বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ

বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ  অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা সংগঠন হিসেবে ১৯১২ সালের ২ মার্চ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। সভাপতি হন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ এবং সম্পাদক সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী  ও জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। কংগ্রেসদলীয় তিন মুসলিম নেতা আবুল কাসেম, ওয়াহিদ হোসেন ও আবদুর রসুল যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলায় কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের শাখা প্রতিষ্ঠা ছিল রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ যাতে বাংলার মুসলমানগণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মোকাবেলায় বঙ্গভঙ্গ রদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারে। দলের উদ্বোধনী সম্মেলনে মফস্বলের প্রতিনিধিগণ কংগ্রেস আন্দোলনের কাছে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের নতজানু মনোভাবের এবং পূর্ববাংলা ও আসামের মুসলিমদের দাবি উপেক্ষা করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। তারা পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের বিপক্ষে কংগ্রেসের আন্দোলনের মোকাবেলায় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শনেরও প্রতিবাদ করেন। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল, হিন্দু জনগোষ্ঠী যখন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল তখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নিস্ক্রিয় ছিল। সে কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠন তখন ছিল একদিকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এবং অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সমসাময়িক সংবাদমাধ্যম এবং জনমত নবগঠিত লীগকে পূর্ববাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ গঠনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত উর্দুতে নয় বরং বাংলায় লেখা হয়েছিল। ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত লেখা হয়েছিল উর্দুতে।

নওয়াব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এ.কে ফজলুল হক। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রশ্নে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ভাগ হয়ে যায়। এর একটি দল মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করে। অন্য দলের নেতা এ.কে ফজলুল হক এবং আবুল কাসেম আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। এ কারণে ফজলুল হক এবং আবুল কাসেমকে দলচ্যুত করা হয়। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যজোট চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট গঠন করে। এই চুক্তি ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের শীর্ষ পদক্ষেপ।

১৯৩৭ সালের নির্বাচন এবং মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে, বিশেষত ফজলুল হক যখন তাঁর কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থকদের নিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪০ সালের মধ্যে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। ১৯৪০ সালের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে। তখন থেকে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মাধ্যমেই বাংলার রাজনীতিতে ভূমিকা রাখে। এ দলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ হলো যে, ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ২২ টি আসনের মধ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ১৮ টি আসন লাভ করে। ১৯৪০ সাল থেকে বাঙলার মুসলিম রাজনীতি বলতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাসেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের রাজনীতিকেই বোঝাত।  [সিরাজুল ইসলাম]