বাসুদেব সার্বভৌম

বাসুদেব সার্বভৌম (আনু. ১৪৩০-১৫৪০)  সংস্কৃত পন্ডিত ও নৈয়ায়িক। নবদ্বীপে তাঁর জন্ম। খ্রিস্টীয় পনেরো শতকের তৃতীয় দশক থেকে ষোলো শতকের চতুর্থ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে তাঁর জীবনকাল অনুমিত হয়। তাঁর পিতা নরহরি বিশারদও ছিলেন তৎকালীন নদীয়ার একজন বিখ্যাত নৈয়ায়িক পন্ডিত।

জয়ানন্দের  চৈতন্যমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের  চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায় যে, বাসুদেব নবদ্বীপে পিতার নিকট শাস্ত্রাধ্যয়ন করেন এবং নব্যন্যায়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি মিথিলার বিখ্যাত পন্ডিত পক্ষধর মিশ্রের নিকটও ন্যায়শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং তাঁরই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘সার্বভৌম’ উপাধি লাভ করেন। বাসুদেব অসাধারণ স্মৃতিশক্তির সাহায্যে গঙ্গেশোপাধ্যায়ের চিন্তামণির আদ্যন্ত এবং ন্যায়কুসুমাঞ্জলির প্রায় সমগ্রাংশ কণ্ঠস্থ করেছিলেন। নবদ্বীপে একটি চতুষ্পাঠী খুলে তিনি কিছুদিন ন্যায়শাস্ত্রে অধ্যাপনা করেন।

বাসুদেব ছিলেন চৈতন্যদেবের বয়োজ্যেষ্ঠ। কথিত হয় যে, চৈতন্যদেবের ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের কারণে নদীয়ায় রাজভয় দেখা দিলে বাসুদেব পুরীতে চলে যান। সেখানে এক সময়  চৈতন্যদেব তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁদের মধ্যে বেদান্তবিষয়ে গভীর আলোচনা হয়। কৃষ্ণদাস চৈতন্যচরিতামৃতে (মধ্যলীলা, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ) এ সম্পর্কে লিখেছেন যে, বেদান্তের আলোচনায় চৈতন্যদেব বাসুদেবের মতামতকেই স্বীকার করে নেন।

বাসুদেব দীর্ঘকাল উৎকলরাজ পুরুষোত্তমদেব (১৪৬৫-১৪৯৬) এবং প্রতাপরুদ্রদেবের (১৪৯৬-১৫৩৯) সভাপন্ডিত ছিলেন। পরে তিনি কাশীধামে যান এবং আজীবন সেখানেই অবস্থান করেন। নবদ্বীপের নৈয়ায়িকশ্রেষ্ঠ  রঘুনাথ শিরোমণি ছিলেন তাঁর ছাত্র।

বাসুদেব মোট কতগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন তা জানা যায় না, তবে যেকটি পাওয়া গেছে সেকটির মধ্যে গঙ্গেশোপাধ্যায়ের তত্ত্বচিন্তামণির অনুমানখন্ডের টীকা অনুমানমণিপরীক্ষা নব্যন্যায়ের একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ। তাঁর অদ্বৈতমকরন্দ (প্রাপ্ত পুথির লিপিকাল ১৬২৯ খ্রি.) নামক বেদান্তশাস্ত্রীয় গ্রন্থে কর্ণাটরাজ কৃষ্ণরায় এবং কলিঙ্গরাজ প্রতাপরুদ্রের প্রসঙ্গ আছে। তিনি বলেছেন, প্রতাপরুদ্রের প্রধান সচিবের মনস্ত্তষ্টির জন্য তিনি এ গ্রন্থখানা রচনা করেন। তাঁর আর একখানি গ্রন্থ হলো তত্ত্বদীপিকা। এতে বৈষ্ণবদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁর আরও দুখানি গ্রন্থ হলো সমাসবাদ ও সার্বভৌমনিরুক্তি। কাশীর সরস্বতীভবনে শব্দমণিপরীক্ষা নামে যে গ্রন্থের  পুথি সংরক্ষিত আছে, কারও কারও মতে সেটিও বাসুদেবের রচনা। বাসুদেব চৈতন্য সম্পর্কে কিছু স্তোত্রও রচনা করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জলেশ্বর এবং পৌত্র স্বপ্নেশ্বরাচার্যও ছিলেন বিখ্যাত নৈয়ায়িক।  [সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী]