বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট  ঢাকার শেরে বাংলা নগরে অবস্থিত পাট ও পাটচাষ সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ঢাকায় প্রথম পাট গবেষণা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষি বিভাগের অধীনে ১৯০৪ সালে (স্যার) আর.এস ফিনলো কর্তৃক এর দায়িত্বভার গ্রহণের মাধ্যমে। ভারতীয় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি (Indian Central Jute Committee/ICJC) কর্তৃক ১৯৩৬ সালে ঢাকা ফার্মে প্রথম প্রতিষ্ঠিত পাট কৃষি গবেষণা ল্যাবরেটরি (Jute Agricultural Research Laboratory/JARL) থেকে ইনস্টিটিউট বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়।

ভারতীয় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি ১৯৩৬ সালে ঢাকায় কৃষি গবেষণা স্টেশনে পাট কৃষি গবেষণা ল্যাবরেটরি এবং কলকাতার টালিগঞ্জে পাট কারিগরি গবেষণা ল্যাবরেটরি (Jute Technological Research Laboratory/JTRL) প্রতিষ্ঠা করে। সে সময় ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত পাট কৃষি গবেষণা ল্যাবরেটরির গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল: গুণগতমান ও ফলন উভয় বিবেচনায় পাটগাছের উন্নয়ন; পাট চাষের পদ্ধতিসমূহের উন্নয়ন; পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ হ্রাস এবং পাট পচানোর পদ্ধতিসমূহের উন্নয়ন।

ভারতীয় পাটকল সমিতিও (Indian Jute Mills Association/IJMA) ১৯৩৭ সালে এর নিজস্ব একটি গবেষণা বিভাগ চালু করে। এটি পরবর্তীতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় পাটকল সমিতি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (Indian Central Jute Mills Association Research Institute/ICJMARI) রূপান্তরিত হয়। ১৯৩৬-৪৭ সময়কালে ব্যাপকভিত্তিক পাট গবেষণা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বহুবিধ কারণে ঢাকায় পাট গবেষণা কার্যক্রম অসুবিধার সম্মুখীন হয়। এর ফলে পাট গবেষণা সংক্রান্ত কার্যক্রম নতুনভাবে শুরু করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।

পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থনীতিতে পাটের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাকিস্তান সরকার তদানীন্তন ভারতীয় কেন্দ্রীয় পাট কমিটির আলোকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাট কমিটি (Pakistan Central Jute Committee/PCJC) গঠন করে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাট কমিটি ১৯৫১ সালে পাট গবেষণা ল্যাবরেটরিকে বর্তমান অবস্থানে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে পুনর্গঠিত করে। মূল পরিকল্পনায় (১৯৫১) পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের তিনটি প্রধান শাখা থাকার কথা: পাট বিষয়ক কৃষি গবেষণা; পাট বিষয়ক কারিগরি গবেষণা এবং পাট বিষয়ক বাজারজাতকরণ ও অর্থনৈতিক গবেষণা। ১৯৫১ সালে পাট বিষয়ক কৃষি গবেষণা নিয়ে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কার্যক্রম শুরু করে। দ্বিতীয় শাখা, পাট বিষয়ক কারিগরি গবেষণা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৩ সালে, আর পাট বিষয়ক বাজারজাতকরণ ও অর্থনৈতিক গবেষণা শাখা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ১৯৪৭-৭১ সময়কালে পাট গবেষণায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সাধিত হয় এবং পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট তার উদ্ভাবিত কিছু উচ্চফলনশীল জাত অবমুক্ত করে। ১৯৭১ সালের পর বাস্তবতার নিরিখে পাট খাতকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। পাট আইন (Jute Act), ১৯৪৭ সংশোধন করে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়। এ আইনে নির্দেশিত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটটের প্রধান লক্ষ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে: ১. পাট ও অন্যান্য তন্তুর কৃষি বিষয়ক, কারিগরি ও অর্থনৈতিক গবেষণা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও সহায়তা প্রদান; ২. উন্নত জাতের পাটবীজ উৎপাদন, পরীক্ষা ও সরবরাহ; ৩. পাট ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তন্তুফসল, পাটজাতদ্রব্য এবং এ সম্পর্কিত সামগ্রীর বিভিন্ন সমস্যার ওপর গবেষণা পরিচালনার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, পরীক্ষামূলক প্রকল্প ও খামার গড়ে তোলা; ৪. ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত পাটের নতুন জাতসমূহ প্রদর্শন এবং সেসব জাতের চাষাবাদের ওপর কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রকল্প এলাকা গড়ে তোলা।

পরবর্তীতে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এডিবি’র সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (Executive Committee of the National Economic Council/ECNEC) অনুমোদনক্রমে ১৯৭৬ সালে উফশি পাট বীজের বর্ধন ও বিতরণের জন্য একটি নতুন শাখা গঠন করা হয়। এভাবে ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নিম্নোক্ত শাখাগুলির মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে: পাটের কৃষি বিষয়ক গবেষণার জন্য পরিদপ্তর; পাটের কারিগরি গবেষণার জন্য পরিদপ্তর ও পাটবীজ পরিদপ্তর।

১৯৮৮ সালে পাটবীজ ডিরেক্টরেট বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে (Bangladesh Agricultural Development Corporation/ BADC) স্থানান্তরিত হয়। ফলে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে থেকে যায় দুটি কার্যকরী গবেষণা শাখা। উল্লেখ্য, পাট গবেষণা কার্যক্রম মূলত শুরু হয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯০৪ সালে। ১৯৪৭-৭১ সময়কালে এটি কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বিভাগ হিসেবে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে নবপ্রতিষ্ঠিত পাট মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে ১৯৮০ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে পুনরায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়। এসব পরিবর্তনের ফলে ইনস্টিটিউটের নির্দিষ্ট গবেষণা লক্ষ্যসমূহ পরিবর্তিত না হলেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ইনস্টিটিউটের অগ্রগতি অবশ্যই কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

গবেষণার ক্ষেত্র  বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বর্তমানে দুটি শাখা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে; একটি হলো পাটের কৃষি বিষয়ক গবেষণা এবং অন্যটি পাটের কারিগরি গবেষণা। এদুটি শাখা দুজন পরিচালকের অধীনে যথাক্রমে ১৯৫১ ও ১৯৬৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে।

ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী মহাপরিচালক, যাঁকে সহায়তা করেন দুজন পরিচালক। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অনুমোদিত জনবল ৫১৬ জন। এর মধ্যে ১৫৬ জন বিজ্ঞানী এবং ৩৫০ জন সহযোগী। ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ-তে অবস্থিত প্রধান কার্যালয়ে রয়েছে কয়েকটি বিভাগের অধীনে গবেষণাগারসমূহ।

পাট ও সংশ্লিষ্ট তন্তু ফসলের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের রয়েছে জিন ব্যাংক। মৌসুম বহির্ভূত সময়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য রয়েছে তিনটি গ্রীনহাউজ। সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনের জন্য ইনস্টিটিউটের রয়েছে একটি পরীক্ষামূলক মিল। পাটের কম্বল, গৃহের সাজসরঞ্জাম, পর্দা, মসৃণ কাপড় (finer union) ও মিশ্র বস্ত্র (blended fabrics) উৎপাদনের পরীক্ষামূলক সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি গবেষণা কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন পাট উৎপাদন অঞ্চলে বিস্তৃত। মানিকগঞ্জে রয়েছে কেন্দ্রীয় গবেষণা কেন্দ্র, যা সদর দপ্তর থেকে প্রায় ৫৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। চারটি আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে ফরিদপুর, রংপুর, কিশোরগঞ্জ ও চান্দিনায়। যশোরের মনিরামপুর ও নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে রয়েছে দুটি উপকেন্দ্র। এসব কেন্দ্র ছাড়াও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রসারের লক্ষ্যে দেশের পাট উৎপাদন অঞ্চলসমূহে চারটি খামার ব্যবস্থা গবেষণা সাইট এবং ৮টি সহায়তা কেন্দ্র (subvention centre) পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের মধ্যে পাটের কয়েকটি উন্নতজাত উদ্ভাবন, বীজনির্ভর প্রযুক্তি প্যাকেজ, পাট পচানোর উন্নত কৌশল এবং পাটের অাঁশের কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা যায়।  [এস.এম হুমায়ুন কবির]

আরও দেখুন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন; পাট