রঘুনন্দন ভট্টাচার্য

রঘুনন্দন ভট্টাচার্য (১৫শ-১৬শ)  স্মার্ত ও সংস্কৃত পন্ডিত। নদীয়ায় তাঁর জন্ম। পিতা হরিহর ভট্টাচার্যও ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি। বঙ্গে নব্যস্মৃতি চর্চার ক্ষেত্রে রঘুনন্দনকে মধ্যসীমা ধরে তিনটি যুগবিভাগ করা হয়: প্রাক্রঘুনন্দন, রঘুনন্দন এবং রঘুনন্দনোত্তর যুগ। তবে বঙ্গীয় নব্যস্মৃতি বলতে সাধারণত রঘুনন্দনকেই বোঝায়। এর কারণ তাঁর অসাধারণ প্রতিভা এবং বহুল প্রচারিত ও পঠিত গ্রন্থরাজি। সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ, অগাধ শাস্ত্রজ্ঞান এবং গভীর পান্ডিত্যের দ্বারা তিনি তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিধি-বিধানগুলি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে তাঁর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী স্মার্ত পন্ডিতগণ নিষ্প্রভ হয়ে গেছেন।

রঘুনন্দনের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি কেবল শাস্ত্রশৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে সমাজের বিধান দেননি, বরং সমকালীন সমাজের বাস্তবতা বিবেচনাপূর্বক প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শাস্ত্রের বাইরে এসেও তান্ত্রিক ধর্মের অনেক বিধিব্যবস্থা সমাজের জন্য গ্রহণ করেছেন। তাই দেখা যায় রঘুনন্দনের স্মৃতিগ্রন্থগুলিতে তন্ত্রের গভীর প্রভাব পড়েছে। বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রসার এবং মুসলমানদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম যখন সঙ্কটের মুখে, তখন এর ত্রাণকর্তা হিসেবেই যেন রঘুনন্দনের আবির্ভাব ঘটেছিল। সে সময় বৌদ্ধ তন্ত্রের অনুকরণে অনেক বৈষ্ণব তন্ত্র রচিত হয় এবং বৌদ্ধ সহজিয়ামতের অনুকরণে উদ্ভব ঘটে  বৈষ্ণব সহজিয়া মতের। এর দ্বারা সমাজ দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। এমতাবস্থায় সনাতন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের রক্ষাকল্পে রঘুনন্দন সমাজ-বাস্তবতাকে অস্বীকার না করে এবং তান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে আপোষ করেও ব্রাহ্মণ্যধর্মকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্মৃতিগ্রন্থে সময়োপযোগী বিধি-ব্যবস্থা প্রদান করেন। এ কারণেই তাঁর গ্রন্থগুলি তৎকালীন সমাজে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং বঙ্গীয় স্মৃতিশাস্ত্রে তিনি হয়ে ওঠেন এক অতুলনীয় পন্ডিত।

রঘুনন্দন স্মৃতিশাস্ত্রের ওপর আটাশখানি গ্রন্থ রচনা করেন। অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। এতে স্মৃতিশাস্ত্রের প্রায় যাবতীয় বিষয় আলোচিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শ্রাদ্ধতত্ত্ব, তিথিতত্ত্ব, শুদ্ধিতত্ত্ব, স্মৃতিতত্ত্ব, দুর্গাপূজাতত্ত্ব, তীর্থতত্ত্ব, যাত্রাতত্ত্ব, দায়তত্ত্ব ইত্যাদি প্রয়োগগ্রন্থ। তিনি বঙ্গের অন্যতম স্মার্ত পন্ডিত জীমূতবাহনের দায়ভাগেরও টীকা রচনা করেছেন। স্মৃতিশাস্ত্রে পান্ডিত্যের জন্য রঘুনন্দন সমগ্র ভারতে ‘স্মার্ত ভট্টাচার্য’ নামে পরিচিত ছিলেন। বঙ্গীয় হিন্দুসমাজ আজও তাঁর নির্দেশ অনুসারেই চলে।

রঘুনন্দন শুধু স্মৃতিশাস্ত্রই নয়, ব্যাকরণ (কলাপতত্ত্বার্ণব, শব্দশাস্ত্রবিবৃতি), তন্ত্র (মহিম্নঃস্তোত্রটীকা), জ্যোতিষ ইত্যাদি বিষয়েও অভিজ্ঞ ছিলেন। বাংলায় জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধে রঘুনন্দনের জ্যোতিস্তত্ত্ব সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। [দুলাল ভৌমিক]