বাঁশফোড়

বাঁশফোড় লোকসম্প্রদায়বিশেষ। এরা ডোমদের একটি শাখা। বাঁশ ফাড়াই এবং বাঁশ দিয়ে কুলা, ডালা, চালুনি, সরপোস (ঢাকনা) ইত্যাদি সরঞ্জাম তৈরি করে বলেই হয়তো এদেরকে বাঁশফোড় নামে অভিহিত করা হয়। বাঁশের কাজে এদের সুন্দর শিল্পিমনের পরিচয় পাওয়া যায়। দৈহিক গঠনে এরা অস্ট্রিক জাতীয় এবং  সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা ও মালপাহাড়িদের সমগোত্রীয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা যায়। কোন কোন অঞ্চলে এদেরকে  ডোম বলেও আখ্যায়িত করা হয়।

বাঁশফোড়দের একটি শ্রেণির নাম কোল। এরা যাযাবর জাতীয়; এদের নির্দিষ্ট আবাসস্থল ছিল না। বাঁশের কাজের পাশাপাশি পাখি শিকার করে বলে এদেরকে ব্যাধ বলেও অভিহিত করা হয়। এরা বেদে সম্প্রদায়ের মতো কখনও কখনও তাঁবুতে বাস করে। ইদানীং বাঁশফোড়দের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়। এরা কৃষিকাজ করে না, তবে অফিস-আদালতে এদের নিম্নমানের চাকরি করতে দেখা যায়। এদের গায়ের রং ঘন কালো কিংবা শ্যামবর্ণের; ইদানীং অবশ্য ভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিবাহের ফলে গায়ের রং মিশ্র বর্ণের হতে দেখা যায়।

অতীতে বাঁশফোড়দের কেশ ঊর্ণাবৎ হলেও বর্তমানে এমন দেখা যায় না। কারও কারও ঠোঁট পুরু এবং উল্টানো হলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা মোটামুটিভাবে সাধারণ বাঙালির মতোই। এরা খর্বকায় এবং চ্যাপটা নাকের অধিকারী। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে বাঁশফোড়দের বিবাহে মায়ের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত; তবে বর্তমানে পিতার মতামতও গ্রহণ করা হয়। অতীতে বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যাই বর নির্বাচন করত, তবে বিবাহের পূর্বে গোত্রগুরুর সঙ্গে বর-কনের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে আলোচনা এবং তাঁর অভিমত গ্রহণ করা হয়। সাধারণত বরের মাতুল বিবাহের প্রস্তাব করেন এবং উভয় পরিবারের পিতা-মাতার একত্রে মদ্যপানাদির মাধ্যমে সেই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। বিবাহে কন্যাপণ দেওয়ার রীতি আছে; কেউ তা দিতে অসমর্থ হলে পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাকে কন্যার বাড়িতে অবস্থান করতে হয়। বাঁশফোড়দের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে। তারা অস্পৃশ্য হলেও হিন্দু মতাবলম্বী এবং হিন্দু ধর্মানুসারেই বিবাহের আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। ছাদনাতলায় একটি মাটির বেদিতে বিবাহের অনুষ্ঠান হয়। বেদির ওপর বটবৃক্ষ বা শিমুল গাছের একটি শাখা রাখা হয় এবং বেদির মধ্যস্থলে মাটির পাত্রে থাকে গঙ্গাজল। বর-কনে উভয়েই গঙ্গাজলে হাত ডুবিয়ে পরস্পর মালাবদল করে।

বাঁশফোড়দের মধ্যে একবিবাহই প্রচলিত, তবে ক্ষেত্রবিশেষে বহুবিবাহও হতে পারে। কোন স্ত্রীলোক অবৈধ প্রণয়ে আসক্ত হলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার সাজা হয় না। সমাজে তালাকের ব্যবস্থা আছে, বিশেষ করে স্ত্রীর অবৈধ প্রণয়ের কারণে স্বামী তাকে তালাক দিতে পারে। তাদের মধ্যে পুনর্বিবাহেরও প্রচলন আছে; একে বলা হয় ‘সাংগা’। বিধবাবিবাহের প্রচলন আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে দেবরের সঙ্গেও বিবাহ হয়। বিধবার পুত্র-কন্যা থাকলে মৃত পিতার সম্পত্তিতে তাদের অংশীদারিত্ব থাকে।

বাঁশফোড়রা মৃতদেহ দাহ করে কিংবা কবর দেয় এবং হিন্দুরীতি অনুযায়ী তার শ্রাদ্ধ করে। ভাত, মাছ ও মাংস তাদের প্রধান খাদ্য; তবে গো-মাংস তাদের জন্য নিষিদ্ধ, কারণ গরুকে তারা দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। তারা শূকরের মাংস খায়।  শিব তাদের প্রধান দেবতা। তারা দুর্গাপূজাও করে। এছাড়া সর্পদেবতা হিসেবে  মনসা এবং বসুমাতাজ্ঞানে পৃথিবীকেও পূজা করে। এসব পূজায় তারা ওঝার শরণাপন্ন হয়।  [আনোয়ারুল করীম]