রাষ্ট্রগঠন

রাষ্ট্রগঠন ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষের বুদ্ধিমত্তার উৎকর্ষের প্রকৃষ্টতম রূপ হচ্ছে রাষ্ট্র, আর বস্ত্তত তা হলো রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের রূপায়ন। রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতি সবসময় সমন্বিত এবং সৃজনশীল উপকরণ হিসেবে কাজ করেছে। একটি রাষ্ট্রহীন সমাজে এর বিপরীত চিত্রটি দেখা যায়। সেখানে বিজেতা শক্তির উদ্দেশ্য পূরণের প্রয়োজনে বিজিত অঞ্চলের সংস্কৃতিতে অবক্ষয় দেখা দেয়, কখনো বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলি পুনর্গঠিত ও পুনবিশ্লেষিত হয়।

জনপদ, রাষ্ট্রের আদিরূপ অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসকার স্বীকার করেন যে, ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বাংলা ব-দ্বীপ অঞ্চল আর্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার পূর্বেই এ অঞ্চলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মহাভারতে বর্ণিত পৌরাণিক সূত্রে দেখা যায় যে, ভীম পুন্ড্র, বঙ্গ, তাম্রলিপ্তি ও কলিঙ্গসহ বেশ কয়েকটি পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য জয় করেন এবং করায়ত্ব এসব করদ রাজ্যের রাজারা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রগঠনপূর্ব জনপদ বা বসতিপুঞ্জ গড়ে উঠেছিল উৎপাদন এবং বিনিময় প্রথার উপর ভিত্তি করে, আর জনপদগুলোর স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা তখন যেমন প্রয়োজন ছিল না, তেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলাও সম্ভব ছিল না। প্রাচীন গ্রীস ও রোমের ন্যায় সর্বপ্রাচীন জনপদরাষ্ট্রগুলো ছিল কার্যত রাষ্ট্র, কারণ সেখানে উৎপাদনব্যবস্থা ও বিনিময় পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল এবং এর নাগরিকরা আয়ত্ত করেছিল একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার কৌশল। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের অনুরূপ রাষ্ট্রব্যবস্থার আদলে গড়ে উঠেছিল বাংলার জনপদ রাষ্ট্র, যেমন বঙ্গ, পুন্ড্র, তাম্রলিপ্তি এবং আরও অনেক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্রের সংখ্যা গ্রিস ও রোমের প্রাচীন রাষ্ট্রের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে জানা যায় যে, সমসাময়িক বিশ্বের নৌবাণিজ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলার রাষ্ট্রগুলোও তাদের কৃষিজাত ও অন্যান্য পণ্য বোঝাই নৌকা নিয়ে বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করত। স্থানীয় ও বহিঃবাণিজ্যে অংশ গ্রহণের সুবিধার জন্য তারা বিনিময় মাধ্যমেরও উন্নয়ন ঘটিয়েছিল। বিশ শতকের ষাটের দশকে বীরভূম জেলার ‘পান্ডু রাজার ঢিবি’ এবং কোপাই ও কুর নদীর অববাহিকায় বেশ কয়েকটি স্থান ও ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে বিস্ময়কর কিছু ফলাফল বেরিয়ে আসে। উৎখননে খ্রিস্টপূর্ব দুই সহস্রাব্দের দিকে বাংলার এ সকল অংশে অতি উচ্চমানের সভ্যতার সন্ধান মিলেছে। পান্ডু রাজার ঢিবি নৌবাণিজ্য নির্ভর নগর সভ্যতার সাক্ষ্য দেয়। এই প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা যায় যে, এসব অঞ্চলের জনগণ শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরেই নয়, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নৌপথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল।

প্রাচীন জনপদের মানুষ জাতিতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকগণ দাবি করেন যে, বাংলার বদ্বীপাঞ্চলীয় জনপদের জনগোষ্ঠী বহিরাগত ছিল। বিশেষ করে দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, তিববতীয় চীনা, অস্ট্রোলয়েড এবং উত্তর ভারতের বিভিন্ন গোত্রের শংকর জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে এসে মিলিত হয়। ধারণা করা যায় যে, এ জনগোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব সংস্কৃতি সঙ্গে করে নিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত অন্যান্য অভিবাসীদের সংস্কৃতির সঙ্গে তা একীভূত হয়ে যায়। অবশ্য একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্র গঠনে সংস্কৃতির এ সমন্বয়ের রীতি ও পর্যায় সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না।

রাষ্ট্র গঠনে আর্যদের প্রভাব ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের দিকে বাংলার বদ্বীপাঞ্চলীয় জনপদের সঙ্গে আর্যজাতির যোগাযোগ স্থাপিত হয়। দখলদার আর্যগণ বাংলা জনপদের অধিবাসীদের অসভ্য জাতি হিসেবে গণ্য করত এবং তাদের নিজ জনগোষ্ঠীকে এতদঞ্চলের ব্রত্য, কিরাত এবং দস্যুদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিত। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে স্থানীয়রা ছিল অশুচি এবং অবজ্ঞার পাত্র। এ অবজ্ঞার নীতি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই আর্যদের স্থানীয় জনপদের অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়েছে। বিজয় ও রাজ্য গঠনের ফলে এ অঞ্চলে আর্যদের ব্যাপক গণসংযোগ ও  সাংস্কৃতিক লেনদেন ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং এর উপর ভিত্তি করে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া সহজ হয়ে উঠে।

প্রত্যেক জনপদ-রাষ্ট্রেরই এর নিজস্ব পৃথক নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা, সংঘবদ্ধভাবে বসবাসের নিজস্ব পদ্ধতি, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎপাদন ও বিনিময়ের নিজস্ব পদ্ধতি এবং একই সঙ্গে আন্তঃজনপদ সম্পর্ক বজায় থাকে। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবের কারণে জনপদের জনগণ বা সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ কত গভীর ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ধারণা করা হয় যে, আর্যদের সাংস্কৃতিক সৌকর্যের কারণে তাদের রাষ্ট্র পদ্ধতির প্রতি প্রতিটি জনগোষ্ঠী সাড়া দিয়েছিল। তাদের কেউবা সে ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে, কেউ বর্জন করেছে, কেউবা প্রতিরোধ করেছে।

নিম্ন গাঙ্গীয় উপত্যকায় আর্যদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক যেমন নিষ্প্রভ হয়ে এসেছিল তেমনি বঙ্গীয় বদ্বীপাঞ্চলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকেও ম্লান করে দিয়েছিল। উত্তর ভারতের আর্য পরবর্তী দু’টি দেশজ ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন মূলত আর্য এবং ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তার মিশ্রিত রূপ। আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকেই বাংলায় জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। অর্থাৎ এ প্রধান ধর্ম দু’টি ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রভাব থেকে রক্ষার প্রাচীর হিসেবে কাজ করেছিলো এবং ধারণা করে নেয়া হয় যে, বদ্বীপাঞ্চলীয় জনপদসমূহ তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিল।

জাতীয় ভাষার উদ্ভব যেকোন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রাণশক্তি হচ্ছে এর ভাষা। বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা কি ছিল সে সম্পর্কে নিছক ধারণাই করা যায়। বদ্বীপাঞ্চলে যত জাতি ও তাদের ভাষা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থান পরিবর্তন করেছে, তত জাতির মধ্যেই একে অপরের ভাষায়ও মিশ্রণ ঘটেছে। ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলা বদ্বীপের প্রধান ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল মূলত অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, সীনো-তিববতীয় বা তিববতীয় চীনা এবং সর্বশেষ ইন্দো-ইউরোপীয় (আর্য) ভাষা থেকে। এ অঞ্চলে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রাহ্মণ্য ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ভাষার প্রবর্তন। ধর্ম, আইনের ধারা, বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড, লিপি এবং সর্বোপরি সাহিত্য-কর্মের প্রধান মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত একটি সাধারণ ভাষায় পরিণত হয়। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ এবং জৈনদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা ছাড়াও গুপ্ত, পাল এবং সেনদের প্রশাসনেও সংস্কৃত ভাষা প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। কালের বিবর্তনে সংস্কৃত ভাষা দু’টি নতুন আঞ্চলিক ভাষার জন্ম দেয়, প্রাকৃত ও পালি। উভয় ভাষাই আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণের ফলে সৃষ্ট। প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব। মৌর্য যুগে প্রাকৃত ও পালি ভাষার মিশ্রিত রীতি প্রচলিত ছিল। মহাস্থানগড় লিপিটি ব্রাহ্মি লিপিতে প্রাকৃত ভাষায় উৎকীর্ণ হয়েছিল। নোয়াখালী জেলার সিলুয়াতে ব্রালিপিতে প্রাকৃত ভাষায় লিখিত খ্রিস্টপূর্ব দুই শতকের আরেকটি লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার প্রাধান্য এবং সংস্কৃত সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের ফলে প্রাকৃত ভাষা ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু প্রাকৃত থেকে সৃষ্ট বাংলা ভাষা সুলতানি শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে।

বৈদিক সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রনীতি রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রকে একীভূত করলেও, সামাজিক রীতি ও শৃঙ্খলা অটুট রাখার স্বার্থে সামাজিকভাবে তাকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল। নবগঠিত রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত বর্ণপ্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলিত-সমাজের কতগুলো বিধিনিষেধ। কারণ, যারাই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাদেরই চতঃুবর্ণ মেনে নিতে হয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণগণ ছিল সমাজে নেতৃস্থানীয়। ক্ষত্রিয় ছিল যোদ্ধা, বৈশ্য ছিল ব্যবসায়ী ও শূদ্রগণ ছিল সাধারণ শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ।

অবশ্য বাংলায় এ আর্যকরণ প্রক্রিয়া যথেষ্ট উদার ছিল। উত্তর ভারতের মতো ততটা কঠোর ছিল না। এখানে সবশ্রেণীর আঞ্চলিক গোষ্ঠীর মধ্যে আর্যকরণ প্রক্রিয়া ও বর্ণপ্রথার প্রচলন ছিল বাস্তবতা বহির্ভূত। ফলে আর্যাবর্তে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে ধর্মীয় রীতি অনুসরণে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত ছিল, তাদের উপরই চতঃুবর্ণ প্রথা শিথিলভাবে আরোপ করা হয়। এভাবে বাংলার সমাজে ব্রাহ্মণ্য শ্রেণির বাইরেও অন্যান্য অনেক শ্রেণির উদ্ভব হয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, এভাবে দ্রুত নতুন শ্রেণির উদ্ভবে পৃথক গোত্রসমূহের শিল্প, সংস্কৃতি, পেশা এমনকি বর্ণের বাইরে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনও সম্ভব হচ্ছিল। এ প্রক্রিয়ায় সামাজিক ব্যবস্থাপনার অধীনে বাংলার রাষ্ট্রব্যবস্থা চমৎকার এক সমন্বিত ঐতিহ্যের রূপ পরিগ্রহ করে।

সুলতানি রাষ্ট্র (১২০৫-১৫৭৬)  সেনযুগ থেকে সুলতানি যুগে প্রবেশের সন্ধিক্ষণে বাংলায় একাধিক স্বায়ত্ত্বশাসিত আঞ্চলিক প্রধানদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। তারা ছিলেন, রাজা, রানা, রায়, ভৌমিক, ভূঁইয়া প্রমুখ। সুলতানগণ তাদের একটি একক ভূমি ব্যবস্থার অধীনে সমন্বিত করেন। এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা রাজনৈতিক একচ্ছত্র ক্ষমতা হারালেও তাদের সামাজিক ক্ষমতা অটুট ছিল এবং রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের এ ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহার হয়েছিল। স্থানীয় এ প্রধানগণ নবগঠিত রাষ্ট্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হন এবং আঞ্চলিক ও অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানদের উপর রাষ্ট্রের কিছু দায়িত্বও অর্পিত হয়। স্থানীয় সরকারের পূর্ববর্তী ব্যবস্থাও প্রায় অপরিবর্তিত থেকে যায়। ফলে সুলতানি যুগে বাংলার শাসন ব্যবস্থার উচ্চস্তরে নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের শাসন এবং নিম্নস্তরে পূর্ববর্তী স্থানীয় শাসনের মিশ্র ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে। সে কারণেই পন্ডিতগণ সুলতানি শাসনামলকে নির্ভেজাল তুর্ক-আফগান রাষ্ট্রের চেয়ে বরং ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেন।

গ্রামীণ সমাজে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ সুলতানি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক আঞ্চলিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী পৃথক পৃথকভাবে অথবা মোটামুটি একতাবদ্ধ হয়ে বাস করত। সুলতানি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে এদের অনেকেই তাদের মূল আবাসভূমি ত্যাগ করে নিজেদের জাতিসত্ত্বাকে সুরক্ষিত রাখতে পাহাড়ী অঞ্চলে গিয়ে বসবাস শুরু করে। এভাবে একটি গ্রামীণ গোষ্ঠীর আন্তঃযোগাযোগের মাধ্যমে মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতি, সাধারণ পৌরাণিক কাহিনী ও সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। তাছাড়াও এটা প্রমাণিত যে, শিল্প ও সংস্কৃতি ছিল সুলতানি রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচাইতে বড় অর্জন। এ ধারার সর্বপ্রাচীন নির্দশন হলো ‘মঙ্গলকাব্য’ সাহিত্য। মনসা, চন্ডী ও অন্যান্য দেবীর আরাধনার গীতকে কেন্দ্র করেই মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্ত্ত আবর্তিত হয়েছে। দেবী কিন্তু আর্যদের ছিল না, বরং তা ছিল স্থানীয়। পূর্ববর্তী কৌমসমূহ থেকে গ্রাম গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, নারীর বন্দনার প্রথা তখনো প্রচলিত ছিল। নৃতাত্ত্বিকগণ বিশ্বাস করেন যে, প্রাচীন স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক এবং যাযাবর বা ক্রমবর্ধমান অভিবাসীদের সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক। প্রাচীন জনপদসমূহের কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামসমূহেই মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব। সুলতানি যুগের শাসকগণ মঙ্গলকাব্যের স্রষ্টাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন বলেই তা পরবর্তীকালে বাংলার জাতীয় সাহিত্যের রূপ নেয় এবং এক পর্যায়ে তা বাঙালি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচিতির রূপ পরিগ্রহ করে।

ভাষা ও রাষ্ট্র বাংলার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উত্তর ভারতীয় প্রশাসনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে বাংলাকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি স্বনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করাই ছিল ইন্দো-মুসলিম সভ্যতার সবচাইতে বড় অবদান। তারা বাংলাকে ব্যাপকহারে আঞ্চলিক জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত সুনির্ধারিত ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে স্বনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের রূপ দিতে সমর্থ হন। সুলতানি শাসকদের অপর একটি বড় অবদান ছিল যে, তারা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সংস্কৃত ভাষার ঐতিহ্য থেকে মুক্ত করে সংস্কৃত ভাষা ভারাক্রান্ত সদ্য প্রস্ফুটিত বাংলা ভাষাকে যথাযথভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। এটা কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ ছিলো না বরং বাংলার স্থানীয় জনগণ শক্তিশালী বিদেশী ভাষার চাপে নিজ ভাষার বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল বলেই সুলতানি শাসকগণ সেই বাধাটি দূর করে দিতে সাহায্য করেছিলেন। স্থানীয়ভাবে বিকশিত ভাষার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টিতে তারা স্বাধীন সুলতানি রাজ্যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাধান্য বিলোপ করতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক স্বার্থেও এ কৌশল কার্যকর হয়েছিল। প্রতিবেশি ব্রাহ্মণ্যবাদী অঞ্চলসমূহের অবিরাম হিংসাত্মক বৈরিতার বিপরীতে স্থানীয়দের সমর্থন আদায়ে বাংলাভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি পৌঁছানোও সহজ ছিল। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ও ভাষার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলার পন্ডিতগণ মাতৃভাষার মাধ্যমে নিজেদের চিন্তা ও ধারণার বিকাশের অবাধ সুযোগ লাভ করেন। সংস্কৃত যেমন পূর্ববর্তী গুপ্ত ও সেনযুগে একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তেমনি সুলতানি যুগেও বাংলা ভাষা তার একচ্ছত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।  ব্রাহ্মণ্য রাষ্ট্রে যেভাবে সংস্কৃত চর্চার ক্ষেত্র রচিত হয়েছিল, তেমনি সুলতানি যুগে মুসলিম লেখকগণ শুধুমাত্র আরবি ও ফার্সি শব্দের ব্যবহার করেই নয় বরং বাংলা সাহিত্যে আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চায় কৃতকার্য হন। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থেই বিজেতাগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে আরোপ করে থাকেন। সুলতানি যুগেও সংস্কৃতের পরিবর্তে ফার্সি দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে তার স্থান দখল করে নেয়। বিজেতাগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মানদন্ড বজায় রাখার জন্য বাংলাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করা হয়েছিল বলে মনে করা হলেও বাংলা ভাষার মধ্যে ফার্সির অনুপ্রবেশ ছিল বাংলা শব্দভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য এক নতুন দিগনির্দেশনা। বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশে এবং সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে গড়ে উঠতে বিদেশি ভাষার অবদান অনস্বীকার্য। হিন্দু ও মুসলিম সাহিত্য রচয়িতাগণ আরবি ও ফার্সি থেকে শব্দ চয়ন করে বাংলা ভাষায় তার প্রয়োগের কৌশল আয়ত্ত করতে সক্ষম হন।

উল্লেখ্য যে, সুলতানি রাষ্ট্রগঠন এবং ইসলামী সংস্কৃতি আত্মীকরণ প্রক্রিয়ায় শাসকগোষ্ঠী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব কখনোই প্রকট ছিল না। বাংলার বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিজেতাদের নতুন ধারাকে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। সুলতানদের রাজনৈতিক কৌশল এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতাই এর কারণ। সুলতানগণ স্থানীয় অভিজাতদের নতুন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে শুধু একাত্মই করেন নি, পূর্ববর্তী ব্রাহ্মণ্য অভিজাতদেরও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিত করেছেন।

নওয়াবী রাষ্ট্রের উত্থান  তিন’শ বছরেরও অধিককাল তুর্ক-আফগান সুলতানগণ বাংলা শাসন করেছেন। কিন্তু মুগল শাসকগণ সুলতানি শাসনামলের অর্ধেকেরও সময় বাংলা শাসন করেছেন (বার ভূঁইয়াদের পতন থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত সময় ধরলে)। কিন্তু দেখা যায় যে, বাংলা রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ায় সুলতানি শাসকদের তুলনায় মুগল শাসকদের প্রভাব অধিক ছিল। কারণ বাংলা রাষ্ট্রে রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, প্রশাসন, শিক্ষা, যোগাযোগ, ভাষা ও সাহিত্য, শিল্পকলা ও স্থাপত্য, নৃত্য ও সঙ্গীত, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে মুগল প্রভাব সুস্পষ্ট। এ সবই আত্মপরিচয়ে গর্বিত ও দৃঢ় জাতিভিত্তিক বাংলা সুবা বা বাংলা রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। উল্লেখযোগ্য যে, মুগল প্রশাসনের অধীনে বাংলা ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার সুদূরপ্রসারী পরিণাম ডেকে আনে। ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খানের সময়ে সুবা বাংলার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে পর্তুগাল, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে নৌবাণিজ্যের সূত্র ধরে যোগাযোগ সূচিত হয়। তাছাড়া প্রাচ্য সভ্যতার উপর পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের উদ্দেশ্যে বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্ব আরোপে খ্রিস্টান মিশনারিগণ আরো আগেই বাংলায় প্রবেশ করেনি। পশ্চিমের সঙ্গে এহেন যোগাযোগ বাংলায় বহুবিধ অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধিত হয়। রফতানি পণ্য ও কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বেড়ে আমদানিকৃত সোনা ও রূপার বাজারে স্থিতি আসে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হয়। বন্দরগুলিতে পশ্চিমাদের কুঠি স্থাপনের ফলে স্থানীয় ফরিয়া শ্রেণির উত্থান ঘটে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে বন্দরসমূহ ঘিরে বাণিজ্যিক নগর ও শহরের পত্তন ঘটে। এ সবই রাষ্ট্রের গঠনে কার্যকর নতুন উপাদান হিসেবে যোগ হয়েছিল।

পশ্চিমাদের সঙ্গে নৌ-বাণিজ্যিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটে, তা মুগল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন করেছিল বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলা প্রদেশে পণ্য রফতানির প্রক্রিয়ায় প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কোষাগারে অর্থের যোগান এতোই বেড়ে যায় যে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার উৎসাহ পান। এই প্রক্রিয়ায়ই নবাব মুর্শিদকুলী খান কেন্দ্রীয় সরকারকে নামমাত্র নির্দিষ্ট অংকের রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে প্রায় স্বাধীন শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। ইউরোপের পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে রাষ্ট্রের উত্থান সম্পর্কযুক্ত বলে ঐতিহাসিকগণ মত প্রকাশ করেন। সে সূত্র ধরেই মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক দ্রুত সম্প্রসারিত বৈদেশিক বাণিজ্যিক যোগাযোগও তাঁর স্বাধীন নবাব হিসেবে গড়ে ওঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ তিনি ও তাঁর উত্তরসুরীদের স্বাধীন শাসক হিসেবে উত্থানের পেছনে সামরিক শক্তির চাইতে পুঁজিবাদী শক্তির প্রয়োগ বেশি কার্যকর ছিল।

সম্পদ ও ইউরোপীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে জগৎশেঠ ও অন্যান্য অনেক ব্যবসায়ী নবাবদের সভার নিয়মিত সদস্যে পরিণত হন। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সভাকক্ষে বণিক শ্রেণির যোগদান প্রমাণ করে যে, বাংলায় একটি পুঁজিবাদী ভাবধারার জোয়ার এসেছিল। সামরিক শক্তির বলয় থেকে বেরিয়ে নীরবে সম্পদ ও উদ্যোক্তাদের কাছে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হচ্ছিল। এ প্রক্রিয়ায় মুর্শিদকুলী খান, আলীবর্দী খান ও সিরাজউদ্দৌলার সভাকক্ষ নব্য অর্থলগ্নীকারী ও বণিকদের উপস্থিতিতে সরগরম ছিল এবং তাদের প্রভাবও ছিল উল্লেখ করার মতো। মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠ, কলকাতার উমিচাঁদ ও হুগলির খাজা ওয়াজেদ ছিলেন নবাবের সভাকক্ষের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্যতম। বিদেশিরা তাদের ‘বণিক রাজপুত্র’ রূপে আখ্যায়িত করতেন।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছিল সম্ভবত সুজাউদ্দিন খানের অধীনে, যখন ইউরোপীয় সমসাময়িক জাতীয় রাজতন্ত্রের অনুরূপ রাষ্ট্রের দায়িত্ব একজন উপদেষ্টার অধীনে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে বিভিন্ন ‘দপ্তরে’ ভাগ করে দেয়া হতো। উপদেষ্টা পরিষদের অনেকেই ছিলেন ধনী হিন্দু ব্যবসায়ী এবং তাদের সঙ্গে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর যোগাযোগ অক্ষুণ্ণ ছিল বলেই তা বাংলার সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি উভয় ক্ষেত্রেই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এ ধারা আরো অধিককাল বজায় থাকলে বাংলা হয়তো হিন্দু-মুসলিম সংহতি রাষ্ট্রের রূপ পেত। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের নতুন পরিবেশ বাংলায় রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ায় নতুন করে দিক পরিবর্তন হয়।

উপনিবেশিক রাষ্ট্র (১৭৬৫-১৮৫৮)  ১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সামরিক শক্তি আরোপ করে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং ১৭৬৫ থেকে ১৭৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাকে পরোক্ষভাবে শাসন করেছে। ১৭৭২ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও ১৭৮৪ সালের পিট্স ইন্ডিয়া অ্যাক্টের মাধ্যমে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গঠিত হয় এবং তা ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এ সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ কর্তৃক উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলা ব্রিটিশ উপনিবেশের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, কোম্পানির অধিনস্থ রাষ্ট্র থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরের বিষয়টি ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। গঠনতান্ত্রিক দিকের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি বললে চলে। কোম্পানির শাসনের অধীনে গঠিত ভূমি ভোগ দখল ব্যবস্থা, বিচার ও ফৌজদারি প্রশাসন, সরকারি চাকরি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া প্রভৃতি সবই প্রায় অপরিবর্তিত থাকে।

মূলত ব্রিটিশদের অধীনে উপনিবেশিক শাসনের পর্বটি প্রথমত উনিশ শতকের ষাট থেকে নববইয়ের দশকে স্থানীয় ও পৌরসভা সরকার ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত ১৮৯২, ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সৃষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর্ব হিসেবে চিহ্নিত। এই আইনসমূহের প্রয়োগের পথ ধরে ব্রিটিশদের থেকে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রক্রিয়ার পথ সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালে ‘ভারত শাসন আইন’ ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এ আইনের দ্বারা ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও একই বছর ১৫ আগস্ট ভারত নামের দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান নামে বাংলাকে যুক্ত করা হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন  সূচনালগ্ন থেকেই রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ায় তার উপনিবেশিক অতীত বিঘ্নের সৃষ্টি করে। উপনিবেশবাদ, রাজনৈতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করে, বিশেষ করে ব্রিটিশ ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে অধিক রূপান্তর সংঘটিত হয়। ফলে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় এ ধরনের রূপান্তর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিশ্লেষণে, উপনিবেশবাদীদের সৃষ্ট মুসলিম জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল তাদের ফেলে যাওয়া জঘন্য আবর্জনার সামিল। কিন্তু অচিরেই মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রতি সাধারণের আগ্রহে ভাটা পড়া এবং ভাষা প্রসঙ্গ ও পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে উপলক্ষ করে সৃষ্ট নতুন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণা রাজনীতিতে স্থান করে নিতে থাকে।

উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উপনিবেশিক আমলের বেসামরিক ও সামরিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপনিবেশবাদ পরবর্তী রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিল, যা দ্বারা মুসলিম জাতীয়তাবাদীগণ সবার জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। অথচ, মুসলিম লীগ স্বয়ং উপনিবেশ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার হাতিয়ার হিসেবে সৃষ্ট এবং তারা পরবর্তীকালে একটি কল্যাণকর স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য অযোগ্য প্রমাণিত ও চিহ্নিত গোষ্ঠী। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের জন্য একটি স্থায়ী সংবিধান তৈরি করতে এবং যেকোন সংবিধানের অধীনে ১৯৭১ সালের বিচ্ছিন্নতার পূর্বেই রাষ্ট্রের জন্য একটি সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

নতুন সীমানা, শরণার্থী, রাষ্ট্রের গঠন ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্বে বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক সীমারেখা পরিলক্ষিত হয়নি। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত বাংলার মানুষ কেবল জনপদ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য, বড় রাজ্য ও সাম্রাজ্য প্রভৃতি অবলোকন করেছে। তারা কখনোই একটি রাষ্ট্রের এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ‘সীমানা’ প্রত্যক্ষ করেনি যা তারা অবাধে অতিক্রম করতে পারে নি। উপনিবেশিক শাসনের সর্বশেষ পরিণতি হলো নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত অলঙ্ঘনীয় সীমানা সহ পাকিস্তান ও ভারত নামের দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের চালিকা শক্তি ছিল একটি নব উদ্ভাবিত ভাবাদর্শ, মুসলিম জাতীয়তাবাদ। ভারতের সকল মুসলিম জনগোষ্ঠী নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনার অধীনে একত্রিত হবে, এমনটাই ভেবে নেয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে, হিন্দুস্থানে হিন্দু জনগোষ্ঠী একীভূত হয়ে ভারত রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদের আলোকে নতুন অভিবাসন প্রক্রিয়াটি কার্যকর করার পথ কী হবে ও নতুন সৃষ্ট রাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব কিরূপ হবে এ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা অনুপস্থিত ছিল। অবশ্য এ বিষয়গুলোর অভ্যন্তরীণ গতিবিধি অনুমান করা সহজ। কারণ নবগঠিত একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো কখনোই সম্ভব নয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের অভিবাসন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য বোঝাস্বরূপ না হয়ে শক্তি বৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে মুসলিম ভাতৃত্ববোধের সংস্কৃতি দ্বারা সকলে নিয়ন্ত্রিত হবে, এমনটাই ধারণা করা হয়েছিল।

কিন্তু কঠিন বাস্তবতার চাপে ইসলামী ভাবধারার এমন অনেক কল্পনাপ্রসূত পরিকল্পনা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক ভূস্বামী, জমিদার, বন্ধকী ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীদের অনেকেই বহনযোগ্য সামান্য সম্পদ সঙ্গে করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। অপরদিকে লক্ষ লক্ষ অশিক্ষিত শ্রমজীবী পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে পূর্ববাংলায় প্রবেশ করে। সে সময়ে সর্বাধিক সংখ্যক কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী বাংলায় প্রবেশ করে। তাছাড়া বিহার অঞ্চলের ক্ষুদ্র দোকানী, দারোয়ান, ফেরিওয়ালা, কারিগর, ভিক্ষুক ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীও বাংলায় আসে। এ সকল শরণার্থী তাদের ভাষা, পেশা ও সাংস্কৃতিক সমস্যার কারণে শহরাঞ্চলে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। ফলে শহরের ধারণ ক্ষমতার তুলনায় জনসংখ্যা বেড়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনুপ্রবেশকারী কৃষিজীবীগণ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। কেউ কেউ নিজেদের আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব কর্তৃক পুনর্বাসিত হলেও অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। ফলে তাদের দ্বারা বাজার ব্যবস্থা অস্থির হয়ে ওঠে ও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে অপ্রত্যাশিত বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক ও মানবিক কারণে সরকার হিন্দুদের ফেলে যাওয়া জমিতে কৃষিজীবী অভিবাসীদের পুনর্বাসনে উৎসাহ যোগালে বিষয়টি বাঙালি প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরপক্ষে উত্তর প্রদেশের বিহারি শরণার্থীদের শহরাঞ্চলে বিভিন্ন কাজ ও চাকরিতে সুযোগ প্রদান করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে চাকরি ও কাজের সংস্থান করতে ব্যর্থ বাঙালি বেকারদের হতাশাগ্রস্ত করে তোলে এবং তাদের মনে অবাঙালি শরণার্থীদের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানীয় বাঙালি ও অভিবাসী অবাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এসব ঘটনা মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

বিভাজনের পথ ধরে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি তা বড়জোর একটি ‘মথ খেকো’ রাজনৈতিক ভূখন্ডের জন্ম দেয়া ছাড়া কোনো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক ছিল না। জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের অন্যতম উপকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, ভাষা ও সংস্কৃতি ইত্যাদির নিরিখে পূর্ব পাকিস্তান কখনোই পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সাধারণ ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে নি। অতীতের সমৃদ্ধ অবস্থানের স্বপ্ন নিয়ে এককালীন সম্পদশালী হিন্দু সম্প্রদায় গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়। তাছাড়া অঞ্চলভিত্তিক পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে পৃথক করে রাখার কারণে তারাও মোহাজের ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো রাষ্ট্র গঠনে উদাসীন থেকে যায়। জনগণের মূল স্রোত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশই পূর্ববাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে রায় দেয়, অপরপক্ষ দ্বিধাহীনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ ব্যবহার করে পাকিস্তানের ধারণা ও কেন্দ্রীয় শক্তির অক্ষুণ্ণতার পক্ষে দাঁড়ায়। স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষের দল স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম জাতীয়তাবাদকে পরিহার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে স্বাধীন রাষ্ট্রের ধারণার প্রসার ঘটায়। প্রথমদিকে ৬-দফা দাবির ভিত্তিতে তারা স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে অগ্রসর হলেও পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্দীপিত হয়ে উঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে ‘বাংলাদেশ’ নামক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।  [সিরাজুল ইসলাম]