শীল, রমেশ

শীল, রমেশ (১৮৭৭-১৯৬৭)  কবিয়াল। চট্টগ্রাম জেলার গোমদন্ডী গ্রামে তাঁর জন্ম। আঠারো-উনিশ শতকে  কলকাতা ও শহরতলীতে  কবিগান ও কবিওয়ালাদের উদ্ভব হয়। উনিশ-বিশ শতকে চট্টগ্রামের রমেশ শীল, বরিশালের  মুকুন্দদাস এবং মুর্শিদাবাদের শেখ গুমানী ছিলেন তাঁদের উত্তরসূরি। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বভাবকবি ছিলেন; গানের আসরে তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে গাইতেন।

রমেশ শীল

কবিয়াল হিসেবে রমেশ শীলের খ্যাতি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সম্মেলন’ উপলক্ষে আয়োজিত কবির লড়াইয়ের আসরে শেখ গুমানীকে পরাজিত করে শ্রেষ্ঠ কবিয়ালের মর্যাদা লাভ করেন।

ঐতিহ্যগতভাবে কবিগানের প্রধান বিষয় পৌরাণিক হলেও রমেশ শীল সমকালের নানা ঘটনা এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে গানের বিষয়বস্ত্ত করতেন। তাঁর জীবৎকালে সংঘটিত অসহযোগ ও  খিলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেনের আত্মাহুতি, দুর্ভিক্ষ, দেশবিভাগ, উদ্বাস্ত্ত সমস্যা,  ভাষা আন্দোলন, সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি, মহাজনি শোষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন এবং সেসব গেয়ে জনগণের মনে প্রতিবাদী ও সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করেছেন। পূর্বে কবিগান ছিল কেবল চিত্তবিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু রমেশ শীল একে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারে পরিণত করেন। এরূপ সংগ্রামী ভূমিকার কারণে তিনি ১৯৫৪ সালে কারাবরণ করেন এবং ১৯৬২ সালে সরকার কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত মাসোহারা হারান। লঘু বিষয় ও কুরুচির পরিবর্তে গুরু বিষয় ও সুরুচির আমদানি করে তিনি কবিগানের গুণগত পরিবর্তন সাধন করেন। এটিও তাঁর এক বিশেষ কৃতিত্ব।

রমেশ শীলের অপর কৃতিত্ব  মাইজভাল্পারিগান রচনা ও তা গেয়ে জনপ্রিয় করে তোলা। চট্টগ্রামের মাইজভান্ডারি তরিকার প্রবর্তক সৈয়দ আহমদুল্লাহ্র (১৮২৬-১৯০৬) গুণকীর্তন ও এ ধারার আধ্যাত্মিক মহিমা তুলে ধরে তিনি বহু গান রচনা করেন। তাঁর এ জাতীয় গানের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ। গানগুলি বিভিন্ন সময়ে আশেকমালা, শান্তিভান্ডার, মুক্তির দরবার, নূরে দুনিয়া, জীবনসাথী, সত্যদর্পণ, ভান্ডারে মওলা, মানববন্ধু ও এস্কে সিরাজিয়া এই নয়টি পুস্তকে প্রকাশিত হয়েছে।

মাইজভান্ডারির গদিনশিন পীর সৈয়দ গোলামুর রহমান (১৮৬৫-১৯৩৭) তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। রমেশ শীল এ তরিকায় দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং আন্তঃপ্রেরণাবশে এ ধারার সাধনসঙ্গীত রচনা করেন। এজন্য স্বসমাজে তিনি নিন্দিত হন, এমনকি একঘরে হয়ে জীবন কাটান। মৃত্যুর পর তাঁকে দাহ না  করে কবর দেওয়া হয়। রমেশ শীল প্রকৃত দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের অধিকারী ছিলেন। ‘হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকল ধর্মের এক কথা’, ‘মাটির মূর্তির পূজা ছেড়ে মানুষ পূজা কর’ এসব তাঁরই সাহসী উক্তি।

রমেশ শীলের গানের  গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘চলরে মন ত্বরাই যাই, বিলম্বের আর সময় নাই/ গাউছুল আজম মাইজভান্ডারি স্কুল খুলেছে’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। পুত্র যজ্ঞেশ্বর শীলও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এছাড়া ফণী বড়ুয়া, রাইগোপাল দাস প্রমুখের মতো যোগ্য শিষ্যও তিনি রেখে গেছেন। সম্প্রতি  বাংলা একাডেমী তাঁর সমগ্র রচনাবলি প্রকাশ করেছে। ১৯৬২ সালে  বুলবুল ললিতকলা একাডেমী রমেশ শীলকে শ্রেষ্ঠ লোককবির সম্মানে ভূষিত করে।  [ওয়াকিল আহমদ]