মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৮৬৪

মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৮৬৪  বাংলায় স্থানীয় শাসন বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সূচনা করে। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে স্থানীয় সরকারের নীতি গৃহীত হয় অনেক আগেই। চার্টার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই শহর তিনটির নাগরিকদের প্রতিনিধিগণ শহরগুলির প্রশাসন পরিচালনা ও নাগরিক সেবা প্রদান করা শুরু করেন। কিন্তু অন্যান্য শহর বা গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে এ ধরনের নাগরিক সুবিধা প্রদান বহুদিন পর্যন্ত করা হয়নি। এ বিলম্বের কারণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার ভয়। তাছাড়া স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ জনগণ সাধারণত অতিরিক্ত কর প্রদানে বরাবরই বিমুখ।

প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি দারুণভাবে বিঘ্নিত হওয়ায় সরকার দেশে পৌরসভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৮৪২ সালে Act- X পাস করে। আইনটি ছিল ক্ষমতাপ্রদান সম্পর্কিত। এই আইন অনুসারে পৌরসভা প্রয়োজনে স্থানীয় করারোপ করতে পারত। আইনটির আওতায় যে কোন স্থানের বাসিন্দাগণকে অধিকতর উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কথা বলা হয়। তদুপরি জনগণ এই প্রত্যক্ষ কর  প্রদানে ইচ্ছুক না হওয়ায় তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্বভাবতই জনগণ শহরের রাস্তা বা পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মতো কাজের জন্য অতিরিক্ত কর দিতে অনীহা প্রকাশ করে। তারা পৌরসভার মতো কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেনি।

এ সমস্যা নিরসনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৮৫০ সালে Act XXVI পাস করে। এ আইন দ্বারা ১৮৪২ সালের আইন বিলুপ্ত করে স্থির হয় যে, বিশেষ অবস্থায় সরকার নিজ উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। পৌরসভাগুলি যখন গঠিত হবে তখন আগের মতোই প্রতিষ্ঠানাদি সংরক্ষণ, রাস্তাঘাট সংস্কার, আলোর ব্যবস্থাকরণ ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করবে, আইনের উপধারাসমূহ প্রণয়ন করবে এবং জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে সেসবের বাস্তবায়ন ঘটাবে। এছাড়া, কর আদায়ের ব্যবস্থা করা হয় পরোক্ষভাবে। এ আইন অনুসারে (একজন) ম্যাজিস্ট্রেট ও কয়েকজন কমিশনারের সমন্বয়ে পৌরসভা কাউন্সিল গঠন করা হয়। এর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল সামান্যই। স্থির হয় যে, ‘জনগণ নিজেরাই সর্বক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ বা নগর কর ধার্য করাসহ অন্য যে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে’। এ ব্যবস্থাও বিভিন্ন কারণে বস্ত্তত অকার্যকরই থেকে যায়।

১৮৫৬ সালে সরকার ‘’টাউন পুলিশ অ্যাক্ট’ পাস করে। এ আইন অনুসারে ব্যয় নির্বাহের জন্য শহরে বাড়ির মালিকদের ওপর সর্বোচ্চ ৫% হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করা হয়। বাংলার বিভিন্ন শহরে অবিলম্বে এই আইন কার্যকর হয়। এটা ‘মিউনিসিপ্যাল ল’ না হলেও পরবর্তী ‘মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট’-এর ওপর এর প্রভাব ছিল যথেষ্ট।

১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহি বিপ্লব ভারত সরকারের অর্থনৈতিক ভিতকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার কারণে সরকার স্থানীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে করারোপ করে কেন্দ্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ কমাতে প্রয়াসী হয়। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের অর্থবিষয়ক সদস্য, জেমস উইলসন, তার ১৮৬১ সালের বাজেট বক্তৃতায় স্থানীয় দায়িত্বের ওপর জোর দেন। তিনি সড়ক ও পূর্তকাজের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের ওপর অর্পণের প্রস্তাব করেন। ইউরোপীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে আয়কর বাতিল করায় সরকারের ওপর প্রচন্ড চাপ পড়ে এবং তা কমানো অত্যাবশকীয় হয়ে ওঠে। সুতরাং সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভবিষ্যতে নগর পুলিশের ব্যয়ভার নগরবাসিগণ নিজেরাই সরাসরি বহন করবেন। ক্ষতিপূরণ হিসেবে সব শহরে পৌরসভা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং পৌরসভাগুলিকে সরকারি বিধি অনুসারে কর আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়। এই কর প্রয়োজন ছিল পৌরসভাবাসীর শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য। প্রাদেশিক সরকারগুলির ওপর এসব পৌরসভার গঠন প্রক্রিয়া ছেড়ে দেওয়া হয়।

বাংলা সরকার সিদ্ধান্তটি দ্রুত বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে সরকার ‘মিউনিসিপ্যালিটি ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট’ (১৮৬৪ সালের Act III নামে পরিচিত) পাস করে। এ আইন ১৮৫০ সালের Act XXVI বাতিল করেনি। তবে Act XXVI অনুসারে কোন শহরে পৌরসভা স্থাপনের জন্য শহরের নাগরিকদের লিখিত আবেদন জানানোর শর্ত ছিল। ১৮৬৪ সালের আইন সরকারকে কোন রূপ পূর্বআবেদন ছাড়াই প্রয়োজনবোধে যে কোন শহরে পৌরসভা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা প্রদান করে। নতুন আইনে নব প্রতিষ্ঠিত পৌরসভাগুলিকে স্থানীয় কার্যাদি সম্পাদন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাড়িঘর, জমিজমা, পশুসম্পদ, যানবাহন ইত্যাদির ওপর করারোপ করে অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কোন বাড়ির নিরূপিত মূল্যের ৭% ছিল করারোপের সর্বোচ্চ হার।

নগর পুলিশদের বেতন বাবদ ব্যয় নির্বাহ ছিল পৌরসভার করারোপ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয়ের প্রধান খাত। এই ব্যয় নির্বাহের পর উদ্ধৃত্ত অর্থ ব্যয় করা যেত অন্যান্য স্থানীয় উন্নয়ন খাতে। পৌরসভাগুলিকে উপধারা প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হলো যাতে জনপ্রতিনিধিগণ জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করতে পারেন। এই আইনের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বর্ধমান, মেদেনীপুর এবং হুগলি পৌরসভাগুলি স্থাপন করা হয়।

এই আইন দ্বারা প্রত্যেক পৌরসভায় একটি করে ‘মিউনিসিপ্যাল বোর্ড’ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পদাধিকার বলে একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং কয়েকজন মনোনীত সদস্য নিয়ে মিউনিসিপ্যাল বোর্ড গঠিত হবে বলে স্থির হয়। বোর্ডের সদস্য সংখ্যা হবে ১৭ থেকে ২১ এবং তাদের মধ্যে ৭ জন হবেন অবশ্যই স্থানীয় বাসিন্দা। কিন্তু এই আইনে পদাধিকার বলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় এবং এটাই ছিল এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সংখ্যাধিক্যের ভোটে অবশ্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল এবং প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে সমান সমান ভোট হলে চেয়ারম্যান তার কাস্টিং ভোট প্রয়োগ করতে পারতেন।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের অভিপ্রায়ে আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয় যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। শীঘ্রই এ মর্মে অভিযোগ উত্থাপিত হয় যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ এমনভাবে পৌরসভার কাজকর্ম পরিচালনা করছেন যেন, এটাও আরেকটা সরকারি প্রতিষ্ঠান। বোর্ডের অন্যান্য সদস্য, বিশেষ করে ভারতীয় সদস্যদের অভিমতের প্রতি প্রায় কোন গুরুত্বই দেওয়া হতো না। সাধারণ ভারতীয়দের নিকট থেকে সংগৃহীত অর্থ ইউরোপীয়দের, কমিশনারদের এবং ধনী ও প্রভাবশালী নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার নিমিত্ত ব্যয় করা হতো। এটা সত্য যে এই সময় সরকারী কর্মকর্তাগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রায় কোন কিছুই অন্য কারও সাথে ভাগাভাগি করতে রাজি ছিলেন না। ভারতীয় প্রতিনিধিগণের সাথে ক্ষমতা ভাগ করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় শীঘ্রই এ ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তারা প্রকাশ্য জনসভায় এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মতামত প্রকাশ করেন। তারা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে একটা প্রচন্ড পরিহাস বলে আখ্যায়িত করেন এবং দাবি করেন সরকারে জনগণের অংশীদারিত্ব। এ ধরনের অসন্তোষ বাড়তে থাকলে তার পরিণতি কতটা মারাত্মক হতে পারে সে সম্পর্কে লর্ড রিপন অবহিত ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, ভারতীয় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মেধার শুধু অপচয়ই ঘটবে যদি সরকার এর সদ্ব্যবহার না করে, বিশেষ করে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে। তিনি সাম্রাজ্যের স্বার্থে তাদেরকে সরকারের ভেতরে সহযোগী ও বন্ধু হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, প্রশাসনের বাইরে রেখে প্রচন্ড শত্রু বানাতে চাননি।

এভাবে লর্ড রিপনের সরকার ১৮৮২ সালের ১৮ মে ভবিষ্যৎ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সাধারণ সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত নীতিসমূহ গ্রহণ করে। ১৮৮৪ সালে বঙ্গীয় সরকার পৌরসভাগুলি জনগণের নির্বাচিত সদস্য ও চেয়ারম্যান দ্বারা পরিচালিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার (Democratisation of government) পথ সুগম করে।  [শরীফ উদ্দিন আহমেদ]