রায়, দিলীপকুমার

রায়, দিলীপকুমার (১৮৯৬-১৯৮০)  সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীতালোচক, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক ও কণ্ঠশিল্পী। ১৮৯৬ সালের ২২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের  নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে তাঁর জন্ম। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দিলীপকুমারের পিতা  দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডি.এল রায়) এবং পিতামহ দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্ররায়। বাল্যকালে মাতৃহারা হয়ে দিলীপকুমার পিতার স্নেহচ্ছায়ায় বড় হতে থাকেন, কিন্তু মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে ধনাঢ্য মাতামহের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। তিনি কলকাতার  প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্সসহ বি.এ (১৯১৮) পাস করে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান এবং সেখানে গণিতে ট্রাইপসের প্রথম ভাগ পাস করেন।

দিলীপকুমার সঙ্গীত শিক্ষার মূল প্রেরণা লাভ করেন তাঁর পিতার নিকট থেকে। পরে তিনি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী এবং অচ্ছন্ বাঈয়ের নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করেন। লন্ডনে থাকাকালে তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রথম ভাগ পাস করেন। জার্মান ও ইতালীয় সঙ্গীত শেখার জন্য তিনি লন্ডন থেকে বার্লিন যান এবং ১৯২২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তিনি ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ, ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, পন্ডিত ভাতখন্ডে প্রমুখের নিকট  উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শেখেন।

দিলীপ রায় ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের একজন প্রধান সুর-রচয়িতা ও গায়ক। গান রচনা, গানে সুর দেওয়া এবং গান গাওয়া এ তিন ক্ষেত্রেই তিনি সমান দক্ষ ছিলেন। ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত সঙ্গীতে পারদর্শিতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সমগ্র ভারতের সঙ্গীতজগৎ পরিক্রমা করেন। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীত সম্পর্কে বক্তৃতা দানের জন্য তিনি ১৯২৭ সালে ইউরোপ সফর করেন। সঙ্গীতের তত্ত্ব নিয়ে তিনি সমকালীন পৃথিবীর দুই প্রধান সঙ্গীতবিদ  রবীন্দ্রনাথ ও রম্যাঁ রলাঁর সঙ্গে মতবিনিময় করেন।  সুভাষচন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল; তিনি মহাত্মা গান্ধী, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ মনীষীরও সান্নিধ্য লাভ করেন।

দিলীপকুমার স্বকণ্ঠে গেয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,  অতুলপ্রসাদ সেনকাজী নজরুল ইসলামহিমাংশুকুমার দত্ত প্রমুখের গান জনপ্রিয় করে তোলেন। নজরুলের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি নজরুলের  গজল শ্রেণির গানের প্রচার ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করলে শান্তিনিকেতনের অনুমোদন না পাওয়ায় তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া ছেড়ে দেন। তাঁর গানের রেকর্ড সংখ্যা শতাধিক।

দিলীপকুমার ছিলেন আধুনিক গানের সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ। প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাংলা সঙ্গীতে নতুন মাত্রা সংযোজনের প্রয়াস নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯২৮ সালে সন্ন্যাস অবলম্বন করে তিনি পন্ডিচেরীর অরবিন্দ আশ্রমে আশ্রয় নেন এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ভারত সরকার প্রেরিত সঙ্গীত মিশনের হয়ে ইউরোপের অনেক দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও মিশরে সঙ্গীতের ওপর বক্তৃতা করেন এবং দেশে ফিরে পুণায় বন্ধু জি.ভি মেহতার আমন্ত্রণে তাঁর গৃহে অবস্থান করেন। দিলীপকুমারের প্রভাবে ক্রমে সেই গৃহ ‘শ্রীহরিকৃষ্ণ মন্দির’-এ পরিণত হয়।

দিলীপকুমার সঙ্গীত বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্যসূচির জন্য সরকারের অনুরোধে তিনি গীতসাগর ও সাঙ্গীতিকী গ্রন্থ দুটি রচনা করেন। এছাড়া সঙ্গীতবিষয়ক তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ: সুরবিহার, হাসির গানের স্বরলিপি, গীতমঞ্জরী, দ্বিজেন্দ্রগীতি ইত্যাদি।

সঙ্গীত ব্যতীত অন্যান্য বিষয়েও তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থসংখ্যা মোট আশি। সেগুলির মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো: উপন্যাস মনের পরশ (১৯২৬), দুধারা (১৯২৭), দোলা (২ খন্ড, ১৯৩৫), তরঙ্গ রোধিবে কে, বহুবল­ভ, দ্বিচারিণী; নাটক আপদ ও জলাতঙ্ক (১৯২৬), সাদাকালো (১৯৪৪), শ্রীচৈতন্য (১৯৪৮), ভিখারিণী রাজকন্যা (১৯৫২); প্রবন্ধ শ্রীঅরবিন্দ ও ধর্মবিজ্ঞান, ছান্দসিকী, কবিঋষি গুণীশিল্পী ( অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ ও  শরৎচন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা, ১৯৭৮); ভ্রমণকাহিনী ভ্রাম্যমানের দিনপঞ্জিকা (১৯২৬), আবার ভ্রাম্যমান (১৯৪৪), ভূস্বর্গ চঞ্চল (১৯৪০), এদেশে ওদেশে (১৯৪০), দেশে দেশে চলি উড়ে (১৯৫৫); রম্যরচনা অঘটন আজো ঘটে, ছায়াপথের পথিক, অশ্রুহাসি, ইন্দ্রধনু; স্মৃতিচারণ উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, আমার বন্ধু সুভাষ, তীর্থঙ্কর, শ্রীঅরবিন্দ প্রসঙ্গ (১৯৪২), Among the Great (১৯৪০) ইত্যাদি। তিনি Eyes of Light (১৯৪৫) নামে একখানা ইংরেজি কাব্যও রচনা করেন।

সঙ্গীতে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য দিলীপকুমার ‘সঙ্গীত রত্নাকর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি ভারতের সঙ্গীত নাটক আকাদেমির সদস্য পদ (১৯৬৫) এবং কলকাতা ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি সাহিত্য একাডেমিরও ফেলো ছিলেন। ১৯৮০ সালের ৬ জানুয়ারি মুম্বাইতে তাঁর মৃত্যু হয়।  [মোবারক হোসেন খান]