রিকশা

রিকশা  বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান পরিবহণ। দেশজুড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে রিকশা গ্রামাঞ্চলেও ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে। বিশ শতকের প্রারম্ভে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রিকশার প্রথম প্রচলন হয় জাপানে। সেখানে রিকশা বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেট্রোলের দুষ্প্রাপ্যতা ও যান্ত্রিক পরিবহণ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠার পরিস্থিতিতে। জাপানি ভাষায় ‘নিনতাকু’ নামে পরিচিত রিকশার উৎপত্তি জাপানে হলেও বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্যে জাপান থেকে সাইকেল রিকশা উঠে যায়।

বিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে রিকশা ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে জনপ্রিয় হয়। ১৯১৯ সালের দিকে রিকশা মায়ানমার থেকে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছে বলে কথিত আছে। তবে রিকশা ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে চট্টগ্রাম থেকে আসে নি। ঢাকায় রিকশা আসে কলকাতা থেকে। এটি কলকাতায় প্রথম প্রচলিত হয় বিশ শতকের ত্রিশের দশকের দিকে। নারায়ণগঞ্জ এবং নেত্রকোনা (ময়মনসিংহ) শহরে বসবাসরত ইউরোপীয় পাট রপ্তানিকারকগণ তাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য, ১৯৩৮ সালে প্রথম কলকাতা থেকে রিকশা আমদানি করে।

রিকশা

এই যান ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল জাগায়, সেসময় ঢাকার লোকেরা ঐতিহ্যগত ঘোড়ার গাড়ি, পালকি এবং শহরের খালে নৌকা ব্যবহার করত। তবে শুরুর দিকে সাইকেল রিকশা গ্রহণযোগ্য বাহন হিসেবে তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।

পৌরসভার রেকর্ড মতে ১৯৪১ এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ এবং ১৮১। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র চার লক্ষ। কিন্তু ১৯৯৮ সালে, শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ লক্ষে গিয়ে দাঁড়ায় এবং নিবন্ধভুক্ত রিকশার সংখ্যা দাঁড়ায় ১,১২,৫৭২-এ। সে বছর বাংলাদেশের অন্যান্য সব জেলায় রিকশার সংখ্যা ২,৭৪,২৬৫ এবং দেশের গ্রামাঞ্চলে এর মোট সংখ্যা ছিল ৯১,০৪০। রিকশা এবং রিকশা ভ্যান এখন দ্রুত ঘোড়ার গাড়ি এবং গরুর গাড়ির মতো সনাতন যানের স্থান দখল করে নিচ্ছে।

সাধারণ্যে এই ধারণা বিদ্যমান যে, নগরীতে মোট রিকশার প্রকৃত সংখ্যা নিবন্ধভুক্ত রিকশার অন্তত আড়াই গুণ এবং তদনুসারে, ২০০০ সালে নগরীতে রিকশার সংখ্যা ছিল অন্তত ২,৫০,০০০। বর্তমানে (২০১০) ঢাকা শহরে রেজিস্টার্ড রিকশার সংখ্যা ১১২,৫৭২। অঙ্কের হিসেবে সকাল ও বিকালের শিফটে প্রত্যেকটি রিকশা যদি দুইজন চালক চালায় এবং রিকশাচালকের পরিবারের সদস্যসংখ্যা যদি গড়ে চার জন হয় তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে, শুধু রিকশাই ঢাকা নগরীর অন্তত কয়েক লক্ষ লোকের আয়ের উৎস। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে এককভাবে বাংলাদেশেই রিকশা স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আধুনিক অন্যান্য যানবাহন মাধ্যমের সঙ্গে রিকশা নিজেকে অপ্রতিহতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যানবাহন হিসেবে রিকশার আধিপত্য বোঝাতে এরূপ তথ্য দেওয়া যায়: ঢাকা, সিলেট, কুমিল­া এবং রংপুর শহরে মোট যানবাহনের মধ্যে রিকশার সংখ্যার শতকরা হার যথাক্রমে ৪৯%, ৭৮%, ৮০% এবং ৫৫%। যানবাহনের বিন্যাস অনুসারে ঢাকায় অন্য যানবাহন মাধ্যমগুলি হলো: ক. মোটরগাড়ি, জিপ, পিকআপ প্রভৃতি, খ. বেবিট্যাক্সি, গ. বাস, ঘ. ট্রাক, ঙ. টেম্পো এবং চ. সাইকেল। ঢাকার বাইরের শহরগুলিতে প্রধান যানের তালিকায় সাইকেলের স্থান দ্বিতীয়।

পরিবহণ খাতের শতকরা ৫০ ভাগ মূল্য-সংযোজন রিকশার অবদান। এই পরিবহণ মাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে কেবল চালক হিসেবে নিয়োজিতদের কর্ম ও জীবিকার সংস্থান করে না, বরং এর মূলকাঠামো, আসন ও হুডসহ বডি এবং এর অন্যবিধ খুচরা যন্ত্রাংশের নির্মাতাদেরও কর্মসংস্থান যোগায়। রিকশার বডি সজ্জিতকরণ, রিকশায় চিত্রকর এবং রিকশা গ্যারেজের ওপর নির্ভর করে বহু লোক জীবিকা নির্বাহ করে।

রিকশা চিত্র  রিকশার যাবতীয় শিল্পকর্ম যা চিত্রিত পশ্চাদ্ফলক ও পশ্চাতের পার্শ্বফলক থেকে খাঁজকাটা কারুকার্যখচিত হুড এবং প্লাস্টিক ও কাগজশোভিত পিতলের ফুলদানি পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। রিকশা চিত্র সচরাচর দেখা যায় রিকশার পেছনে রিকশার বডি ঢেকে রাখা টিনের আচ্ছাদনের উপরে। অটোরিকশা বা বেবিট্যাক্সির পেছনেও রিকশা চিত্রের অনুরূপ শিল্পকর্ম দেখা যায়। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের পরিবহণ আর্ট, যেমন পাকিস্তানের অলঙ্কৃত ট্রাকের সঙ্গে রিকশা আর্টের তুলনা করা যায়।

রিকশা চিত্র

রিকশা আর্ট সম্ভবত শুরু হয় বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। বিষয়বস্ত্ত ও কারিগরি বিবেচনায় সিনেমার বিজ্ঞাপন ফলকের সঙ্গে রিকশা আর্টের কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে যে, কিছুসংখ্যক রিকশা-চিত্রকর নিজেরা হয় চলচ্চিত্র অঙ্কনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, নয় এ ধরনের শিল্পীদের কাছে শিক্ষানবিশি করেছেন। রিকশা চিত্রকরের বিদ্যা একটি পরম্পরায় ওস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষানবিশের নিকট সঞ্চারিত হয়। কোন বিষয়ের জনপ্রিয়তার কারণে বা শিক্ষক-কারিগরের প্রভাবে রিকশা আর্টের প্রচুর পুনরাবৃত্তি ঘটে। মেশানো যায় না এমন রেডিমেড এনামেল রঙের সাহায্যে চিত্রকর্মের কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়। উজ্জ্বল মৌলিক রঙের ব্যবহারই বেশি হয় এবং ছবিগুলিতে তেমন বৈচিত্র্য থাকে না। এগুলি অাঁকার সময় চিত্রকলার অঙ্কনবৈশিষ্ট্য, তথা শেড, যথানুপাত, ক্রমবিন্যাস ইত্যাদি টেকনিক অনুসরণ করা হয় না।

লোকপ্রিয় বিষয়গুলির মধ্যে আছে তাজমহল, চলচ্চিত্রের দৃশ্য এবং চিত্রতারকার ছবি, সুপুষ্ট মোরগ, নির্বিকার গাভী, নারকেল গাছ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কুটির, ক্ষীণতোয়া নদীসম্বলিত গ্রামবাংলার সরল, শান্ত দৃশ্য। ইসলাম ধর্মসম্পর্কিত দৃশ্য, যেমন মসজিদ এবং পঙ্খিরাজ ঘোড়া বোরাকের ছবিও প্রায়শ দেখা যায়। যেহেতু প্রতিবছরই রিকশার পেছনে ছবি অাঁকতে হয়, শিল্পীরা প্রায়ই সমসাময়িক বিষয় অঙ্কন করেন। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যকার যুদ্ধদৃশ্য ছিল প্রচলিত চিত্রপট। অটোরিকশার গায়ে ক্রমবর্ধমান হারে দেখা যেতে থাকে নতুন যুগের নগরী, উড়োজাহাজ এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন অন্যান্য যানবাহনের দৃশ্য।

রিকশা চিত্রকরগণ সাধারণত তাদের ছবিতে স্বাক্ষর করেন না। তবে ছবির নিচে বা এক পাশে মাঝে মাঝে রিকশার গ্যারেজ মালিক অথবা রিকশা প্রস্ততকারক বা মিস্ত্রির নাম দেখা যায়। কখনও কখনও শিল্পিগণ ছদ্মনামে চিত্র অঙ্কন করেন। মাঝে-মধ্যে কতিপয় শিল্পী একই নাম ব্যবহার করেন, অনেক সময় একজন শিক্ষানবিশ তার অাঁকা চিত্রে ওস্তাদের নাম লিখে দেয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বেশকিছু রিকশা শিল্প সংরক্ষণ করা আছে। যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হলে ক্রমশ এ শিল্পে অধিকসংখ্যক শিল্পী আকৃষ্ট হবেন।  [নিয়াজ জামান]