বদ্বীপ

বদ্বীপ (Delta)  নদীর মোহনায় কর্দম, পলি ও বালির সঞ্চয়ন, যার আকৃতি মাত্রাহীন ‘ব’ অক্ষরের মতো। মোহনায় নদীর স্রোতের বেগ এতই হ্রাস পায় যে, নদীবাহিত তলানী আর পরিবাহিত হতে না পেরে নদীর মোহনায় সঞ্চিত হয় এবং চর জেগে ওঠার ফলে নদীস্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চরের দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে চরের দুই প্রান্ত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ত্রিকোণাকার আকৃতি প্রাপ্ত হয়। তবে যদি উপকূল ঢালু হয়ে নেমে যায় অথবা নদীবাহিত তলানীকে বাধা প্রদান করার জন্য সমুদ্রস্রোত পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন না হয় তবে কোন বদ্বীপ গঠিত হতে পারে না। বদ্বীপ গঠনকালে প্রথমে মোটা পলিকণা এবং পরে সূক্ষ্মকণাসমূহ স্থির হয়। এই জটিল প্রক্রিয়ায় বদ্বীপ গঠনকালে প্রধান নদীখাত একাধিক নদীখাত, শাখানদী, বিচ্ছিন্ন উপহ্রদ, জলাভূমি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলধারার সমন্বয়ে গঠিত নেটওয়ার্কে বিভক্ত হয়। অধিকাংশ বদ্বীপই জটিল এবং বহুমাত্রিক, তবে একটি সাধারণ বদ্বীপে তিনটি প্রধান ধরনের স্তর চিহ্নিত করা যায়: তলদেশীয় স্তর (bottomset beds), সম্মুখদেশীয় স্তর (foreset beds) এবং পৃষ্ঠদেশীয় স্তর (topset beds)। সাধারণত বদ্বীপের আকৃতি গ্রীক অক্ষর ডেল্টা বা বাংলার মাত্রাহীন ‘ব’ অক্ষরের মতো হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ আকৃতি ও আকারের বদ্বীপও দেখা যায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূখন্ড এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু ভূখন্ডে বিস্তৃত বঙ্গীয় বদ্বীপ ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশে অবস্থিত। পুরাতন এবং নবীন বদ্বীপীয় সমভূমিসমূহ বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ ভূখন্ড জুড়ে রয়েছে এবং অবশিষ্ট ৩৫ ভাগ ভূখন্ড প্লাবন সমভূমি এবং পাহাড়ি ভূমি দ্বারা গঠিত। বঙ্গীয় বদ্বীপ পৃথিবীর সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলসমূহের মধ্যে একটি। বঙ্গীয় অববাহিকার অধিকাংশই বঙ্গীয় বদ্বীপ এবং হিমালয় পর্বতমালার উত্থানের ফলে সৃষ্ট ভূত্বকীয় ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া হিসেবে বঙ্গীয় বদ্বীপের ধীরে ধীরে অবনমন ঘটছে এবং বর্তমানে পুরু মায়োসিন-প্লায়োসিন-প্লাইসটোসিন বদ্বীপীয় অবক্ষেপের নিচে চাপা পড়ে আদি বঙ্গীয় উপবদ্বীপ তলানীর অন্তঃকেলাস পানির অপসারণ।

গঙ্গা এবং পদ্মা নদীর প্রবাহ বরাবর দক্ষিণে ফেনী নদীর নিম্ন প্রবাহ পর্যন্ত একটি রেখা অঙ্কন করলে দক্ষিণপূর্বে যে ভূপ্রকৃতি অবশিষ্ট থাকে তাকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র (যমুনা)-মেঘনা বদ্বীপ বলে আখ্যায়িত করা হয়। বঙ্গীয় বদ্বীপকে মৃতপ্রায় (moribund), অপরিণত (immature), পরিণত (mature) এবং সক্রিয় (active) বদ্বীপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে গঙ্গা নদীর দক্ষিণে মৃতপ্রায় বদ্বীপের অবস্থান, যেখানে উপনদীসমূহ অত্যধিক পলিভরাটের শিকার এবং নদনদীর গতিপথ আবদ্ধ হয়ে অসংখ্য অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। যশোর, কুষ্টিয়া এবং ফরিদপুর মৃতপ্রায় বদ্বীপাঞ্চলে অবস্থিত। মৃতপ্রায় বদ্বীপের দক্ষিণে অপরিণত বদ্বীপ অবস্থিত। এই এলাকা প্রধানত সমুদ্রতট এবং জোয়ারভাটা প্রভাবিত ভূমি নিয়ে গঠিত। অপরিণত বদ্বীপ জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। এই বদ্বীপের ভূঅবনমনের মাত্রা অধিক। দক্ষিণবঙ্গের কেন্দ্রভাগ জুড়ে পরিণত বদ্বীপ অবস্থিত। পটুয়াখালী, বরগুনা প্রভৃতি এলাকা পরিণত বদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত যেখানে এলাকাসমূহ ভূপ্রকৃতিগতভাবে এবং জোয়ারভাটার প্রভাবের দিক থেকে পার্থক্য প্রদর্শন করে থাকে। মেঘনা নদীর মোহনা জুড়ে প্রধানত বদ্বীপের সক্রিয় অংশের অবস্থান। ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চলে এখনও বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়া চলছে। নিয়মিত প্লাবন এবং চর ও উপকূলবর্তী দ্বীপ সক্রিয় বদ্বীপের বৈশিষ্ট্য।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

আরও দেখুন বঙ্গীয় বদ্বীপ