বিবি পরী

বিবি পরী বাংলার মুগল সুবাহদার শায়েস্তা খান এর কন্যা ও বাদশাহ আওরঙ্গজেব এর পুত্র মুহম্মদ আজম এর স্ত্রী। বাংলাদেশ সরকারের কাটরার ওয়াকফ পরিদপ্তরে সংরক্ষিত শায়েস্তা খানের নিজস্ব অছিয়তনামা থেকেই শায়েস্তা খানের কন্যা হিসেবে বিবি পরীকে (ইরান দুখ্ত্ রহমত বানু) চিহ্নিত করা যায়। এক লক্ষ আশি হাজার টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে শাহজাদা আজমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এর পর বিবি পরী আজমের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। অহমবুরুঞ্জীতে লিপিবদ্ধ একটি পত্র থেকে শাহজাদার সঙ্গে ইরান দুখ্ত্ রহমত বানুর সুখি দাম্পত্য জীবন, অন্তঃপুরে তাঁর প্রভাব এবং সর্বোপরি রাজনীতিতে তাঁর বিচক্ষণ কর্মতৎপরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। শাহজাদা আজম কর্তৃক ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে আরম্ভ করা লালবাগ দুর্গএর নির্মাণ কাজ শায়েস্তা খান তাঁর দ্বিতীয় দফা সুবাহদারির সময়ে (১৬৭৯-৮৮ খ্রি.) চালিয়ে যান। কিন্তু ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে কন্যা বিবি পরীর অকাল মুত্যৃতে তিনি দুর্গ নির্মাণ একটি অশুভ লক্ষণ ভেবে বন্ধ করে দেন। দুর্গের অভ্যন্তরে মসজিদের পূর্ব দিকে বিবি পরীকে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খান কন্যার সমাধির উপর একটি সুদৃশ্য সৌধ নির্মাণ করেন।

বিবি পরীর সমাধিসৌধ লালবাগ দুর্গ অভ্যন্তরে ভবন তিনটির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বর্গাকার ভবন। ভবনের কেন্দ্রের বর্গাকার কক্ষটিতে রয়েছে বিবি পরীর সমাধি। সমাধিকক্ষটিকে ঘিরে রয়েছে আরও আটটি কক্ষ; দক্ষিণ-পূর্ব দিকের কক্ষটিতে আরেকটি ছোট সমাধি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এটি বিবি পরীর কন্যা সামসাদ বেগমের সমাধি। ভবনের চারকোণে রয়েছে চারটি কর্নার টাওয়ার। এগুলির শীর্ষে রয়েছে ছত্রী। একটির উপরে আর একটি পাথরের ব্লক বসিয়ে সমাধির উপর ছাদটি নির্মিত হয়েছে। এই পদ্ধতিটি হিন্দু স্থাপত্যে মন্দিরের ছাদ নির্মাণে ব্যবহূত হয়। কেন্দ্রীয় কক্ষের উপর অষ্টভুজাকার গম্বুজটি পেতলের পাত দ্বারা মোড়া।

বিবি পরীর সমাধিসৌধ

আদিতে এটি সোনার পাত দ্বারা মোড়া ছিল। সুস্পষ্ট একটি আয়তাকার ফ্রন্টনের মাঝে ন্যস্ত সুউচ্চ অ্যালকোভের (alcove) ভেতর দিয়ে একটি খিলানপথ রয়েছে। ফ্রন্টনের কেন্দ্রে রয়েছে প্যানেল। কেন্দ্রীয় অ্যালকোভের দুপাশে রয়েছে ছোট খিলানবিশিষ্ট অ্যালকোভ, যেগুলির মাঝে রয়েছে লিন্টেলসহ দরজা। ঢাকার অন্যান্য মুগল ভবনের মতো এটিরও বাইরের দিক প্লাস্টার করা।

কেন্দ্রীয় কক্ষের চার পাশের কক্ষগুলির দেওয়ালের নিচের এক মিটার অংশ মার্বেল পাথর দিয়ে মোড়া। কিন্তু কোণের চারটি কক্ষ সাধারণ প্লাস্টার করা। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে যে, এই কক্ষগুলির অভ্যন্তরে দেওয়ালের নিচের অংশ চকচকে ফুলেল টাইলস দ্বারা সজ্জিত ছিল। উত্তর-পূর্ব কোণের কক্ষটিতে টিকে থাকা আদি দুটি টাইলসের অনুকরণে বর্তমানে নতুনভাবে টাইলস লাগানো হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম মুখী ভূগর্ভস্থ দুটি পানির লাইন সম্ভবত একে অপরকে ছেদ করেছে। সম্ভবত ইমারতের সামনে প্রতি পার্শ্বে স্থাপিত ঝর্ণার সাথে এ লাইন যুক্ত ছিল। নতুন তিনটি সমাধির জায়গা সঙ্কুলানের জন্য পরবর্তীকালে দক্ষিণদিকের ঝর্ণাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।  [এ.কে.এম ইয়াকুব হোসাইন এবং আবদুল মমিন চৌধুরী]