রাসসুন্দরী, শ্রীমতী

রাসসুন্দরী, শ্রীমতী (১৮১০-১৮৯৯)  লেখিকা। পাবনা জেলার একটি দরিদ্র পরিবারে ১৮১০ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। রাসসুন্দরী স্বশিক্ষিত ছিলেন এবং বাঙালি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় আত্মজীবনী লেখেন। তাঁর পক্ষে উনিশ শতকে এ দুই-ই ছিল অত্যন্ত গৌরবের। কারণ সেকালে নারীরা ছিল পর্দার আড়ালে অজ্ঞাত। মেয়েদের জন্য লেখাপড়া ছিল একরকম নিষিদ্ধ। এমন বৈরী পরিবেশেও রাসসুন্দরী যে মানসিক দৃঢ়তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, সেটাই তাঁকে কীর্তমান করে তোলে।

শ্রীমতী রাসসুন্দরী

সেকালের লোকের বিশ্বাস ছিল যে, লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা তাঁদের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়দের প্রতি অবাধ্য হবে, নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলবে, এমনকি, তার ফলে বিধবা হবে। এ কারণে অন্য মেয়েদের মতো তাঁকেও কোনো লেখাপড়া শেখানো হয়নি, যদিও তাঁর পিতার বাড়িতে এক মিশনারির একটি পাঠশালা ছিল। তিনি অবশ্য এ পাঠশালায় ছেলেদের লেখাপড়া শিখতে দেখেছিলেন এবং সবার অজ্ঞাতে নীরবে পড়তে শিখে ফেলেন।

বারো বছর বয়সে ফরিদপুরের রামদিয়া গ্রামের এক ছোট জমিদার সীতানাথ সরকারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এ বাড়িতে তাঁর তিন বিধবা ননদও থাকতেন। তবে তাঁর শাশুড়ী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য তাঁকে খুব স্নেহ করতেন।

অনেক চেষ্টায় তিনি পঁচিশ বছর বয়সে পড়তে শেখেন। আরও পঁচিশ বছর পরে তাঁর এক পুত্রের তাগিদে তিনি লিখতে শেখেন। এর নয় বছর পরে ১৮৬৯ সালের গোড়ার দিকে তাঁর স্বামী মারা গেলে তিনি হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এ সময় সংসারের কাজকর্মও তাঁকে বিশেষ করতে হতো না। এ সুযোগে তিনি তাঁর জীবনের কথা লিখতে আরম্ভ করেন এবং কয়েক বছর পর ১৮৭৬ সালে তাঁর আত্মজীবনী—আমার জীবন প্রকাশ করেন।

সহজ এবং সরল ভাষায় লেখা এ আত্মজীবনীতে রাসসুন্দরী তাঁর নিজের জীবন এবং ভাবনারই বর্ণনা দিয়েছেন, তাঁর স্বামী ও সন্তানদের কথা সামান্যই লিখেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর রচনায় তাদের প্রসঙ্গ যতটুকু পাওয়া যায়, তা থেকে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সম্পর্ক লক্ষিত হয়, তা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাঁর পরিবারে পর্দাপ্রথা খুব কঠোর ছিল এবং তিনি কোনোদিন দিনের বেলায় তাঁর স্বামীকে দেখেননি। ফলে কথা বলার সুযোগও তেমন ঘটেনি। স্বামীর প্রতি তাঁর সীমাহীন লজ্জা কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি লিখেছেন যে, তাঁদের কয়েকজন কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও পরিবারের লোকেরা আশা করতেন, তিনিই নিজ হাতে খুব ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঘরের সব কাজ—রান্নাবান্না, পরিবেশনা সবই তিনি করবেন এবং অন্য সবাইকে খাওয়ানোর পর তিনি খাবেন।

স্বামী সম্পর্কে রাসসুন্দরীর মন্তব্য- তাঁর স্বামী খুব দয়ালু ছিলেন। আবার সমাজের দিকে বিশেষ নজর না দিলেও তিনি নিজের অজ্ঞাতেই তাঁর নিজের জীবন এবং নারীদের পরিবর্তনশীল ভূমিকার বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে সমাজ প্রতিফলিত না-হয়ে পারেনি। পুরো আত্মজীবনীতে তিনি দেবতার প্রতি তাঁর অসীম ভক্তিভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি আত্মীজীবনীর কোথাও কোথাও কবিতাও লিখেছেন। তাঁর অপর একটি বিশিষ্ট গুণ ছিল, তিনি চমৎকার মাটির পুতুল তৈরি করতে জানতেন।

তাঁর আত্মীজীবনীর দ্বিতীয় ভাগসহ দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পরের বছর, ১৮৯৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।  [গোলাম মুরশিদ]