শৈবাল

শৈবাল (Algae)  ক্লোরোফিলবহনকারী সরল প্রকৃতির স্বভোজী (autotrophic) অতি প্রাচীন এক উদ্ভিদদল। এদের উদ্ভব সমুদ্রের পানিতে, আজ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগে। সেই আদিমকাল থেকেই শৈবাল prokaryotic থেকে eukaryotic আকৃতিতে রূপ ও বৈচিত্র্য লাভ করেছে। প্যালিওজোয়িক যুগের শুরু থেকে অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৫০০ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত এরা সমুদ্রে একক আধিপত্য অটুট রেখেছিল। আজও সমুদ্রের প্রধান উদ্ভিদ এই শৈবাল। এদের দেহ কাঠামো সরল এবং মূল, কান্ড ও পত্রে পৃথকীভূত নয়। অবশ্য বড় বড় সামুদ্রিক আগাছা মূল, কান্ড ও পাতা সদৃশ কাঠামোয় বিভাজ্য হতে পারে, আর এগুলির অভ্যন্তরীণ কাঠামোও সরল নয়। শৈবাল অভাস্কুলার (nonvascular), হরিৎ ও অন্যান্য কণাধারী উদ্ভিদ, যাদের যৌনাঙ্গ এককোষী এবং সেগুলি বন্ধ্যা কোষ দ্বারা বেষ্টিত নয়। নিষেককালে শৈবালে কোন ভ্রুণসৃষ্টি হয় না, জীবনচক্রে নেই কোন প্রটোনেমা। তবে ব্যতিক্রম আছে এবং তা মেলে সবুজ শৈবাল Charales বর্গে। আরেকটি ব্যতিক্রমও উলে­খযোগ্য, কোন কোন শৈবাল বর্ণহীন, মৃতজীবী বা যথার্থ পরজীবী।

শৈবালের আছে নানারূপ- এককোষী, বহুকোষী, ফ্লাজেলাবিশিষ্ট সুতার মতো, শাখায়িত বা শাখাহীন; রঙের বৈচিত্র্যও অন্যন্য। এদের অধিকাংশই আণুবীক্ষণিক, কতক বিশাল আকারের; দৈর্ঘ্য হয় ০.৫ মাইক্রোমিটার থেকে ৫০-৬০ মিটার পর্যন্ত। প্রকৃতিগতভাবে বহুজাতিক (polyphyletic) বিধায় বিভিন্ন বর্গ রঞ্জককণা, ফ্লাজেলার গড়ন (অবস্থান ও বিন্যাস), সালোকসংশে­ষের সঞ্চয়বস্ত্ত ও কোষপ্রাচীরের কাঠামোর নিরিখে পরস্পর থেকে বিভিন্ন বর্গে পৃথকীকৃত হতে পারে। এজন্য শৈবালরা একটিমাত্র উচ্চতর শ্রেণিবিন্যাসগত শাখাভুক্ত নয়, বরং কয়েকটি সুস্পষ্ট শাখায় শ্রেণিবদ্ধ, যার সংখ্যা আজও চূড়ান্ত হয় নি।

শৈবাল দেখা যায় সর্বত্র এবং এদের অনেকই বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। এগুলি প্রধানত জলজ; স্বাদুপানিতে (পুকুর, ডোবা, হ্রদ, ধানক্ষেত, নদী, বিল ও হাওর), স্বল্পলবণাক্ত পানিতে, যেমন সুন্দরবনের লবণাক্ত মোহনা এবং সমুদ্রে এদের প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে দেখা যায়। মাটির উপরে বা নিচে (স্থলজ), অথবা অন্যস্থানে, যেমন গাছের গুঁড়ি, দালানের প্রাচীর, শিলা ও পাথর, টিন, ধাতু-খুঁটি ইত্যাদি (অর্ধবায়ব) স্থানেও শৈবাল জন্মে।

বাংলাদেশে স্বাদুপানি, স্বল্পলবণাক্ত পানি ও সমুদ্রে বিপুল সংখ্যক শৈবাল প্রজাতির বাস। এগুলিতে রয়েছে Cyanophyceae, Chlorophyceae, Charophyceae, Euglenophyceae, Rhodophyceae, Bacillariophyceae, Chrysophyceae, Xanthophyceae ও Chloromonadinae-এর পানির তলার ও ভাসমান দুই ধরনের প্রজাতিই। এছাড়া আছে স্থলজ ও অর্ধ-বায়বীয় সদস্যরাও।

অর্ধবায়বীয় শৈবাল  বাংলাদেশ আর্দ্র-উষ্ণমন্ডলীয় দেশ বিধায় গাছের গুঁড়ি, দালানকোঠার প্রাচীর ও অন্যান্য বাস্ত্তভিতে প্রচুর পরিমাণে অর্ধ-বায়বীয় শৈবাল গজায়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ দালান, মসজিদ, মিনার ও দেয়াল, বিশেষত চুনকাম করা কাঠামো Scytonema ও Porphyrosiphon প্রজাতির নীল-সবুজ শৈবালের জন্য শ্যামলা, কালো বা গোলাপি-লালচে, Chlorella, Hormidium, Stichococcus এবং Cladophorella প্রজাতির জন্য ঈষৎ সবুজ এবং Trentepohlia-র প্রজাতির জন্য সবুজ-হলুদ থেকে কমলা-হলুদ হয়ে ওঠে। এসব শৈবালের জন্য গাছের গুঁড়ি নানা রঙ ধরে। বর্ষাকালে প্রায় সর্বত্রই Chroothece, Chrococcus ও অন্যান্য নীল-সবুজ শৈবালের পিচ্ছিল প্রকোপ চোখে পড়ে।

স্থলজ শৈবাল  একইভাবে বিভিন্ন ঋতুতে প্রচুর ভূমিজ শৈবালও দেখা যায়। এগুলির মধ্যে Oedogonium, Oedocladium, Fritschiella, Rhizoclonium, Vaucheria, Botrydium, Botrydiopsis, Chroothece, Hapalosiphon, Stigonema, Westiellopsis, Tolypothrix, Scytonema, Chrococcus, Aphanothece, Rivularia, Cylindrospermum ইত্যাদি ভেজা মাটিতে সহজেই জন্মায়। ফসল তোলার পর কোনো কোনো ধানক্ষেতের মাটি লালচে-হলুদ, সূত্রাকার নীল-সবুজ শৈবাল Porphyrosiphon-এর প্রজাতিতে ঢেকে যায়।

জলজ শৈবাল  বাংলাদেশে স্বাদুপানির তিন শতাধিক প্রজাতি ও ভ্যারাইটির শৈবাল বর্ণিত হয়েছে। স্বাদুপানির নীল-সবুজ শৈবাল, ইউগি­নোয়েডস, Chlorococcales, Volvocales, Zygnematales, Oedogoniales, ডেসমিড, কিটোফোরীয় শৈবাল এবং লোহিত শৈবাল নিয়েও বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে। অধিকন্তু স্বাদুপানির ডায়াটম, Xanthophyceae, Chrysophyceae, Chloromonadinae নিয়েও কিছু কাজ হয়েছে।

বাংলাদেশে সর্বত্রই শৈবাল জন্মে এবং বিশেষভাবে বর্ষাকালে এদের প্রকোপে দালানকোঠা বিবর্ণ হয়ে ওঠে এবং নানা ধরনের নীল-সবুজ শৈবাল পথঘাটে পিচ্ছিলতা ছড়ায়। বিভিন্ন মৌসুমে কতক Euglena প্রজাতির অতিবৃদ্ধির দরুন অনেক পুকুরের পানি লালচে হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সর্বত্র প্রায় সব স্থায়ী বদ্ধ জলাশয় গাঢ় নীলচে-সবুজ বা গাঢ়-সবুজ দেখায় এবং তা Microcystis প্রজাতির মতো কয়েকটি নীল-সবুজ শৈবাল, কয়েক প্রজাতির Euglena, Gonium, Eudorina, Pondorina সৃষ্ট পানিস্ফুটনের (water-bloom) কারণে ঘটে। Trachelomonas প্রজাতির প্রবল বৃদ্ধির জন্য অগভীর ডোবাগুলির পানি অনেক সময় লালচে চা-বর্ণ ধারণ করে; পথের পাশের খোলা নদর্মাগুলি ভরে থাকে Oscillatoria, Lyngbya বা নীল-সবুজ শৈবালের অন্যান্য প্রজাতির গাঢ় নীল রঙে।  [এ.কে.এম নুরুল ইসলাম]

নীল-সবুজ শৈবাল (Blue green algae/BGA) আদিমতম স্বভোজী জীব, পৃথিবীতে ৩০০ কোটি বছরেরও আগে উদ্ভূত। এদের উৎপত্তির পূর্বে পৃথিবীর আবহমন্ডলে কোনো অক্সিজেন ছিল না। নীল-সবুজ শৈবাল সালোক-সংশে­ষণ শুরু করলে আবহমন্ডলে অক্সিজেন সঞ্চারের সূচনা ঘটে।

সব BGA প্রোক্যারিওটিক অর্থাৎ এদের কোষে নেই যথার্থ নিউক্লিয়াস, নিউক্লিওলাস ও কোন নিউক্লীয় আবরণী। এদের প­াসটিড ও ফ্লাজেলা (flagellum) নেই, নেই যৌনপ্রজনন পদ্ধতি। তবে কোনো কোনো প্রজাতিতে নিউক্লীয় বস্ত্তর অঙ্গজ সংমিশ্রণ বা অনুজনন (parasexuality) নামের এক ধরনের জেনিটিক পুনর্মিশ্রণ ঘটে।

নীল-সবুজ শৈবাল নানা প্রকার; এককোষী, মুক্তজীবী, প­াঙ্কটোনিক অথবা আবদ্ধ; কোনটি নিয়মিত বা অনিয়মিত কলোনিবাসী, অনেকে বহুকোষী সুতার মতো, শাখায়িত বা শাখাহীন, কারও আছে কৃত্রিম শাখা। সুতার মতো এই শৈবালরা অনেক সময় আঠালো কলোনিও গড়ে তোলে। কোষ বিভাজন, খন্ডায়ন, হর্মোগোন গঠন, বহুকোষী হর্মোস্পোর বা মাইক্রোস্পোর, ন্যানোস্পোর, এন্ডোস্পোর, অ্যাকিনিট বা হিটারোসিস্টের মাধ্যমে এদের বংশবিস্তার হয়। নীল-সবুজ শৈবাল নানা ধরনের পরিবেশে, তাপমাত্রায়, আলো ও অন্যান্য পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সর্বত্রই বিদ্যমান, তবে স্বাদুপানির ক্ষারীয় পরিবেশেই এদের আধিক্য। বাংলাদেশে অর্ধবায়ব, স্থলজ ও জলজ (হ্রদ, পুকুর, ডোবা, ধানক্ষেত, নদী, মোহনা ও সমুদ্র) আবাস থেকে নীল-সবুজ শৈবালের অনেকগুলি গণ ও প্রজাতি লিপিবদ্ধ হয়েছে।

বাংলাদেশে অধিকাংশ পুকুর, ডোবা ও অন্যান্য বদ্ধ জলাশয় জৈবিকভাবে দূষিত থাকায় তাতে নীল-সবুজ শৈবাল পানিস্ফুটন ঘটায় এবং প্রায় সারা বছরই পানি নীলচে-সবুজ থাকে। সাধারণত Microcystis flos-aquae ও M. aeruginosa-এর দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি পানিকে মৎস্যচাষ, বিনোদন ও গৃহস্থালির কাজে অযোগ্য করে তোলে। এসব শৈবালের কোষগুলি শেষ পর্যন্ত মরে পচে বিষাক্ত দুর্গন্ধ ছড়ায়। এদের অতিবৃদ্ধিজনিত জলাশয়ের পানিস্ফুটন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। নিচে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাস্ত্ততাত্ত্বিক আবাসের নীল-সবুজ শৈবালের গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদাহরণ উলে­খ করা হলো।

অর্ধবায়ব Scytonema, Tolypothrix, Porphyrosiphon, Stigonema, Symploca, Myxosarcina ও Chroococcus প্রজাতি সর্বত্র সহজদৃষ্ট। বাংলাদেশে গাছের গুঁড়ি, দালানকোঠা, মসজিদ ও অন্যান্য কাঠামোয় ছড়ানো ছিটানো কালচে বা গোলাপি লালচে ছোপগুলির সবই উপরিউক্ত গণের প্রজাতিদের উপস্থিতির কারণে হয়ে থাকে।

স্থলজ  বাংলাদেশে, বিশেষত বর্ষাকালে ভিজা মাটিতে অনেক ধরনের নীল-সবুজ শৈবাল জন্মে। এগুলির মধ্যে উলে­খযোগ্য Chroococcus, Dactylococcopsis, Aphanothece, Microcoleus, Porphyrosiphon, Schizothrix. Oscillatoria, Lyngbya, Symploca, Cylindrospermum, Calothrix, Nostoc, Stigonema, Hapalosiphon, Westiellopsis, Rivularia ইত্যাদি গণভুক্ত প্রজাতি।

জলজ  নীল-সবুজ শৈবালের বহু প্রজাতি সব ধরনের জলজ (স্বাদুপানি, স্বল্পলবণাক্ত পানি ও সামুদ্রিক) আবাসে অঢেল জন্মে। অনেক প্রজাতিই প­াঙ্কটোনিক এবং কতকগুলি জৈবিকভাবে দূষিত পানিতে পানিস্ফুটন ঘটায়, যেমন Microcystis spp., Aphanocapsa, Aphanothece, Chroococcus, Synechocystis, Synechococcus, Gloeocapsa, Gloeothece, Merismopedia, Coelosphaerium ইত্যাদি (সবগুলিই এককোষী, অধিকাংশই কলোনিবদ্ধ)। এমনকি, বহুকোষী প­াঙ্কটোনিক প্রজাতির দৃষ্টান্তও আছে, যেমন Anabaena, Nostoc, Spirulina, Oscillatoria, Lyngbya, Anabaenopsis, Wollea, Rivularia, Gloeotrichia ইত্যাদি। আবদ্ধ বা সংযুক্ত সদস্যসমূহের মধ্যে রয়েছে Stichosiphon, Calothrix, Scytonema, Tolypothrix, Hapalosiphon, Stigonema, Lyngbya, Hydrocoleum, Fremyella, Nodularia ও Aulosira-এর প্রজাতি। Spirulina, Anabaenopsis গণের প্রজাতিরা স্বাদুপানির তুলনায় দক্ষিণের স্বল্পলবণাক্ত আবাসে সংখ্যায় অনেক বেশি। Jahanesbaptistia গণের প্রজাতি কেবল খুলনা ও সাতক্ষীরার চিংড়িচাষের স্বল্পলবণাক্ত পানির পুকুরে পাওয়া গেছে।

নীল-সবুজ শৈবালের কোনো কোনো সদস্য Anthoceros, liverworts, Azolla, Cycas ইত্যাদির মতো উচ্চতর বর্গের উদ্ভিদের অভ্যন্তরে পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে Anabaena azollae অন্তর্বাসী হিসেবে থাকে Azolla pinnata নামের ভাসমান জলজ ফার্নের থ্যালাসে। সাইকাসের শিকড়ের মধ্যে Nostoc প্রজাতি ঢুকে সেখানে প্রবালবৎ কাঠামো (coralloid) তৈরি করে। নীল-সবুজ শৈবালের কয়েকটি প্রজাতি (Chroococcus, Gloeocapsa, Nostoc, Scytonema, Stigonema ইত্যাদি) ছত্রাকের সঙ্গে মিথোজীবিতামূলক সহযোগ গড়ে তুলে লাইকেন সৃষ্টি করে, যেগুলির বিবিধ গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ ও অন্যান্য কিছু প্রাণীর পরিপাকতন্ত্রবাসী Oscillatoriaceae গোত্রের কোনো কোনো সদস্য যথার্থ পরজীবী। rhizopods, cryptomonads, diatoms, Tetrasporales, Chlorococcales, Phycomycetes ইত্যাদির কোষের প্রোটোপ­াস্টের বাসিন্দা নীল-সবুজ শৈবালরা helotism বা endophytism-এর নির্দশন। একমাত্র ডায়াটোম ছাড়া অন্য সব পোষক (host) বর্ণহীন। Glaucocystis nostochinearum হলো বাংলাদেশে এ জাতীয় অন্তর্জীবিতার উদাহরণ।

বাংলাদেশে নীল-সবুজ শৈবাল নিয়ে পরীক্ষা  নীল-সবুজ শৈবালের অনেকগুলি বৈশিষ্ট্যই প্রকৃত ব্যাকটেরিয়ার মতো এবং সেজন্য আজকাল অনেকেই এদের ব্যাকটেরিয়ার দলভুক্ত হিসেবে সায়ানো ব্যাকটেরিয়া বলেন। ব্যাকটেরিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য, বিশেষত উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলিতে, বাতাস থেকে মাটিতে ও পানিতে নাইট্রোজেন বন্ধন করার ক্ষমতা। নীল-সবুজ শৈবালের N2-বন্ধন পরীক্ষামূলকভাবে ও চূড়ান্তভাবে প্রথম প্রমাণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ের পি.কে.দে ১৯৩৯ সালে ফরিদপুরের ধানক্ষেত থেকে সংগৃহীত মাটিসহ নীল-শৈবাল থেকে। কৃষির দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইদানিং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উষ্ণমন্ডলীয় দেশে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জীবজসার (biofertilizer) হিসেবে নীল-সবুজ শৈবাল ব্যবহূত হয়।

Spirulina-র প্রজাতি এখন ‘বিস্ময়কর জীব’ হিসেবে বিবেচিত। এদের কোষে প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় ৭০%, জীবিত যেকোন জীবের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়াও এতে আছে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ লবণ ও অন্যান্য উপাদান। বাংলাদেশের সহজলভ্য জলজ ফার্ন Azolla pinnata-এর অন্তর্বাসী Anabaena azollae বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করতে পারে, যেজন্য আজকাল ক্ষেতের উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য অ্যাজোলা ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।  [এ.কে.এম নুরুল ইসলাম]

স্বল্পলোনা পানির শৈবাল (Brackish water Algae) সমুদ্রের তুলনায় কম লোনাপানিতে বাস করে এমন (সাধারণত ৩৩ ppm থেকে কম ও ১০ ppm থেকে বেশি) শৈবাল প্রজাতি। জোয়ার, নদীবাহিত স্বাদুপানি, বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের হার ইত্যাদির নিরিখে স্বল্পলোনা পানির লবণাক্ততায় তারতম্য ঘটে। Enteromorpha গণের প্রজাতিগুলির মতো কিছু শৈবালের লবণাক্ততার নানা মাত্রায় বিস্ময়কর সহিষ্ণুতা রয়েছে। এসব শৈবাল জাহাজের গায়ে আটকে থাকে আর লোনা ও স্বাদুপানি উভয় ধরনের পানিতেই এসব জাহাজ চলাচল করে।

বাংলাদেশে  সুন্দরবন অঞ্চল হলো গুরুত্বপূর্ণ স্বল্পলোনা পানির এক অনবদ্য বাস্ত্ততন্ত্র, তথা একটি ম্যানগ্রোভ জলাভূমি। এটি পশ্চিমোয়মঙ্গল নদী থেকে পূর্বে বালেশ্বর নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বন নদী ও জোয়ারধৌত খাঁড়ি, লোনা ও স্বাদুপানি, মিহি পলি ও জোয়ারভাটার কাদা, কয়েক সেন্টিমিটার গভীর খাদবহুল নিচু বাঁধ ইত্যাকার নানা উপাদানের এক অনন্য পরিবেশীয় সমাবন্ধ।চকোরিয়া সুন্দরবন, মহেশখালী, টেকনাফ, পটুয়াখালী ও বাগেরহাটের মোহনাগুলিতেও স্বল্পলোনা পানির পরিবেশ রয়েছে।

বাংলাদেশে স্বল্পলোনা পানির উলে­খযোগ্য সবুজ শৈবাল হলো Enteromorpha, Chaetomorpha, Lola, Rhizoclonium, Cladophorella এবং Boodleopsis গণের বিভিন্ন প্রজাতি। শ্বাসমূল ও মরা গাছের গুঁড়িতে অঢেল জন্মে লোহিত শৈবাল Catenella ও Caloglossa গণের প্রজাতিরা। এছাড়া আছে Pterosiphonia pennata, Lophosiphonia spp. ও Polysiphonia। স্বল্পলোনা পানির নীল-সবুজ শৈবালের মধ্যে উলে­খযোগ্য Aphanothece, xenococcus, Johannesbaptistia, Oscillatoria, Lyngbya, Microcoleus, Porphyrosiphon, Schizothrix, Hydrocoleum, Anabaenopsis, Anabaena, Scytonema-র প্রজাতিগুলি। এই ধরনের আবাসে Vaucheria (xanthophyceae) গণের নানা প্রজাতিও চোখে পড়ে। ডায়াটোমের মধ্যে স্বল্পলোনা পানির ডোবা-পুকুরে আছে Gyrosigma, Navicula, Pinnularia গণের প্রজাতিরা।  [জেড.এন তাহ্মিদা বেগম]

সামুদ্রিক শৈবাল (Marine algae)  সাগর ও মহাসাগরে বসবাসকারী ক্লোরোফিলযুক্ত উদ্ভিদ। সমুদ্রতলে আবদ্ধ সামুদ্রিক ‘আগাছা’ বা গাছপালা প্রায় সবই শৈবাল। আণুবীক্ষণিক শৈবালও আছে, এগুলি ফাইটোপ­াঙ্কটোন, পানির উপরে ভেসে বেড়ায় মুক্তভাবে।

সামুদ্রিক আগাছার বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য শক্ত বা পাথুরে বাস্ত্তভিত প্রয়োজন। এজন্যই বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কেবল সেন্ট মার্টিন দ্বীপাঞ্চলেই সামুদ্রিক শৈবাল আছে। শীত ও বসন্তে এদের প্রাচুর্য অনেক বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির ঢল এসব শৈবাল বৃদ্ধির পক্ষে বিঘ্নকর। সমুদ্রতলায় জোয়ারধৌত অঞ্চলে নীল-সবুজ শৈবালের (Cyanophyta = Cynobacteria) প্রাধান্য, যেমন Calothrix। জোয়ার ও ভাটার মধ্যবর্তী এলাকা এবং ভাটার নিম্নাঞ্চলে বাদামি (Phaeophyta), লাল (Rhodophyta) ও সবুজ (Chlorophyta) শৈবালের প্রাচুর্য বেশি। সবুজ শৈবালের মধ্যে আছে Caulerpa ও Enteromorpha গণের কিছু প্রজাতি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বাদামি শৈবালের মধ্যে Sargassum, Padina, Galaxura ও Dictyota গণের কতক প্রজাতিও প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। সাধারণত শীতল পানিতে ‘Kelp’ নামে পরিচিত Fucus ও Laminaria-র প্রজাতিগুলির প্রাধান্য বেশি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সুতার মতো, শাখাবিভক্ত অথবা পাতার মতো, গড়নের শৈবাল যেমন, Ceramium, Polysiphonia, Acanthophora, Hypnea-র প্রজাতি পর্যাপ্ত।

সামুদ্রিক ফাইটোপ­াঙ্কটোনের মধ্যে প্রধানত (কখনও ৯০% বা তার বেশি) আছে diatoms (Bacillariophyta), অতঃপর dinoflagellates (Dinophyta) ও নীল-সবুজ শৈবাল (Cyanophyta)। শেষোক্ত দুটি বর্গের শৈবাল কখনও কখনও অত্যধিক পরিমাণে জন্মায় এবং পানিতে বৈশিষ্ট্যময় রং ধরায়, যেমন Gymnodinium brevisGonyaulux catenella ঘটায় লোহিত জোয়ার এবং Trichodesmium erythraeum লোহিতসাগর। এগুলি থেকে বিষাক্ত দ্রব্য নিঃসৃত হওয়ার ফলে মাছ ও জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। Noctiluca miliaris নামের dinoflagellate আলো ছড়ায়। ফাইটোপ­াঙ্কটোনের ঘনত্ব ও বৈচিত্র্য গভীর সমুদ্রের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলেই অধিক।

বাদামি ও লাল শৈবালের কোষপ্রাচীরের নির্যাস নানাবিধ প্রয়োজনীয় বস্ত্তর উপাদান। কতিপয় বাদামি শৈবাল (প্রধানত Laminaria) থেকে নিষ্কাশিত alginic acid আইসক্রিম, অন্যান্য দুগ্ধজাতসামগ্রী, রং ও রাবার তৈরিতে ব্যবহার্য। গলগন্ড চিকিৎসায় ব্যবহূত খনিজ আয়োডিন আবিষ্কারের আগে Kelp ছিল আয়োডিনের একমাত্র উৎস (টন প্রতি ১৫ কেজি)। কোন কোন লোহিত শৈবালের কোষপ্রাচীরে থাকে agar ও carrageenan। আগার ব্যবহূত হয় নানা ধরনের খাবার তৈরিতে (মেয়োনেজ, পুডিং, ক্রিম ও জেলি), ঔষধশিল্পে (জোলাপ, মলম) এবং রোগতত্ত্ব ও জীবাণুবিদ্যার ল্যাবরেটরিতে। ক্যারাগিনানের ব্যবহার আগারের মতোই, তবে রং ও প্রসাধন (লিপস্টিক), দুগ্ধজাতসামগ্রী (আইসক্রিম), পুডিং, সস ও ক্রিম তৈরিতেই বেশি ব্যবহূত হয়। জাপান ও চীনে বাদামি শৈবাল, বিশেষত Liminariales বর্গের প্রজাতিগুলি উপাদেয় সবজি (জাপানে ‘কমবু’ ও চীনে ‘হাইদাই’ নামে পরিচিত)। Porphyra-র মতো কিছু লোহিত শৈবাল প্রোটিন ও ভিটামিনসমৃদ্ধ এবং সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী (জাপানে ‘নরি’, নোভা স্কসিয়ায় ‘ল্যাভের’ এবং চীনে ‘ঝি সাই’)। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে খাওয়ার উপযোগী কিছু সামুদ্রিক শৈবাল থাকলেও পরিমাণে সামান্য এবং সেজন্য আহরণযোগ্য নয়। এ দ্বীপে প্রায়শ ভাটার সময় বালুময় উপকূল থেকে সংগৃহীত কোমল শৈবাল শুকিয়ে জেলেরা সবজি হিসেবে খায়। সমুদ্রে মাছের উৎপাদনশীলতা ফাইটোপ­াঙ্কটোনের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। [আবদুল আজিজ]

আরও দেখুন অ্যাজোলা; জলজ আগাছা