শিশু আইন

শিশু আইন  সাবালকত্ব প্রাপ্তির পূর্বপর্যন্ত সময়কালীন মানব সন্তানকে শিশু বলা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদে শিশুর বয়স ১৮ বছর ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ১৬ বছরের নিচে ছেলে-মেয়েদেরকে শিশু ধরা হয়েছে কিন্তু ২০১১ সালের জাতীয় শিশু নীতি অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কিশোর-কিশোরীকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের কারখানা আইনে শিশুর বয়স ১৬ বছর এবং দোকান ও প্রতিষ্ঠান আইনে ১২ বছর ধরা হয়েছে। খনি আইনে ১৫ বছরের নিচে, চুক্তি আইনে ১৮ বছরের নিচে এবং শিশু (শ্রম নিবন্ধক) আইনে ১৫ বছরের কম বয়সের মানবসন্তানকে বোঝানো হয়েছে। মুসলিম বিবাহ আইনে ১৮ বছরের কম বয়সের ছেলেমেয়েকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। খ্রিস্টানদের তালাক আইনে ছেলের বয়স ১৬ এবং মেয়ের বয়স ১৩ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়।

সাংবিধানিক ব্যবস্থা  বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হবে দেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করা। ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে এতিমদের অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার নিশ্চিত করা। ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বার্থের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে আরও দুটি অনুচ্ছেদে শিশুদের সম্পর্কে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এই ভাগে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ আছে। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কাজ করা আইনসিদ্ধ নয়। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র কোন প্রকার বৈষম্য দেখাবে না। শিশুদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে। ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সব ধরনের জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ। সুতরাং শিশুদের যদি শ্রমে বাধ্য করা হয় তবে তাও আইনে দন্ডনীয়।

মুসলিম পারিবারিক আইন  শিশুর অভিভাবক বাবা, বাবার অবর্তমানে ভাই, দাদা বা অন্যরা হতে পারেন। মা হলেন শিশুর জিম্মাদার। পুত্র সন্তানের বয়স ৭ বছর না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তানের বয়ঃসন্ধি না ঘটা পর্যন্ত মা তাদের হেফাজতকারী। শিশু তার পিতা বা মাতা যার হেফাজতেই থাকুক না কেন সর্ব অবস্থায় শিশুর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শিশুর পিতার। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ৫ ধারা অনুসারে শিশুবিবাহের শাস্তি হচ্ছে একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কারাদন্ড ও জরিমানা দুটোই একসঙ্গে হতে পারে। যিনি শিশুর বিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন অথবা অনুমতি প্রদান করেন তিনি শাস্তি ভোগ করবেন এবং যারা উক্ত বিয়ে সম্পাদনের কাজে সহায়তা করে ও জড়িত থাকে তারাও শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

বাংলাদেশের দন্ডবিধি  বাংলাদেশের দন্ডবিধির ৮২ ধারা অনুযায়ী সাত বৎসরের কমবয়স্ক শিশু দ্বারা সংঘটিত কোন অপরাধই অপরাধ বলে গণ্য হবে না। ৮৩ ধারা অনুসারে ৭ বছরের বেশি এবং ১২ বছরের কম বয়সের শিশুর দ্বারা কৃত কোন কিছুই অপরাধ বলে গণ্য হবে না যদি উক্ত অপরাধের ব্যাপারে যে শিশুর বোধশক্তি এতদূর পরিপক্কতা লাভ করেনি যে, সে স্বীয় আচরণের প্রকৃতি ও পরিণতি বিচার করতে পারে। ১৮৬০ সনের দন্ডবিধির ২৬১ ধারা অনুসারে যদি কেউ ১৪ বছরের কম বয়সের ছেলে বা ১৬ বছরের কম বয়সের মেয়েকে তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া ছিনিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যায় তবে তাকে বলা হয় শিশু অপহরণ। দন্ডবিধির ৩৬৪ (ক) ধারা অনুসারে যদি কোন ব্যক্তি ১০ বৎসরের কম বয়স্ক কোন ব্যক্তিকে অপহরণ করে এবং তার উদ্দেশ্য থাকে তাকে খুন বা গুরুতর আঘাত বা দাসত্বে বাধ্য বা পাশবিক নির্যাতন করে তবে সেই ব্যক্তির শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ড। সে অর্থদন্ডেও দন্ডিত হতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি বেআইনিভাবে পাচার বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কোনো শিশুকে নিজ হেফাজতে রাখে বা উক্ত উদ্দেশ্যে কোন শিশুকে কোন ব্যক্তির নিকট পাওয়া যায় তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। যদি কোন ব্যক্তি মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে কোন শিশুকে অপহরণ করে বা আটক রাখে, তা হলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। দন্ডবিধির ৩৭২ ধারা অনুসারে কোন শিশুকে পতিতালয়ে বিক্রয় করলে তার শাস্তি দশ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড। দন্ডবিধির ৩৭২ ও ৩৭৩ ধারা অনুযায়ী যে শিশুকে পতিতালয়ে বিক্রয় করে এবং যে ক্রয় করে উভয়েরই শাস্তি হবে। শিশুকে পতিতালয় থেকে উদ্ধার করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিয়ে উদ্ধার করতে হবে। শিশুকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করালে বা তাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করলে দন্ডবিধির ৩৭২ ধারা অনুসারে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড হতে পারে।

শ্রম আইন  যে শিশুর বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি, তাকে কারখানায় কাজ দেওয়া যাবে না। তবে ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে কিন্তু ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এমন তরুণদের শর্তসাপেক্ষে নিয়োগ করা যায়। যেমন, ৭০ ধারায় শিশুদের কাজের সময় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের কারখানা আইনের ২২ ধারা অনুযায়ী শিশুদের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ। তরুণ শ্রমিকদের দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে তাদের কাজ দিতে হবে। এর আগে বা পরে তরুণ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না। এদের দিয়ে একটি শিফটেই কাজ করানো যাবে। চিফ ইন্সপেক্টরের অনুমতি ছাড়া ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে একবারের বেশি শিফট বদল করা যাবে না। কোন তরুণকে যন্ত্রের কোন অংশ চালু থাকা অবস্থায় সেখানে পরিষ্কার করা, তেল লাগানো বা বিন্যস্ত করা বা সংযোজনের কাজ করতে দেওয়া যাবে না বা চলমান যন্ত্রের আশপাশে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত বিপদাপদ এবং তা থেকে সতর্কতা অবলম্বন সম্পর্কিত সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ না দেওয়া পর্যন্ত কোন তরুণ শ্রমিককে যন্ত্রে কাজ দেওয়া যাবে না। কোন কারখানার যে অংশে তুলা সংকোচন করে বস্তাবন্দি করা এবং সুতা কাটার যন্ত্র চালু আছে সেখানে তরুণকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। তরুণদের কাজে নিয়োজিত করতে হলে সংল্লিষ্ট সার্টিফিকেট দানকারী সার্জনের নিকট থেকে দৈহিক সক্ষমতা সার্টিফিকেট নিতে হবে।

ভবঘুরে আইন  ভবঘুরে আইন, ১৯৪৩-এর ৩ ধারা অনুযায়ী সরকার ভবঘুরেদের জন্য ভবঘুরে উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করেছে। এই আইনের ৮ ধারা অনুসারে ভবঘুরেদের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করবে আর সেখানে ভবঘুরেদের আটক রাখা হবে এবং তাদের প্রাথমিক ডাক্তারি পরীক্ষা করা হবে। ১৯ ধারা অনুসারে ভিক্ষুক হিসেবে শিশুদের নিয়োজিত করলে তার শাস্তি দুই বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের সশ্রম কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় প্রকার দন্ডই হতে পারে। যিনি কোন শিশুর হেফাজত, দায়িত্ব বা তত্ত্বাবধানে থাকাকালে শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে উৎসাহিত করেন তিনি এবং যে শিশুকে ভিক্ষা করতে বাধ্য করে উভয়েই শাস্তি পাবে।

শিশু সংশোধনী প্রতিষ্ঠান এবং তার দায়িত্ব কিশোর অপরাধী সংশোধনী প্রতিষ্ঠান তিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির একটি সমন্বিত প্রতিষ্ঠান। তিনটি কর্মসূচি হচ্ছে: ১. কিশোর আদালত; ২. কিশোর হাজত; ৩. সংশোধনী প্রতিষ্ঠান।

কিশোর আদালত  বাংলাদেশ শিশু আইন ১৯৭৪ অনুযায়ী একজন প্রথম শ্রেণির সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মচারী সমন্বয়ে এই আদালত গঠিত। মাসে সাধারণত দুই, তিন বা ততোধিক বার উক্ত আদালতে বসে।

কিশোর হাজত  প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আদালতের মতো নিজস্ব কিশোর হাজতবাস রয়েছে। যদিও হাজতবাস নামে এ বিভাগটি পরিচিত কিন্তু সনাতনী অর্থে এটা কোন হাজত নয়। প্রতিষ্ঠানটিকে পর্যবেক্ষণ বিভাগ নামকরণ করা যেতে পারে। আদালতে মামলা ওঠার পর এবং মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে কোন কোন কিশোরকে প্রয়োজনবোধে এই হাজতে রাখা হয়। এ সময়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে কিশোরকে পর্যবেক্ষণ ও জিজ্ঞাসাবাদ করে তার চরিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে অপরাধের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তাদের পর্যবেক্ষণ ও অভিভাবকমন্ডলীর কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রবেশন অফিসার বা তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রতিবেদন পেশ করেন। কিশোর হাজতখানায় থাকাকালে কিশোররা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, কিন্তু এ সময়ে তারা পড়াশোনা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। যেহেতু এটা অল্প সময়ের ব্যাপার, তাই তাদের পড়াশোনা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের তেমন ক্ষতি হয় না।

সংশোধনী প্রতিষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে সংশোধনী কার্যক্রম। বিচারে দোষী বিবেচিত হলে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংশোধনের প্রয়োজন হলে কিশোরকে সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে সোপর্দ করা হয়। প্রতিষ্ঠানে আনার পর কিশোরের যাবতীয় দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে কর্মকর্তা এবং কর্মচারী সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক, প্রবেশন অফিসার ও সোশ্যাল কেস ওয়ার্কার এবং সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মচারীদের নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভা বসে। এই সভায় সোশ্যাল কেস ওয়ার্কারের রেকর্ড-এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারীদের অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রয়োজনবোধে সংশোধনের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।  [গোলাম কিবরিয়া]