মজুমদার, শ্রীশচন্দ্র

মজুমদার, শ্রীশচন্দ্র (১৮৬০-১৯০৮)  সম্পাদক, সাহিত্যিক। ১৮৬০ সালের বর্ধমানের নপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য-পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রসন্নকুমার মজুমদার, পুঠিয়া স্টেটের দেওয়ান ছিলেন।

১৮৭৬ সালে বোয়ালিয়া (রাজশাহী) স্কুল হতে তিনি এন্ট্রাস পাস করেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বহুদূর অগ্রসর না হলেও নিজ চেষ্টায় নিজেকে স্বশিক্ষিত করে তুলেছেন। তাঁর কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয় পুঠিয়া রাজধানীতে। বিশেষ করে পুঠিয়ায় বসবাসকারী মহারাণী শরৎসুন্দরী দেবীর অপত্যনির্বিশেষ স্নেহের মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জগতে হাতে খড়ি হয়। শ্রীশচন্দ্রের লেখা সম্পর্কে মহারাণীর অনুমোদন ও উৎসাহ উদ্দীপনা নিরন্তন তাঁকে সাহিত্যালোচনায় অগ্রসর করেছে। তৎকালীন শরৎসুন্দরী দেবীর সংস্কৃত ও বাংলা গ্রন্থের যে সংগ্রহ ছিল তা রাজধানীর যেকোনো বৃহৎ পুস্তকালয়ের পক্ষে গৌরবজনক। উক্ত পুস্তক সংগ্রহশালার একজন নিয়মিত পাঠক ছিলেন শ্রীশচন্দ্র।

তাঁর প্রাথমিক রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি- চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত মাসিক সমালোচকের ৭ম-৮ম যুগ্ম সংখ্যায় (কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১২৮৬) প্রকাশিত ‘বর্ত্তমান বঙ্গ সমাজ ও চারিজন সংস্কারক’। প্রবন্ধটি ছিল বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আলোচনা। আলোচনায় শ্রীশচন্দ্রের চিন্তাশীলতা ও তাঁর নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ পোষণ করেন। ফলে ১৮৮০ সালে রথযাত্রার দিন চুঁচুড়ায় তাদের সাক্ষাৎ হয়। পরে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।

১২৯০ সালে কার্তিক মাসে শ্রীশচন্দ্র মজুমদার বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর উক্ত পত্রিকার দায়িত্ব অর্পণ করেন। পরে ১৮৮৫ সালে তিনি নদীয়ায় সাব-ডেপুটি কালেক্টর পদে নিযুক্ত হন। এ দায়িত্ব পালনের সুযোগে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গয়া, সীতামাঢ়ী, কাশি, বীরভূম. সিংহভূম, লোহার ডাঙ্গা, পালামৌ ও সাঁওতাল পরগণা প্রভৃতি স্থানের সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবনকে তাঁর সমসাময়িক যে ক’জন বন্ধু পুষ্ট করে তুলেছেন তাদের মধ্যে শ্রীশচন্দ্র মজুমদার অন্যতম। বঙ্গদর্শন পত্রিকার সুবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়। বিশেষ করে গান ও সাহিত্য-সমালোচনার মাধ্যমে তাঁদের বেশ অন্তরঙ্গ মুহূর্ত অতিবাহিত হয়। শ্রীশচন্দ্রের সাহচার্য-বিরহের কথা ও তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছিন্নপত্রের অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন। সেসবের একটি-‘‘আপনি আপনার কেতাবের মধ্যে আমাদের চিরপরিচিত বাংলাদেশের  একটি সজীব মূর্তি জাগ্রত করে তুলেছেন, বাংলার আর কোনো লেখক এতে কৃতকার্য হননি।... আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের সময় বাংলাদেশই ছিল কিনা ভবিষ্যতে এ নিয়ে তর্ক ওঠতে পারে।... আপনার সেই লেখাটির মধ্যে বাংলাদেশের সন্ধান পাওয়া যায়।’’

কৈশর হতেই মাতৃভাষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। ফলে পেশাদারি কাজের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সাধনা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যান। বাংলা সাহিত্যে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: পদরত্নাবলী (সম্পাদিত, ১৮৮৫), শক্তি কানন (উপন্যাস, ১৮৮৭), ফুলজানি (উপন্যাস, ১৮৯৪), কৃতজ্ঞতা (উপন্যাস, ১৮৯৬), বিশ্বনাথ (ঐতিহাসিক উপন্যাস, ১৮৯৬), রাজ-তপস্বিনী (১৯১২), শ্রীশচন্দ্রের গ্রন্থাবলী (১৯১৯)। তাছাড়া সাধনা, ভারতী, সাহিত্য, প্রদীপ, বঙ্গদর্শন, সমালোচনী প্রভৃতি সাময়িকপত্রে তাঁর অসংখ্য গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রয়েছে। ১৯০৮ সালের ৮ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।  [শামীমা আক্তার]