মঙ্গলকোটের ভাস্কর্য

মঙ্গলকোটের ভাস্কর্য  বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে নামুজা ইউনিয়নের চিঙ্গাসপুর গ্রামে অবস্থিত। ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রত্নক্ষেত্রটিকে চিহ্নিত করেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮১-৮৩ সালে উৎখনন কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে। প্রায় বর্গাকৃতির মন্দিরটির আয়তন ৫.০২ মি × ৪.৯২ মি।

উৎখননের মাধ্যমে মঙ্গলকোটে এক হাজারেরও বেশি প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলোর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের প্রচুর পোড়ামাটির ভাস্কর্য। বাংলাদেশের অন্যকোন প্রত্নক্ষেত্রে এ ধরনের বৃহদাকৃতির পোড়ামাটির ভাস্কর্য পাওয়া যায়নি। ভাস্কর্যগুলোর গড় উচ্চতা ০.০৬১ মিটার (২র্)। এগুলোর প্রায় সবগুলোই আবক্ষ নারী মূর্তি। মূর্তিগুলির মাথায় একটি করে সর্পফণা রয়েছে। এগুলি সর্পদেবী মনসার মূর্তি। তবে দ’ুএকটি প্রতিমা সর্পফণাবিহীন। সুঠামদেহী ও স্বাস্থ্যবতী নারী ভাস্কর্য প্রতিমাগুলোর যে মোহনীয় রূপ শিল্পি ফুটিয়ে তুলেছেন তা তুলনাহীন।

অধিকাংশ ভাস্কর্য ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া গেলেও সৌভাগ্যজনকভাবে বেশ কয়েকটি ভাল অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। এ ভাস্কর্যগুলির নির্মাণ রীতির বিশ্লেষণ এগুলোর শিল্পরীতি বুঝতে সাহায্য করে। এমনি একটি ভাস্কর্যের কমনীয় মুখাবয়বে (ছবি-১) ধনুক বক্র ভ্রু, আনত দৃষ্টি, টিকালো নাসিকা, হাসির রেখা ফুটে উঠা ওষ্ঠ, তীক্ষ্ণ চিবুক প্রভৃতির মধ্যে গুপ্ত শিল্পকলার সব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। গুপ্ত শিল্পি সফলভাবে একটি দেবী মুখাবয়বের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ভক্তবৃন্দের মনের আকুতি বুঝতে পারার মতো অসাধারণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন। যার সাথে মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত গুপ্ত যুগের একটি পোড়ামাটির ভাস্কর্যের মুখভঙ্গির তুলনা করা যেতে পারে (ছবি-২)। মঙ্গলকোট ভাস্কর্যগুলো গুপ্ত পাথরের ভাস্কর্যগুলোর মতোই শিল্পশৈলী প্রকাশে শতভাগ সফল। মঙ্গলকোটে প্রাপ্ত ধ্রুপদী গুপ্ত শিল্পকলার এক উৎকৃষ্ট  উদাহরণ একটি তরুণী প্রতিমা যার গলায় বিনুনির ন্যায় পাকানো (সামান্য মোটা) হার, কানে কুন্ডল, মাথায় পেছন থেকে সম্মুখভাগ দিয়ে বেষ্টিত বিনুনি সদৃশ কেশসজ্জা, দেহের শক্ত গাঁথুনী এবং অবাক দৃষ্টিতে তাকানোর ভঙ্গিমা ইত্যাদি মিলিয়ে শিল্পি ফুটিয়ে তুলেছেন যেন সদ্য কৈশোরে পা দেয়া কোন কিশোরী পৃথিবীকে নতুন করে অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করছে (ছবি-৩)। তার আয়তাকার মুখাবয়ব, পুরু নিম্নোষ্ঠ, টিকালো নাসিকা, চিবুক ইত্যাদি সবকিছুই ধ্রুপদি গুপ্ত শিল্পকলার নির্দেশক। মঙ্গলকোটে প্রাপ্ত আরেকটি নারী আবক্ষ মূর্তির ভাস্কর্য (ছবি-৪) অনেকটাই পূর্বেরটির মতো। তবে তার তাকানোর ধরণ ভিন্ন।

মনসা প্রতিমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি বাংলায় গুপ্ত শিল্পকলার একটি ধ্রপদী উদাহরণ (ছবি-৫)। তার মাথায় সর্পফণা, কানে কুন্ডল, গলায় কারুকার্যহীন কিন্তু রুচিবোধ সম্পন্ন হার রয়েছে। সুঙ্গ যুগের তুলনায় এতে অলংকারের বাহুল্য নেই। কিন্তু অতিরিক্ত অলংকারের প্রয়োগের মাধ্যমে কৃত্রিম সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার পরিবর্তে গুপ্ত শিল্পি নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য তার দেহের গড়নের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। যেন গুপ্ত কবি কালিদাসের কুমারসম্ভবে পার্বতীর সৌন্দর্য বর্ণনায় ব্যবহূত উপমার বাস্তব প্রয়োগ। প্রতিমাটির সরু কটিদেশ যেন কালিদাস কর্তৃক ‘মেঘদূতে’ নারী সৌন্দর্যের বর্ণনার বাস্তব প্রয়োগ। সর্বোপরি নারীর মোহনীয়-কমনীয় রূপের সফল বাস্তবায়ন হয়েছে আলোচ্য ভাস্কর্যে।

সর্পফণা যুক্ত আরেকটি মুখমন্ডলে শিল্পি মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলেছেন। মঙ্গলকোটের শিল্পিরা বংশ পরম্পরায় কাজের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা অর্জন করেছে ভাস্কর্য সৃষ্টিতে। শিল্পকলার ইতিহাসে এ অঞ্চলের শিল্পিদের যথেষ্ঠ অবদান রয়েছে। শুঙ্গ যুগ হতে শিল্পকলায় তাদের দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় মহাস্থান খননে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকচিত্রে। গুপ্ত শিল্পিরা তাদের চারপাশের মানুষের বিভিন্ন অভিব্যক্তিকে শিল্প মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে। সর্পফণাযুক্ত মস্তকটি মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের অন্যতম উদাহরণ (ছবি-৬)।


মঙ্গলকোটে প্রাপ্ত ভাস্কর্য শুধুমাত্র তরুণ প্রজন্মকেই উপস্থাপন করেনি পূর্ণ বয়স্কদেরও উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ধরনের দুটি ভাস্কর্যের একটি পুরুষ এবং অন্যটি নারী ভাস্কর্য। পুরুষ ভাস্কর্যটির আয়তাকার ভারী মুখমন্ডল ও নাকের গড়নের মধ্যে দিয়ে (ছবি-৭) একজন মধ্য বয়সী পুরুষকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তেমনিভাবে সামান্য মাংসল মুখমন্ডলের একজন পূর্ণ বয়স্ক নারীকে সফলভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে (ছবি-৮)। এ অঞ্চলের শিল্পিরা কেবল মানুষের ভাস্কর্যেই দক্ষ ছিল না তাদের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় প্রাণী চিত্র পরিস্ফুটনে। একটি পোড়ামাটির ফলকে রাজহাঁসের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হাঁসটির অলংকৃত পালক ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করার অসাধারণ ভঙ্গীমার সাথে অন্য কিছুর তুলনা চলে না।

গুপ্ত যুগীয় ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিমার অভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তিকে মুখাবয়বে ফুটিয়ে তোলা। এ প্রসঙ্গে মহাস্থানগড় ও সংলগ্ন অঞ্চলে প্রাপ্ত গুপ্ত যুগীয় কয়েকটি পোড়ামাটির ভাস্কর্যের উল্লেখ করা যেতে পারে। মহাস্থান জাদুঘরের ৪ নং শোকেস-এ প্রদর্শিত দেবমস্তক এবং পাহাড়পুর জাদুঘরের দেবমস্তকটি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও মহাস্থান জাদুঘরে প্রদর্শিত কাজীপুরে প্রাপ্ত দেবমস্তকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ মস্তকটি গড়ার সঠিক সময়ের উল্লেখ না করলেও মাংসল মুখমন্ডল, স্থুল নিম্নোষ্ঠ, টিকালো নাসিকা ইত্যাদি সবকিছুই গুপ্ত রীতির পরিচায়ক। ভাস্কর্যের অর্ধনিমীলিত চোখ এবং ওষ্ঠ রেখাদ্বয়ের মৃদু হাসির আভায় যে ধ্যানলব্ধ আনন্দের উপলব্ধি ও পরিতৃপ্তির সুসংযত ও মার্জিত প্রকাশ ঘটানো হয়েছে তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন এবং অভ্যন্তরীণ পরিতৃপ্তিকে মুখাবয়বে ফুটিয়ে তোলার এই শৈল্পিক দক্ষতা একান্তই গুপ্তরীতির বৈশিষ্ট্য। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত মুকুট পরিহিত নারী মস্তকের মাংসল মুখমন্ডল, টিকালো নাসিকা, অর্ধনিমীলিত চোখ এবং ওষ্ঠদ্বয়ে মৃদু হাসির রেখার মাধ্যমে ধ্যানমগ্ন আনন্দ ও মানসিক পরিতৃপ্তির অভ্যন্তরীণ বহিঃপ্রকাশকে মুখাবয়বের অভিব্যক্তিতে ফুটিয়ে তোলার এই কৌশল বাংলাদেশে অতি উন্নত গুপ্তশৈলীর প্রয়োগ ও প্রভাবকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ও বর্তমানে পাহাড়পুর জাদুঘরে প্রদর্শিত দেবমস্তকের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন দেবমন্দিরের আলো অাঁধারী রহস্যময় পরিবেশে ঈশ্বরচিন্তায় ব্যাকুল ভক্তের অব্যক্ত মনোভাব পড়ে নিতে সক্ষম। এছাড়া প্রতিমাটির মাথায় মুকুট, ডিম্বাকৃতির মুখাবয়ব, টিকালো নাসিকা, পুরু নিম্নোষ্ঠ ইত্যাদি মিলিয়ে যেন একে গুপ্তযুগীয় প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রতিরূপ বলে মনে হয়। মহাস্থান জাদুঘরের ৪ নং শোকেসে প্রদর্শিত দেব মস্তকদ্বয়ের একটির দৃষ্টিতে নির্মল সারল্যের প্রকাশ পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত দেবচরিত্রের এবং অপর প্রতিমার তীক্ষ দৃষ্টি ও গম্ভীর মুখাবয়বে জ্ঞানের গভীরতা ও জাগতিক অনুভূতির উর্ধ্বে দেবত্বের অহমিকার প্রকাশ ঘটেছে। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত বোধিসত্বের মুখাবয়বে গুপ্তশিল্পি আভ্যন্তরীণ অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

মঙ্গলকোটে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ভাস্কর্যগুলো গুপ্ত যুগে পুন্ড্রবর্ধনভূক্তিতে ধ্রুপদী শিল্পচর্চার উচ্চমার্গের ইতিহাসকে তুলে ধরে। আমাদের এ অঞ্চলে পাথরের কোন উৎস ছিলো না। পাথরের ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হতো বিহারের রাজমহলের উৎসের উপর- যা ছিল ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। তাই শিল্পি পাথরের বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলো পোড়ামাটির মাধ্যমকে, আর অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় নির্মাণ করেছিলো কালোতীর্ণ সব ভাস্কর্য। অনেক ক্ষেত্রেই তা অতিক্রম করেছিল প্রস্তর ভাস্কর্যের শিল্প সুষমাকে। আর এ ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায় উত্তরবঙ্গে পাল যুগের এবং দেব, চন্দ্র আমলে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের পোড়ামাটির ফলকচিত্রে এবং খানিকটা ভিন্ন রুপে সুলতানি বাংলায়। [মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া]