মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি

মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি  একটি সামাজিক সংগঠন। ১৮৬৩ সালে নওয়াব আবদুল লতিফ কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। সোসাইটির সেক্রেটারি আবদুল লতিফের কলকাতার ১৬ নং তালতলার বাসভবনে সোসাইটির সদর দপ্তর ছিল। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ রহিমুদ্দীন এবং সহ-সভাপতি ছিলেন অযোধ্যার প্রিন্স মির্জা জাহান কাদের বাহাদুর ও মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ নাসিরুদ্দীন হায়দার। কমিটির মোট ১২ জন সদস্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অযোধ্যার প্রিন্স মির্জা আসমান জাহ বাহাদুর ও প্রিন্স মুহম্মদ জাহ আলী বাহাদুর এবং মহীশূরের প্রিন্স মুহম্মদ হরমুজ শাহ ও প্রিন্স মুহম্মদ বখতিয়ার শাহ। বাংলার ছোটলাটকে সোসাইটির পৃষ্ঠপোষক করা হয়েছিল। সমগ্র ভারতবর্ষের পাঁচ শতেরও বেশি মুসলমান সোসাইটির সাধারণ সদস্যভুক্ত ছিল। সোসাইটির মাসিক সভার কার্যক্রম উর্দু, ফারসি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হতো।

আবদুল লতিফ এর ভাষায় ‘মুসলমানদের ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং সামাজিক আচরণ ও আদান-প্রদানে শিক্ষিত হিন্দু ও ইংরেজদের সমকক্ষ করে তোলাই ছিল সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিজ্ঞান, কলা ও চলমান সমস্যা সংক্রান্ত এবং মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উপায় উদ্ভাবনের জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করেন। সোসাইটি মুসলমানদের ক্ষয়িষ্ণু আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার দ্বারা সমাজ উন্নয়নের নতুন ধারার প্রবর্তনা এবং এভাবে শাসক ও শাসিতের মধ্যে এক নির্ভরশীল সেতু স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মুসলমানদের এই ধরনের সর্বপ্রথম সংগঠন হিসেবে মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি কালক্রমে মুসলমানদের প্রভূত কল্যাণ সাধন করে।

মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির প্রথম সভা কলকাতার ১৬নং তালতলায় অনুষ্ঠিত হয়। মৌলভী মুহম্মদ ওয়াজির এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে মতবিনিময়ই ছিল এ ধরনের নিয়মিত সভার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বছরে একবার কলকাতা টাউন হলে সোসাইটির সদস্যদের পান্ডিত্যপূর্ণ সান্ধ্য আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হতো। কলকাতা শহরের দেশী-বিদেশী প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও জ্ঞানী-গুণীরা এই অনুষ্ঠানে আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রদর্শন করতেন। ১৮৬৫ সালে কলকাতা টাউন হলে সোসাইটির এক জনাকীর্ণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার ছোটলাট এই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদীদের মধ্য থেকে প্রায় দুই হাজার প্রতিনিধি এই সমাবেশে অংশ গ্রহণ করেন। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি এভাবে প্রখ্যাত পন্ডিত ও জ্ঞানী-গুণীদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির বিভিন্ন সভায় ইন্দোরের মহারাজা, ভূপালের বেগম এবং জয়পুর, পাতিয়ালা ও কুচবিহারের রাজারা সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

নওয়াব আবদুল লতিফ এই সোসাইটির মাধ্যমে মুসলমানদের মৌলিক সমস্যাবলির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার প্রসার এবং মোহসীন ফান্ড এর টাকা কেবলমাত্র মুসলমানদের শিক্ষার কাজে ব্যয় করার সরকারি সিদ্ধান্ত মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির উল্লেখযোগ্য সাফল্য। নওয়াব আবদুল লতিফ নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটিকে মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি অর্জনের ফোরাম হিসেবে গড়ে তোলেন। ‘মুসলিম ইনস্টিটিউট অব ক্যালকাটা’ নামে মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি মুসলমানদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।  [মুহম্মদ আবদুল খালেক]