প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা (Primary Healthcare) স্থানীয় পর্যায়ে গণমানুষের জন্য সহজলভ্য ও মৌলিক চিকিৎসাসেবাই সাধারণভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলে পরিচিত। সহজ কথায়, মানুষ যেসকল উপকরণ ও কৌশল অবলম্বন করে দৈনিন্দন স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলা যায়। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি নতুন নয়। রোগব্যাধির সঙ্গে মানুষের পরিচয় যখন থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শুরুটা সেখান থেকেই। তাই মানুষের দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতালব্ধ স্বাস্থ্যজ্ঞান এধারণাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তবু আধুনিক স্বাস্থ্যচর্চার স্তরবিন্যাসে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি অতিসম্প্রতি, কেবল ১৯৭৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উপর আলোকপাত করার জন্য আয়োজিত ঐ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে স্বাস্থ্যাধিকারকে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যগত মান অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই সম্মেলনের পর থেকে প্রাথমিক স্বাস্যসেবার ধারণাটির ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটতে থাকে।

আলমা আতা ঘোষণায় বলা হয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একটি দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট সামাজিকগোষ্ঠির মৌলিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে, বিশেষ করে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের বিভিন্ন খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ভূমিকা রাখে। আরো বলা হয়, এই ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসমস্যা সমাধানে ব্যক্তি ও সামাজিক অংশগ্রহণের উপর জোর দেয় এবং মৌলিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনায় জনসমষ্টির স্বাস্থ্যজ্ঞান, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মী, প্রথাগত চিকিৎসক ও দেশিয় চিকিৎসাজ্ঞানের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। আলমা আতা ঘোষণায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের সকল জাতি ও দেশকে তাদের নিজস্বস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষার অভিজ্ঞতার আরেঅকে জনগণের সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার কল্যাণের জন্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আহবান জানানো হয়।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি অপরিহার্য অংশ যা ব্যক্তি বা পরিবার তার নিজস্ব সামাজিক গোষ্ঠির পছন্দ ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে পেয়ে থাকে। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবার এই ধারণাটি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, রোগ প্রতিরোধ, আরোগ্যলাভ এবং পুনর্বাসনের মত স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি স্থানীয় সামাজিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দেশে দেশে এর ভিন্নতা দেখা গেলেও সাধারণত সকল দেশের মৌলিক স্বাস্থ্যশিক্ষা, পুষ্টি মানোন্নয়ন, নিরাপদ নিরাপদ পানীয়জল সরবরাহ, মৌলিক পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থাপনা, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রতিষেধক টীকাদান, স্বল্প আঘাত ও সাধারণ অসুস্থতা, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ এবং মহামারী প্রতিরোধে এর প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত।

স্বাস্থ্যসমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিরোধে মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার শরণাপন্ন হয়। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মৌলিক ধারণা থেকে মানুষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে চিকিৎসা গ্রহণ করে এবং অসুস্থতার মাত্রানুসারে পরবর্তী মাধ্যমিক ও উচ্চপর্যায়ের বিশেষায়িত চিকিৎসা গ্রহণে উদ্যোগী হয়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সাধারণত বিশেষজ্ঞ নির্দেশিত কোনো ঔষধের প্রয়োগ এবং প্রয়োজন হয় না। ফলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এই ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যবিষয়ে স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষিত ব্যক্তিবিশেষ, প্রথাগত চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজ ও দেশিয় চিকিৎসাসহ ব্যস্থাপকসহ হাকিম-কবিরাজ মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে স্বেচ্ছাসেবক, পরিবারপ্রধান এবং স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিগণকেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় পরামশর্কের ভূমিকায় দেখা যায়।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সমাজভ্যন্তরে বিকশিত ও লালিত হয় বলে এই ধারণাটি স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে এবং একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশও বটে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সার্বজনীন স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনে তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ছত্রছায়ায় কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। ফলে মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্যসূচকের উন্নতি ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখে। ফলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করণের উদ্যোগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মূখ্যভূমিকা পালন করতে পারে। বৃহত্তর জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্য সেবার প্রাথমিক স্তরে স্বল্পব্যয়ী ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় বিশেষত উন্নয়নশীল দেশসমূহে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের অধিকাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নীত হলে একটি দেশের জনস্বাস্থ্যের মানও বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র এবং পরিধি কাঠামোবদ্ধ করা গেলে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবার সাফল্য অর্জন সহজতর হবে। [মোঃ জাহাঙ্গীর আলম]