লেনদেন ভারসাম্য

লেনদেন ভারসাম্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ কর্তৃক বিভিন্ন খাতে বিশ্বের সকল দেশকে পরিশোধকৃত এবং সকল দেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তথা সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক অন্য কথায়, লেনদেনের সমন্বিত হিসাব। দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দ্রব্য, সেবা আমদানি-রপ্তানি, মূলধন তহবিলসহ বিদেশে সর্বপ্রকার অর্থ প্রেরণ এবং বিদেশ থেকে গ্রহণসংক্রান্ত লেনদেনসমূহের পার্থক্যই লেনদেন ভারসাম্য। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ভারসাম্যের হিসাবে ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে আসছে। অত্যধিক আমদানি নির্ভরশীলতা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ তহবিল গ্রহণের কারণেই বাণিজ্যিক হিসাব খাতের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী তেলের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে অপরিশোধিত তেল, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদি এবং সার আমদানি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রণীত লেনদেন ভারসাম্য ম্যানুয়্যাল অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের লেনদেন ভারসাম্যের প্রকৃত অবস্থা চিহ্নিত ও প্রস্তুত করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদিত ডিলারদের লেনদেনের বিবরণী, খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্য আমদানি-সংক্রান্ত দলিলাদি, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য আমদানিকৃত দ্রব্যাদির রেকর্ড, শুল্ক বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত অন্যান্য দলিলাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে নানাবিধ সুবিধা প্রদান ও কৌশল অবলম্বন এবং বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের অর্থপ্রেরণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির হার অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ১,০০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপি-র ৭.০৮%-এ উন্নীত হয়। অর্থবছর ২০০২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত (২০০৫, ২০১১ ও ২০১২ ব্যতীত) প্রায় এক দশকের অধিককাল ধরে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্য ধারাবাহিকভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। পরবর্তীতে ২০১৭ থেকে ২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বিরাজ করছে। জুন ২০২১ মাসে সমাপ্ত অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর ২০২০ শেষে বাংলাদেশের আইএমএফ-এসডিআর স্থিতির পরিমাণ ছিল ১.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চিত্র ১ বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স (মিলিয়ন মার্কিন ডলার)

তথ্যসূত্র ইকনমিক ট্রেন্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি, এপ্রিল-জুন ২০২১

দেশের আমদানি বাণিজ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তৎসঙ্গে লেনদেন ভারসাম্যের সেবাখাতের ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস ও এর উন্নয়ন অব্যাহত থাকে যা ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত এবং ২০১৭-২০২১ অর্থবছরগুলিতে ঘাটতি প্রদর্শন করলেও বাংলাদেশের বহিঃখাত একটা সুস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে ধরা যায়।


সারণি বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য অর্থবছর ২০১১-২০২০ (মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে)।

বিষয়সমূহ ২০১১ ২০১২ ২০১৩ ২০১৪ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০
রপ্তানি (এফওবি) ২২,৫৯২ ২৩,৯৮৯ ২৬,৫৬৭ ২৯,৭৭৭ ৩০,৬৯৭ ৩৩,৪৪১ ৩৪,০১৯ ৩৬,২৮৫ ৩৯,৬০৪ ৩২,৮৩২
আমদানি (এফওবি) ৩২,৫২৭ ৩৩,৩০৯ ৩৩,৫৭৬ ৩৬,৫৭১ ৩৭,৬৬২ ৩৯,৯০১ ৪৩,৪৯১ ৫৪,৪৬৩ ৫৫,৪৩৯ ৫০,৬৯০
বাণিজ্য ভারসাম্য -৯,৯৩৫ -৯,৩২০ -৭,০০৯ -৬,৭৯৪ -৬,৯৬৫ -৬,৪৬০ -৯,৪৭২ -১৮,১৭৮ -১৫,৮৩৫ -১৭,৮৫৯
সেবা (নীট) -২,৬১২ -৩,০০১ -৩,১৬২ -৪,০৯৬ -৩,১৮৬ -২,৭০৮ -৩,২৮৮ -৪,২০১ -৩,১৭৭ -২,৫৪১
প্রাথমিক আয় (নীট) -১,৪৫৪ -১,৫৪৯ -২,৩৬৯ -২,৬৩৫ -২,২৫২ -১,৯১৫ -১,৮৭০ -২,৬৪১ -২,৯৯৩ -৩,১০৬
সেকেন্ডারি আয় ১২,৩১৫ ১৩,৪২৩ ১৪,৯২৮ ১৪,৯৩৪ ১৫,৮৯৫ ১৫,৩৪৫ ১৩,২৯৯ ১৫,৪৫৩ ১৬,৯০৩ ১৮,৭৮০
প্রবাসী রেমিট্যান্স স্থানান্তর ১১,৫১৩ ১২,৭৩৪ ১৪,৩৩৮ ১৪১,১৬ ১৫,১৭০ ১৪,৭১৭ ১২,৭৬৯ ১৪,৭০৩ ১৬,১৯৬ ১৮,০১৪
চলতি হিসাব ভারসাম্য -১,৬৮৬ -৪৪৭ ২,৩৮৮ ১,৪০৯ ৩,৪৯২ ৪,২৬২ -১,৩৩১ -৯,৫৬৭ -৫,১০২ -৪,৭২৩
মূলধন হিসাব ৬৪২ ৪৮২ ৬২৯ ৫৯৮ ৪৯৬ ৪৬৪ ৪০০ ৩৩১ ২৩৯ ২৫৬
আর্থিক হিসাব ৬৫১ ১,৪৩৬ ২,৮৬৩ ২,৮১৩ ১,২৬৭ ৯৪৪ ৪,২৪৭ ৯,০১১ ৫,৯০৭.২ ৭,৫৩৭
(১) এফডিআই ৭৭৫ ১,১৯১ ১,৭২৬ ১,৪৩২ ২,৫২৫ ২,৫০২ ৩,০৩৮ ৩,২৯০ ৪,৯৪৬ ৩,২৩৪
(২) পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ১০৯ ২৪০ ৩৬৮ ৯৩৭ ৩৭৯ ১৩৯ ৪৫৭ ৩৪৯ ১৭২ ৪৪
(৩) অন্যান্য বিনিয়োগ (নীট) -২৩৩ ৭৬৯ ৪৪৪ -২৮৪ -৪৮০ ২,১৩৭ ৬,৮৮৪ ৩,১০৮ ৬,২২২
ভুল-বিচ্যুতি -১,৩৭৬ -৯৭৭ -৭৫২ ৬৬৩ -৮৮২ -৬৩৪ -১৪৭ -৬৩২ -৮৬৫.২ -১৪৫
সার্বিক ভারসাম্য -৬৫৬ ৪৯৪ ৫১২৮ ৫,৪৮৩ ৪,৩৭৩ ৫,০৩৬ ৩,১৬৯ -৮৫৭ ১৭৯ ২,৯২৫

তথ্যসূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক।

নিম্নগামী আমদানি প্রবৃদ্ধির সাথে ঊর্ধ্বগামী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আর প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমূখী প্রবাহের কারণে ২০০০ সালের পর থেকে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে থাকে এবং ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে যা দু’একটি বছর ছাড়া ২০১৬ অর্থবচর পর্যন্ত বজায় থাকে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারেও একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। ২০১৭ অর্থবছর থেকে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর চলতি হিসাবে আবার ঘাটতি দেখা দেয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সন্তোষজনক (৯ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতা) অবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোষাক শিল্পের প্রতিযোগিতায় নিজ অবস্থান (দ্বিতীয়) ধরে রাখা, রেমিট্যান্স ও এফডিআই প্রবাহ এবং সন্তোষজনক অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ (২০১৭ অর্থবছরের পর থেকে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি) অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বহিঃখাতের অনুকূল অবস্থা সহসায় ফিরে আসবে আশা করা যায়। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]