তান সরকারের সদিচ্ছা সত্বেও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়। প্রথম অধ্যায়ে ১৯৬২ সাল থেকে শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক আইন জারীর কথা বলা হয়। ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, এ নির্বাচনে সামরিক সরকারের আন্তরিকতা এবং নিরপেক্ষতার সাফাই গাওয়া হয়। এতে আইন কাঠামো আদেশের পূর্ণ বিবরণীও তুলে ধরা হয়। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন এবং এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘বঙ্গভূমি’ কিংবা ‘বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের বিবরণ দেয়া হয়েছে। অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের ধর্মঘটের আহবান ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযান সারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক জীবনকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এতে আইন ও শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি ঘটছে। এ অধ্যায়ের শেষ হয়েছে শেখ মুজিবের টাইম পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। এতে বলা হয়, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বলেছেন ‘‘আমি তাদেরকে পঙ্গু করে দেব এবং তাদেরকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করবো।’’ স্বাধীনতা ঘোষণা কেন্দ্রিক যে বিতর্ক বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হয় শ্বেতপত্রের এ অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৫-২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলির  বর্ণনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ২৬ মার্চ ভোরে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের পরিকল্পনার কথাও বলা হয়। পাকিস্তান সরকার এ কারণেই যে ২৫ মার্চ রাতে এ অবস্থা থেকে মুক্তি ও পাকিস্তানের সংহতির জন্য সামরিক অভিযান চালিয়েছিল তা এ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা পৃথক ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। বলা বাহুল্য এর অর্থই হচ্ছে জাতির পিতা যে লক্ষ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার পরিসমাপ্তি ঘটানো।

তৃতীয় অধ্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ কিভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তা বলা হয়েছে। ১-১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানে তাদের ভাষায় আওয়ামী লীগ অবাঙালিদের উপর ব্যাপক সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়। বিভিন্ন পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে বাঙালিরা এ সময় ব্যাপক হত্যাকান্ড চালিয়েছে। চট্টগ্রামে বাঙালিরা প্রায় ১৮০ জন মহিলা ও শিশুকে হত্যা করে। যদিও অন্যান্য উৎস থেকে এসব ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় না।

চতুর্থ অধ্যায়ে পাকিস্তান সংকটে ভারতের ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণদান ও প্রবাসী সরকার গঠন এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা এ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। উপসংহারে বলা হয় যে, আওয়ামী লীগ ও বাঙালিদের অসহযোগিতার কারণেই পাকিস্তান সরকারের সব চেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এমনকি এ কারণে সরকার চরম সিদ্ধান্ত অর্থাৎ সামরিক অভিযানে বাধ্য হয় বলে উল্লেখ করা হয়। সবশেষে পরিশিষ্টে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নীতি নির্ধারণী ভাষণের অংশ বিশেষ, আইন কাঠামো আদেশ ১৯৭০, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলি ও খসড়া ঘোষণাপত্র (মার্চ ১৯৭১), পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের সংবিধান ১৯৬২, প্রধান প্রধান নৃশংসতার তালিকা। শেষ পরিশিষ্টে বলা হয়েছে যে, বাঙালিরা একাত্তরের নয় মাসে প্রায় ৬০ হাজার বিহারিকে হত্যা করেছে। যদিও পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি জেনারেল, রাজনীতিবিদদের লেখনী থেকে এ তথ্যের মিল পাওয়া যায় না।

বাঙালি নেতৃবৃন্দ এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শ্বেতপত্রকে প্রত্যাখ্যান করে। পাকিস্তান সরকার বিশ্ববাসীর কাছে আওয়ামী লীগকে হেয় করা এবং বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা ও গৃহযুদ্ধ হিসেবে প্রমাণের জন্য যুদ্ধ শুরুর ৫ মাস পর শ্বেতপত্র প্রকাশ করে শেষ রক্ষার চেষ্টা করে। তাই এই শ্বেতপত্রকে একদিকে অসত্য তথ্য ও ঘটনা বিবৃতির দলিল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে মিথ্যা তথ্য ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা চাপা দেয়ার চেষ্টা করলেও প্রকারান্তে সত্য ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। বাঙালি এবং বিশ্ববাসীর কাছে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। শ্বেতপত্র পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের দলিল হিসেবেই গণ্য হয়েছে।  [আবু মো. দেলোয়ার হোসেন]