বরকান্তা

বরকান্তা (বড়-কামতার বিকৃত রূপ)  কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার অন্তর্গত একটি পুরানো গ্রাম। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে এর অবস্থান। গ্রামটিকে সমতট এর (সাত শতক) খড়গ রাজ্যের রাজধানী  করমান্ত বাসক এর সাথে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। থানা সদর দপ্তরের নিকটে রাস্তার ধারে অবস্থিত দৃশ্যমান সুউচ্চ জোড়া চন্ডী মন্দিরের কারণে অঞ্চলটি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। বলা হয়, প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে ত্রিপুরার এক রাজা একটি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে মন্দির দুটি নির্মাণ করেছিলেন।

গ্রামটিতে কিছু প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ছাড়াও (কেবলমাত্র ভিত্তি দৃশ্যমান) বেশ কিছুসংখ্যক বড় আকারের পুরানো পুকুর আছে, যার একটির সন্নিকটে সেনযুগের ’শিবলিঙ্গভূষিত মহামায়া মুড়া’ নামক প্রায় ৮ মিটার উঁচু আকর্ষণীয় একটি ঢিবির চিহ্ন ছিল (বর্তমানে লুপ্ত)। ক্ষীর নদী (প্রাচীন ক্ষীরোদা নদীর স্মারকস্বরূপ) নামক একটি খাল গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে মেঘনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

বেশ কিছুসংখ্যক প্রাচীন মূর্তি এ গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলির মধ্যে হিন্দু দেবতা সূর্যের পুত্র রেবন্তের একটি বৃহদাকার বিরল প্রস্তরমূর্তি রয়েছে। এটি বাংলায় আবিষ্কৃত এ ধরনের একমাত্র উদাহরণ। ১৯১২ সালে স্বল্পমেয়াদি পরিদর্শনকালে এন.কে ভট্টশালী বরকান্তার অভ্যন্তরে এবং চারপাশে নিম্নোক্ত প্রাচীন বৌদ্ধমূর্তিগুলি আবিষ্কার করেন: (ক) বরকান্তার প্রায় ১.৬ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত বেলাস থেকে খোদিত অবলোকিতেশ্বরের একটি বিশাল মূর্তি, (খ) বরকান্তার প্রায় ৮ কিমি উত্তর-পূর্বে বিহার মন্ডলের নিকটস্থ সুভাপুর থেকে বজ্রপাণি বোধিসত্ত্ব ও হেরুক-এর পূর্ণাকৃতির মূর্তিসমূহ, (গ) বিহার মন্ডলের অতি নিকটে বাঘেরপার থেকে ধ্যানী বুদ্ধের একটি বিরাটাকার মূর্তি, (ঘ) বরকান্তার প্রায় ৬ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পিওর থেকে মারীচী দেবীর একটি বিশালাকৃতির মূর্তি এবং (ঙ) এখনও বিহারমন্ডলে পূজিত বম্ভলের একটি মূর্তি।

নটরাজ শিবের খোদিত একটি বড় মূর্তির অধিকতর রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে বিহারমন্ডলের ঠিক পূর্বদিকস্থ ভারেল্লায়। শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, চন্দ্ররাজা শ্রী লড়হচন্দ্রদেবের রাজত্বকালের আঠারো বছরে কর্মান্তের জনৈক শাসক কুসুমদেবের পুত্র মূর্তিটি উৎসর্গ করেন। এ আবিষ্কার থেকে ভট্টশালী বরকান্তার চারপার্শ্বস্থ এলাকার প্রাচীন বৌদ্ধ প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং তিনি বরকান্তাকে খড়গ রাজধানী কর্মান্ত বাসকের সঙ্গে শনাক্ত করেন।

ময়নামতীর প্রত্নসম্পদ আবিষ্কারের পর এবং সাম্প্রতিককালের আবিষ্কার ও বিপুল সংখ্যক লিপি পাঠোদ্ধারের ফলে পন্ডিতগণ ভট্টশালীর শনাক্তীকরণকে এখন আর নিশ্চিত বলে গ্রহণ করেন না। ‘কান্ত’ কথাটি কর্মান্ত-এর বিকৃত রূপ হতে পারে। কিন্তু অন্য কোন প্রমাণের অভাবে শুধু এ নামটিই উক্ত শনাক্তীকরণের জন্য খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। কুমিল্লা জেলার এ মধ্যবর্তী স্থানে একই নামের অন্তত ৬টি গ্রাম এবং ‘জয়কান্ত’যুক্ত (ইতস্তত ছড়ানো সমতুল্য বৌদ্ধ মূর্তিসহ) তিনটি গ্রাম আছে। এ গ্রামগুলির প্রত্যেকটিই বিলুপ্ত শহরের প্রতীকরূপে সমান দাবি করতে পারে। গ্রামের মধ্যস্থলে অবস্থিত মহামায়া মুরা কোন প্রাচীন ঢিবি নয়। বরকান্তা এবং তার চতুর্দিক থেকে উদ্ধারকৃত প্রাচীন বৌদ্ধমূর্তিগুলি খুবই সমৃদ্ধ ও কৌতূহলোদ্দীপক। কিন্তু এগুলির কোনটিকেই খ্রিস্টীয় দশম শতকের পূর্ববর্তী সময়ের বলে নির্দিষ্ট করা যায় না। সুতরাং যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, বরকান্তা সাত শতকের খড়গ রাজধানী কর্মান্তবাসক নয়।

এ বিলুপ্ত শহরের ধ্বংসাবশেষ কোথায় তা জানা যায় না। কিন্তু লড়হচন্দ্রের সমকালীন ভারেল্লা মূর্তিলেখ থেকে সংগৃহীত ‘কর্মান্ত’ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, বরকান্তা অঞ্চলের কোথাও, সম্ভবত বরকান্তাতেই, খড়গ বংশীয় রাজাদের কর্মান্তবাসকের উত্তরসূরি কর্মান্তের অবস্থিতি ছিল কি না।  [এম হারুনুর রশীদ]