শিলালিপি

শিলালিপি (মধ্যযুগ)  বিভিন্ন স্থাপনার গায়ে সাঁটা পাথরে উৎকীর্ণ লিপি। সুলতানি পর্বে প্রধানত ধর্মীয় স্থাপনা, যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, সমাধি প্রভৃতির গায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিলালিপি উৎকীর্ণ হয়েছিল। মুগল পর্বে ধর্মীয় স্থাপনায় সংযুক্ত শিলালিপি ছাড়াও লৌকিক ইমারতে কিছু সংখ্যক শিলালিপি পাওয়া যায়। সুলতানি বাংলায় (১২০৪-১৫৩৮ খ্রি.) প্রাপ্ত শিলালিপি ছিল সাধারণত আরবিতে উৎকীর্ণ। ফারসি লিপির সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিলালিপিতে সাধারণত কুরআনের আয়াত, হাদিস, সুলতানের পরিচয়, উৎকীর্ণকারী কর্মকর্তার পরিচয় এবং তারিখ খোদিত থাকতো। শিলালিপিসমূহের সিংহভাগই মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, প্রাসাদ, সেতু, ঈদগাহ, ফটক ইত্যাদি নির্মাণ বা পুকুর, কূপ খননের সময় উৎকীর্ণ করা হতো।

শিলালিপি

মধ্যযুগের বাংলার শিলালিপি মুসলিম ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিখন শিল্পানুসারে লেখা হতো। ইসলাম ধর্মে প্রাণীদেহ অঙ্কনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় লিপি, ফুল, পত্র, বৃক্ষাদি ও নকশা অলংকরণের দিকে শিল্পিরা মনোযোগী হয়েছিলেন। আরবি ক্যালিগ্রাফির ক্রমবিকাশের ধারাক্রম মধ্যযুগের বাংলার শিলালিপিতেও দৃশ্যমান। এখানে আরবের মতই ধারাবাহিকভাবে বিকাশ লাভ করেছে কুফিক, নাসখ, তালিক ও নাস্তালিক ধারার লিখন পদ্ধতি। এসব লিপির বাইরেও মুসলিম শাসন যুগের সূচনালগ্নেই আকর্ষণীয় শৈল্পিক অলংকরণ সমৃদ্ধ শিলালিপি পাওয়া গেছে। এই ধারার লিপি ‘তোঘরা’ নামে পরিচিত। তবে এটি কোন স্বতন্ত্র লিখন পদ্ধতি নয়, প্রচলিত পদ্ধতিরই শিল্পমান সমৃদ্ধ একটি প্রকাশ। বিমূর্ত অলঙ্করণের জন্য শিল্পিরা আরবি বর্ণমালাকে কখনো লম্ব কখনো সমান্তরাল আবার কখনো বক্রাকারে অবস্থাভেদে সম্প্রসারিত ও সংকুচিত করে উপস্থাপন করেছেন।

বক্তব্য প্রকাশে সুলতানি বাংলার শিলালিপির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, প্রথমত ক. শিলালিপিতে প্রায়শই সুলতানদের নাম উপাধিসহ উৎকীর্ণ হতো খ. লখনৌতির নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের নাম ও উপাধি কোন কোন শিলালিপিতে উৎকীর্ণ হতো। দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট নাম-উপাধি ছাড়াও বিভিন্ন শিলালিপিতে নানা ধরনের গুণবাচক উপাধি পাওয়া যায়। যেমন, ক. দাপ্তরিক উপাধি- শাহজাদা,উজির, শর-ই-লস্কর, মুনসিফ, দীউয়ান, কোতয়াল, বাকআলি, মাহলিয়ান, নওবাদ আলী, জমাদার বইরমাহলি, মরাবদার, ঘইরমাহলী, মীনবক, শিকদার,জংদার, মীর বহর, শের-ই-খেল, কারা-ই-ফরমান, কাজীদস্তর, শের-ই-গুমস্তাহ ইত্যাদি। খ. প্রশংসা বাচক উপাধি- গাউস উল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন, মুগিস আল মুলক ওয়াল সালাতিন, মুঈন আল মুলক ওয়াল সালাতিন, নাসের আল মুলক ওয়াল সালাতিন, সাহিব আল আদল ওয়াল বাফাত, সাহিব আল সঈফ ওয়াল কালাম ইত্যাদি। তৃতীয়ত, কোন কোন শিলালিপিতে তোঘরা রীতির বিন্যাস থাকলেও লিপির মাঝখানে ও আশেপাশে শৈল্পিক অলংকরণ করা হতো। চতুর্থত, কোন কোন শিলালিপিতে সুফিদের নামোল্লেখ থাকত। এ সূত্রে সুফিদের অবস্থান ও কর্মভূমিকা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। পঞ্চমত, মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত শিলালিপির শুরুতে ’বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম’ লেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ষষ্ঠত, সুলতানি বাংলার শিলালিপিসমূহ বিশ্লেষণ করে বেশ কয়েকটি অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। যেমন, আরসাহ সাজলা মকনাহবাদ, শহর বা থানা লাওবলা, শহর সিমলাবাদ, আরসা এবং মহল অথবা শহর হাদিগড়, শহর মশহুর হুসাইনাবাদ, ইকলিম মুবারকাবাদ, ইকলিম মুয়াজ্জমাবাদ, আরসা শ্রীহট, মাহমুদাবাদ ইত্যাদি।

বাংলার মুসলিম শাসকদের মধ্যে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজির (১২১৩-১২২৭ খ্রি.) নামাঙ্কিত শিলালিপি ছিল সবচেয়ে প্রাচীন। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ এ শিলালিপিটি মখদুম শাহের দরগাহ সাঁটা ছিল। দরগাহটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে অবস্থিত। বাংলা অঞ্চল ছাড়াও প্রথম পর্বের শাসনকর্তাদের কোন কোন শিলালিপি বিহারেও পাওয়া গেছে। স্বাধীন সুলতানি যুগে প্রথম ইলিয়াস শাহী সুলতানদের শিলালিপি পাওয়া যায়। ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পর বাংলার শাসন কাঠামোয় সাময়িক দুর্বলতা নেমে আসে। এ দুর্বলতার সুযোগে রাজ অমাত্য গণেশ সীমিত সময়ের জন্য বাংলায় হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। গণেশের নামাঙ্কিত কোন শিলালিপি পাওয়া যায় নি। গণেশের পুত্র যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময়ে (১৪১৫-১৪৩৩ খ্রি.) রাজশাহী ও ঢাকায় দুটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাঁর পুত্র আহমদ শাহের তারিখ বিহীন একমাত্র শিলালিপিটি পাওয়া যায় সোনারগাঁওয়ের মুয়াজ্জমপুরে।

পরবর্তী ইলিয়াস শাহী সুলতানদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে। এঁদের মধ্যে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে (১৪৩৬-১৪৫৯ খ্রি.) মোট ১৭টি, সুলতান রুকনউদ্দির বারবক শাহের সময়ের (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.) ১৮টি, সুলতান শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহের সময়ের (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.) ১১টি, সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের সময়ের (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রি.) ১০টি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে।

বাংলার স্বাধীন সুলতানি রাজ্যের পরবর্তী শাসক ছিলেন হাবশি সুলতানরা। এ সময়ের বেশ কয়েকটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সুলতান সাইফউদ্দিন ফিরুজ শাহের সময়ের (১৪৮৭-১৪৯০ খ্রি.) ৫টি এবং সুলতান শামসউদ্দিন মোজাফফর শাহের সময়ের (১৪৯০-১৪৯৩ খ্রি.) ৫টি শিলালিপি পাওয়া যায়।

বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগে সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময় অতিবাহিত হয়েছে হোসেনশাহী যুগে। এ যুগে উলে­খযোগ্য সংখ্যক স্থাপত্য নির্মিত হয়। ফলে শিলালিপি প্রাপ্তির সংখ্যাও বেশি। এর মধ্যে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সময়ের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) ৭৭টি, সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহের সময়ের (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.) ২৩টি, সুলতান আলাউদ্দিন ফিরুজ শাহের সময়ের (১৫৩২-১৫৩৩ খ্রি.) ১টি এবং সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ের (১৫৩৩-১৫৩৮খ্রি.) ৮টি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে।

স্বাধীন সুলতানি শাসনের অবসানের পর অল্প কিছু কাল বাংলা মুগল সম্রাট হুমায়ুনের অধিকারে ছিল। এর পর বাংলা চলে যায় আফগান সুলতানদের অধীনে। ১৫৪১ থেকে ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আফগান সুলতানদের বেশ কয়েকটি শিলালিপি পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুলতান  শেরশাহর (১৫৩৮-১৫৪৫ খ্রি.) নামাঙ্কিত ৪টি (এগুলো কামানের গায়ে উৎকীর্ণ ‘কামান লিপি’), সুলতান শামসউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ গাজীর (১৫৫৪-১৫৫৫ খ্রি.) ১টি, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ সূরের (১৫৫৬-১৫৬০ খ্রি.) ৫টি, সুলতান গিয়াসউদ্দিন জালাল শাহের (১৫৬০-১৫৬৩ খ্রি.) নামাঙ্কিত ৩ টি এবং সুলায়মান কররানির সময়ের (১৫৬৪-১৫৭২ খ্রি.) ৫টি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে।

মুগল শাসনযুগে সুবাহ বাংলায় প্রেরিত সুবাহদার এবং স্থানীয় শাসকরা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেন। এখানে উৎকীর্ণ শিলালিপি সমূহে সাধারণত সমসাময়িক মুগল সম্রাটদের নাম লেখা হতো। এ পর্বে উলে­খযোগ্য সংখ্যক শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে সম্রাট  জাহাঙ্গীরের সময়ের (১৬০৫-১৬২৩ খ্রি.) ৫টি, সম্রাট শাহজাহানের সময়ের (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রি.) ১৮টি, সম্রাট  আওরঙ্গজেবের সময়ের (১৬৫৯-১৭০৭ খ্রি.) ২১টি, সম্রাট শাহ আলম বাহাদুর শাহের সময়ের (১৭০৭-১৭১২ খ্রি.) ১টি, সম্রাট ফররুখ সিয়ারের সময়ের (১৭১৭-১৭১৮ খ্রি.) ১টি, সম্রাট মুহম্মদ শাহের সময়ের (১৭১৯-১৭৪৮ খ্রি.) ১০টি এবং সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের সময়ের (১৭৫৪-১৭৫৯ খ্রি.) শিলালিপি পাওয়া যায়।

শিলালিপি ( উপনিবেশিক যুগ)  মধ্যযুগের লিপিসাক্ষ্য প্রধানত স্থাপনার গায়েই পাওয়া গিয়েছে। এসব স্থাপনার সিংহভাগ ছিল মসজিদ। এসব স্থাপনার বেশিরভাগ সরকারীভাবে নির্মিত হতো বলে শিলালিপিতে বক্তব্য প্রকাশের ধরনও ছিল অনেকটা অভিন্ন। অধিকাংশ লিপি ছিল আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা। বাংলা লিপি ছিল হাতেগোণা। সমকালীন ইতিহাস গ্রন্থ না থাকায় মধ্যযুগের ইতিহাস পুনর্গঠনে এসব লিপিসাক্ষ্যের বিশ্লেষণ অপরিহার্য। তবে এ ক্ষেত্রে উপনিবেশিক যুগের চরিত্র ছিল আলাদা। ইউরোপীয়দের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা শিক্ষা ও সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটেছে। এ যুগে আরবি ফারসি শিলালিপি ছাড়াও ইংরেজি এবং গ্রিক ভাষায় উৎকীর্ণ শিলালিপি গির্জা, ইউরোপীয়দের বসত বাটি এবং গ্রিক ও ইংরেজ সমাধিতে ছিল।  দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়ি ও মসজিদে অনেক সময় পরিচয় জ্ঞাপক কয়েক ছত্র বা নির্মাতার নাম ও নির্মাণ তারিখ বাংলা লিপিতে লেখা হয়েছে।

কখনো কখনো বিদেশীদের স্মৃতিস্তম্ভে স্মারক লিপি থাকলেও তা মধ্যযুগের শিলালিপির মত ইতিহাসের দৃষ্টিতে গুরুত্ব ধারণ করেনি। আর এসব শিলালিপির সংখ্যাও সীমিত। এ কারণে উপনিবেশিক যুগের লিপিসাক্ষ্য ইতিহাস চর্চায় আলাদা স্থান করে নিতে পারেনি। এ যুগে নানা ভাষায় উৎকীর্ণ বিচ্ছিন্ন শিলালিপি ইতিহাস রচনায় অপরিহার্য আকর-সূত্র হিসেবে ব্যবহূত না হওয়ায় এ সময়ের শিলালিপির তালিকাও তৈরি হয় নি। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার ভেতর প্রাপ্ত ঔপনিবেশিক যুগের কয়েকটি শিলালিপি যথাক্রমে: ১. দিনাজপুরের আউকারা মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৭৫৮-৫৯ খ্রি.) ২. রংপুরের মিঠাপুকুরস্থ ফুলচৌকিতে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৭৫৯-৬০ খ্রি.) ৩. নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৭৭৭-৭৮ খ্রি.) ৪. নিলফামারীর গড়গ্রামে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৭৭৭ খ্রি.) ৫. নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জে কদম রসুল দরগাহয় প্রাপ্ত শিলালিপি (১৮০৫-০৬ খ্রি.) ৬. ঢাকার মিরপুর শাহ আলী বাগদাদীর মাজারে প্রাপ্ত শিলালিপি (১৮০৬-০৭ খ্রি.) ৭. নোয়াখালীর মাতুবি মসজিদে প্রাপ্ত দুইটি শিলালিপি (১৮১৪-১৫ ও ১৯০১-০২ খ্রি.) এবং ৮. চট্টগ্রাম শহরস্থ  শাহী জামি মসজিদ-এ প্রাপ্ত শিলালিপি (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.)।  [এ.কে.এম শাহনাওয়াজ]