লোকজ গণমাধ্যম

লোকজ গণমাধ্যম ধ্বনি, চিত্র বা ইমেজ এবং ইশারার ভাষাকে ভিত্তি করে হাজার বছর ধরে প্রচলিত লোকাচারের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে পূর্ণতা পায় লোকজ মাধ্যম। প্রতিটি সমাজ, জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের লোকজ মাধ্যমগুলি তাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এগুলি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও এলাকার নিজস্ব লোকসঙ্গীত, লোকনাট্য, লোকনৃত্য এবং পুতুল নাচের ধারায় স্বতন্ত্র রূপে বিরাজ করে। বর্তমান বাংলাদেশ বহুযুগ ধরে এধরনের অনেকগুলি লোকজ মাধ্যম উত্তরাধিকারসূত্রে লালন করে আসছে। এই লোকজ মাধ্যমগুলি বাঙালি জাতির আবেগময় সংহতির যোগসূত্রও বটে। ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলির চরম বিকাশ এই বিশ্বকে মূলত একটি পল্লীতে রূপান্তরিত করলেও এগুলি বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের লোকজ মাধ্যমগুলির স্বাতন্ত্র্যকে বিলীন করতে পারে নি। বরং বাংলাদেশের সমাজে লোকজ মাধ্যমগুলি এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে যে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলি বরং লোকজ শিল্পমাধ্যমগুলিকেই জনপ্রিয় করে চলছে। গণমাধ্যমগুলিতে লোকজ মাধ্যমগুলির উপাদানসমূহ বিশেষভাবে প্রদর্শিত ও প্রচারিত হচ্ছে। জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তন সাধনের লক্ষ্যে পরিচালিত উন্নয়ন যোগাযোগে তাই লোকজ মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি উন্নয়ন, নারী ও শিশু অধিকারের মতো বিষয়গুলির সম্পর্কে প্রদত্ত বার্তাসমূহ বিভিন্ন লোকজ মাধ্যমে পরিবেশিত হয়। এই মাধ্যমগুলি নিতান্তই অনানুষ্ঠানিক ও জনপ্রিয়। বাংলাদেশের জনগণের বৃহদাংশ পল্লীর বাসিন্দা, তাদের বেশির ভাগের জন্যই এখনও আধুনিক বিনোদন উপভোগের সুযোগ নেই। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিভিন্নমুখী সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত তাদের জীবনে যে কোন লোকশিল্পীর পরিবেশনা অনেক স্বস্তিকর ও আনন্দদায়ক। লোকজ মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন শিল্পেরও প্রসার ঘটেছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকজ শিল্প হচ্ছে সঙ্গীত। লোকসঙ্গীতের বিবিধরূপ, যথা বাউল, মারফতি, মুর্শিদি ইত্যাদি মরমি ধারার গানের পাশাপাশি হামদ, নাত, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীতের মতো ভক্তিমূলক গান, পালাগান, পুঁথিপাঠ, সাপুড়েদের গান এবং জারী-সারি-ভাওয়াইয়ার মতো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মুখে প্রচলিত গানগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ সকল গানের বাণী ও সুরে আশা-আনন্দ, দুঃখ, প্রেম ও বিরহের ছোঁয়া থাকে। এ সকল গান অতিসাধারণ মানুষের হূদয় থেকে উৎসারিত হয়ে মুখে মুখে রচিত হয়ে থাকে। এগুলির আবেদন চিরন্তন। এ সকল গানের স্বতোৎসারিত সুর ও বাণী পরবর্তীকালে কবিয়াল, গায়েন, দোহার ও বাদ্যযন্ত্রীদের চর্চায় পরিশীলিত রূপ লাভ করে। সারা বাংলাদেশে কবির লড়াই নামে প্রচলিত কবিগান একটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের ধারা। কোন বিশেষ বিষয়ে দুজন গায়ক মুখে মুখে বাণী রচনা ও সুর সংযোজনা করে তাৎক্ষণিকভাবে  গানে গানে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে প্রচলিত আরেকটি জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের ধারা হচ্ছে গম্ভীরা। একজন নানা ও নাতি একত্রে পায়ে ঘুঙুর বেuঁধ এই নৃত্যগীত পরিবশেন করেন। এই ধারার গানের প্রচলিত সুর অবিকৃত রেখে শুধু নতুন বাণী রচনা করে পরিবেশন করা হয়। গণসঙ্গীত আমাদের লোকসঙ্গীতে সংযোজিত সর্বশেষ ধারা। নিষ্পেষিত  ও শোষিত জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত সংস্কৃতি কর্মীরা এই ধারাটিকে লালন করে আসছেন। এ ধরনের গানে গভীর দেশপ্রেম ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার সচেতনতা প্রকাশ পায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণসঙ্গীতই বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। লোকসঙ্গীতে বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্যময় ভূমিকা একেবারেই মৌলিক। বাংলাদেশের লোকগীতি এ দেশের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র একতারা, দোতারা, সারিন্দা, বাঁশি, ঢোল-খোল বা করতাল ছাড়া পরিবেশন করা হয় না।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু সম্পর্কিত বার্তাসমূহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য  লোকজ মাধ্যমসমূহ অত্যন্ত কার্যকর। এজন্য কিছুসংখ্যক লোকজন নিয়ে দল গঠন করা হয়। দলভুক্ত শিল্পীদের বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ এবং অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে কম এবং সাধ্যের আওতায় থাকায় জনগণের কাছাকাছি অনুষ্ঠিত তাদের আসর সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় এ ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠিত হয়েছিল। তাদের কাজ ছিল স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনমতকে নিজেদের অনুকূলে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে একটি সঙ্গীত প্রচার ইউনিট গঠন করেছিল। পরবর্তীকালে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকারগুলি নিজ নিজ দেশে এই ইউনিটকে আরও সুসংগঠিত করে। ভারতে গঠিত প্রতিষ্ঠানের নাম সঙ্গীত নাটক একাডেমী। এর মূল দায়িত্ব ছিল দেশব্যাপী উদ্বুদ্ধকরণমূলক অনুষ্ঠানমালা পরিবেশন করা। বাংলাদেশে জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠিত গণযোগযোগ অধিদফতর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর অফিসগুলি অনুরূপ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

বাংলাদেশের লোকনাট্যের জনপ্রিয়তম রূপ হলো যাত্রা। মুক্তমঞ্চে অপেরাধর্মী এই যাত্রাপালা শরৎ ও শীতের রাতে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে আপামর পল্লীবাসীর সামনে অভিনীত হয়। যাত্রা হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন ধারার মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সৃজনশীল কর্ম। মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় পরিপুষ্ট এই লোকশিল্পটি একটি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের এই পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। অতীতকালে পল্লীবাসীরা নিজেরাই যাত্রায় অভিনয় করতেন। তারা মহা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সম্মিলিতভাবে মঞ্চ তৈরি ও রূপসজ্জা করতেন। পোশাক ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিজেদের অর্থে ক্রয় করতেন। তখন কোন গ্রামে নাটক মঞ্চস্থ করা, বিশেষ করে ফসল তোলার পর ছিল একটি বিরাট ঘটনা। পরবর্তীকালে যাত্রাদল বাণিজ্যিকভাবে গঠিত হতে থাকে। শৌখিন শিল্পীদের বদলে পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আগমন ঘটতে থাকে। যাত্রার জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে এর সহজ যোগাযোগ প্রক্রিয়া। কারণ, শিল্পী ও দর্শকদের মধ্যে এতে কোন দূরত্ব থাকে না। সহজ-সরল কথায় জীবন্ত অথচ অনানুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত পালা-অভিনয় দর্শকদের আকৃষ্ট করে রাখত। হাল আমলে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত মানসিকতাবশত যাত্রাদল মালিকরা দুই অঙ্কের মাঝখানে আধুনিক নাচ ও গান উপস্থাপনের প্রথা চালু করেছেন। এর উদ্দেশ্য অধিক দর্শককে আকৃষ্ট করা।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিনোদন ধারার মধ্যে এখনও আঙ্গিকের দিক থেকে কোনক্রমে টিকে রয়েছে কেবল বহুরূপীর প্রদর্শনী। বহুরূপী দর্শকদের সামনে বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরে সুনিপুণভাবে অতি পরিচিত কোন ব্যক্তির কথা ও আচরণ অনুকরণ করে ব্যঙ্গাত্মক অভিনয় করেন। এমন বিচিত্র আকর্ষণীয় ব্যক্তির হরবোলার ডাক শুনে শ্রোতা-দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ত। অতীতে কোন বহুরূপী গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের পৃষ্টপোষকতায় তাদের বাড়ীর আঙিনায় অনুষ্ঠান করতেন। বহুরূপীর আগমনে সকল গ্রামে দারুণ সাড়া পড়ে যেত। অনুষ্ঠানে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই উপস্থিত হতো। বর্তমানে এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী বহুরূপীকে বাংলাদেশের কোথাও কোথাও ক্বচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। তবে কথার যাদুতে হূদয় হরণ করা বা সাজসজ্জা, অঙ্গভঙ্গি কিংবা বাক্যালাপের মাধ্যমে মানুষের মনোরঞ্জন করার মতো সহজাত গুণ এখনকার বহুরূপীদের মধ্যে দেখা যায় না। আজকাল পোশাকে বহুরূপী এমন অনেককে গ্রামে-গঞ্জে অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। তারা মূলত কোন না কোন কোম্পানির পণ্য প্রচারে নিয়োজিত।

বাংলাদেশের সম্ভবত একমাত্র যে লোকজ মাধ্যমটি আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অবিকৃতরূপে বিরাজ করছে তা হলো পুতুল নাচ। বাংলাদেশে নাচের পুতুল তৈরি ও সঙ্গীত রচনার বেশ কয়েকটি কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। এখান থেকে বেশিরভাগ দল গীতবাদ্য সহকারে বক্তব্যপ্রধান ও পালাধর্মী পুতুল নাচ পরিবেশন করতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উন্নয়ন ও যোগাযোগ কৌশলকে কার্যকর করতে পুতুলনাচ মাধ্যমটি ব্যবহূত হয়ে আসছে। শিক্ষামূলক ও প্রচারধর্মী কার্যক্রমে পুতুল নাচ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।

পটচিত্র এবং বস্ত্রে অঙ্কিত চিত্র বাংলাদেশের দ্রুত অপসৃয়মাণ একটি লোকজমাধ্যম। আগেকার দিনে সনাতন ধারার চিত্রশিল্পীরা হিন্দু পুরাণ, মুসলিম ধর্মীয় কাহিনীর চরিত্র ও ঘটনাবলিকে তাদের শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলতেন। মৃৎপাত্রের গায়ে রঙয়ের প্রলেপ দিয়ে কিংবা ধাতবপাত্রে খোদাই কাজ করে এ সকল বিষয় ফুটিয়ে তোলা হতো। নকশি কাঁথায় বহুবর্ণের সুতায় ফুল, পাতা, পাখির নকশা ফুটিয়ে তোলা আজও জনপ্রিয়। তবে হাট-বাজারে বা শহরে বস্ত্রের উপর অঙ্কিত যেসব চিত্র চোখে পড়ে, এগুলি নিতান্তই বিজ্ঞাপন। এগুলির বেশির ভাগই হাতুড়ে চিকিৎসক ও ফকির কবিরাজদের রোগ নিরাময় ও উপসর্গের কার্যকর বিধান বলে দাবিকৃত প্রচার সামগ্রী মাত্র।

বাংলাদেশের জনজীবনে মেলার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বছরের পূর্ব-নির্ধারিত কতগুলি দিনে গ্রাম ও শহরের নির্দিষ্ট স্থানে যেখানেই এই মেলা বসে সেখানেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন স্তরের মানুষের জনসমাগম ঘটে। তারা সেখানে মেলার আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি শিশুদের খেলনা, হস্তশিল্পজাত পণ্য এবং শখের জিনিসপত্রসহ সংসারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেচাকেনার সুযোগ পায়। নিয়মিত বা বিশেষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলার স্থান তথা হাট-বাজার গণযোগাযোগ সেবা প্রদানের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর।

তথ্য আদান-প্রদানের আরেকটি অতি পুরাতন ঐতিহ্যময় ব্যবস্থা হচ্ছে সমাবেশ অনুষ্ঠান। আগেকার দিনে সমাবেশের স্থান ও সময়সূচি ঘোষণার দায়িত্ব ছিল জমিদার বা সরকার নিযুক্ত চৌকিদারের কিংবা ঢুলির। মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ মাহফিলের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিও গণজ্ঞাপন ও জনমত গঠনের উল্লেখযোগ্য লোকজ মাধ্যম। গণপ্রার্থনা, কোন গোষ্ঠী বা দলের সভা, দলীয় বৈঠকের মতো বিষয়গুলিও জনমত গঠনের জন্য অতি কার্যকর ফোরাম হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে উন্নততর প্রযুক্তিনির্ভর মুদ্রণ ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ব্যবহার যদিও বাড়ছে, চিরাচারিত প্রায় সকল লোকজ মাধ্যম তথা মৌখিক যোগাযোগ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে এখনও অত্যন্ত কার্যকর।  [মাহবুবুল আলম এবং মোহাম্মদ হান্নান]