মৃত্তিকা ক্ষয়

মৃত্তিকা ক্ষয় (Soil Erosion)  পৃষ্ঠমৃত্তিকার ভৌত অপসারণ। বিভিন্ন প্রকার এজেন্ট, যেমন: বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা পরিলেখের উপর ও মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানি, বাতাসের বেগ এবং অভিকর্ষীয় টান দ্বারা মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে থাকে। ভূতাত্ত্বিক এবং ত্বরিত (accelerated) ক্ষয় দ্বারা বৈসাদৃশ্যমূলক মৃত্তিকা অপসারণকে বুঝায়। ভূতাত্ত্বিক ক্ষয় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা মানুষের প্রভাব ব্যতীত প্রাকৃতিক পরিবেশে ভূমির ক্ষয়সাধন করে। এটি একটি ধীর গতিসম্পন্ন ও গঠনমূলক প্রক্রিয়া। মৃত্তিকা অপসারণের বিশালায়তন ত্বরিত প্রক্রিয়া মৃত্তিকা গঠন ও ত্বরিত ক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত মৃত্তিকা অপসারণের মধ্যে স্বাভাবিক সাম্যসহ মানুষের প্রভাবের দ্বারা ঘটে, যা মৃত্তিকা ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।

ক্ষয়কারী বল, বিশেষ করে পানি, বরফ, বায়ু, হিমবাহ ইত্যাদি কারণে মৃত্তিকা পৃষ্ঠের অবনতি দ্বারা ক্ষয়সাধন সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ক্ষয় প্রক্রিয়া ঘটানো ও গতিপথ প্রভাবকারী এজেন্ট অনুসারে বিভিন্ন মাত্রায় মৃত্তিকা পৃষ্ঠের অবনতি ঘটে। মৃত্তিকা ক্ষয়কে পানি, হিমবাহ, তুষার, বায়ু দ্বারা ক্ষয় ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী পানি ও বায়ু দ্বারা সর্বাধিক মৃত্তিকা ক্ষয় সাধিত হয়, যার প্রতিকূল প্রভাব মানুষের কার্যকলাপ দ্বারা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে পানি দ্বারা ক্ষয়ের মাধ্যমে সর্বাপেক্ষা ব্যাপক বিস্তৃত মৃত্তিকা অবনয়ন ঘটে, যা দেশের ২৫ শতাংশ কৃষিভূমিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকারের মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে, যেমন: পরতে পরতে ভূমিক্ষয় (sheet erosion), জলনালিকা (rill) ও নালাক্ষয় (gully erosion), ভূমিধস, নদীতটীয় ভূমিক্ষয়, উপকূলীয় ভূমিক্ষয়। দেশের প্রায় ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর পাহাড়ি এলাকায় ত্বরিত মৃত্তিকা ক্ষয় ঘটে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (BARI) রামগতি স্টেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতি বছর মোট মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ ২.০ থেকে ৪.৭ টন/হেক্টর।

হিসাব করে দেখা গিয়েছে যে, স্থানান্তর প্রথায় চাষের (shifting cultivation) ৩০-৪০ শতাংশ ও ৪০-৮০ শতাংশ ঢালে প্রতি বছর মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ যথাক্রমে ৪২ টন/হেক্টর ও ৭-১২০ টন/হেক্টর। মৃত্তিকা ক্ষয় ছাড়াও উপরের স্তর থেকে যথেষ্ট পরিমাণে গাছের পুষ্টি উপাদানও অপসারিত হয় এবং তীব্র আকারে মৃত্তিকা অবনয়ন ঘটায়। এছাড়া বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার কারণে দেশের বনভূমির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। বনভূমি উজাড় করার ফলে এসব এলাকা পানি দ্বারা মারাত্মক ক্ষয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এভাবে পানি দ্বারা মৃত্তিকাক্ষয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ১০২ টন/হেক্টর। বাংলাদেশে নদী পার্শ্বক্ষয় বর্ষা মৌসুমে প্রধানত প্রচন্ড নদী স্রোতের কারণে ঘটে।

পললভূমির প্রায় ১.৭ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা নদীতটীয় ক্ষয়প্রবণ। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজশাহী ও দিনাজপুর এলাকা বায়ু ক্ষয় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড় থেকে ক্ষয় হওয়া মৃত্তিকা ভাটি অঞ্চলের কোন না কোন এলাকাতে অবক্ষেপিত হয়। সক্রিয় নদীখাত এবং পাহাড়ি স্রোতধারা সংলগ্ন এলাকাতে বেলেময় বস্ত্ত দ্বারা সাধারণত আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে কৃষিভূমি আবৃত হয়ে থাকে। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ের পাদদেশীয় পলল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃষ্ঠগড়ানো পানির সঙ্গে নিচে বাহিত স্থূলাকার বস্ত্তর অবক্ষেপণ দ্বারা ভূমি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মৃত্তিকা ক্ষয় অপরিবর্তনীয় হওয়ার কারণে এটাকে সাধারণত মৃত্তিকা অবনয়নের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। মৃত্তিকা ক্ষয় ব্যবস্থাপনা কতকগুলো মতবাদের ওপর ভিত্তিশীল: (ক) ত্বরিত ভূমিক্ষয় রোধ করতে অত্যধিক ক্ষয়যোগ্য বা সংবেদনশীল মৃত্তিকাকে অবশ্যই সুরক্ষা করতে হবে; (খ) সুপ্ত উৎপাদনশীল মৃত্তিকা উর্বরতা অব্যাহত রাখতে যথাযথভাবে মৃত্তিকাকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে এবং (গ) ক্ষয়ে যাওয়া মৃত্তিকাকে অবশ্যই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং একই সঙ্গে এসব মৃত্তিকার অবনয়নকে নিবারিত করতে হবে। [টি.এইচ খান এবং এস.এম ফজলে রাবিব]