পাদশাহনামা
পাদশাহনামা সরকারি উদ্যোগে রচিত সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের অন্যতম ইতিহাস গ্রন্থ। শাহজাহান তাঁর পিতামহ আকবরএর অনুকরণে দরবারি ঐতিহাসিক নিয়োগ করে স্বীয় রাজত্বের ইতিহাস রচনার প্রয়াস পান। পর্যায়ক্রমে তিনজন ঐতিহাসিক তিনটি পাদশাহনামা প্রণয়ন করেন। সর্বপ্রথমে পাদশাহনামা রচনা করেন মুহম্মদ আমীন কাজভিনি। তাঁর রচিত পাদশাহনামা সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস বর্ণিত আছে। দ্বিতীয় পাদশাহনামা রচনাকারী হলেন জালালুদ্দীন তবাতবাই। কিন্তু এতে শাহজাহানের রাজত্বের ৫ম থেকে ৮ম বছর অর্থাৎ মাত্র চার বছরের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। তৃতীয় দরবারি ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরী শাহজাহানের রাজত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পাদশাহনামা রচনা করেন। তাঁর রচিত পাদশাহনামায় সম্রাটের রাজত্বের ২০ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়। তিনি ১৬৪৮ সালে গ্রন্থটি রচনা শেষ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছাত্র মুহম্মদ ওয়ারিস শাহজাহানের রাজত্বের সমাপ্তি পর্যন্ত ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করেন।
আব্দুল হামিদ লাহোরীর পাদশাহনামা একটি বিপুল গ্রন্থ। এতে ১৬৬২টি মুদ্রিত পৃষ্ঠা এবং প্রতি পৃষ্ঠায় ২২টি করে লাইন আছে। বইটির প্রথম অর্ধেক, অর্থাৎ শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস কাজভিনির পাদশাহনামায়ও পাওয়া যায়, তবে লাহোরীর গ্রন্থে অধিক বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের জন্য লাহোরীর গ্রন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার কিছু কিছু বড় ঘটনা এখানে মোটামুটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এরূপ প্রথম ঘটনাটি হলো হুগলি থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়ন। তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের এত বেশি উন্নতি হয় যে হুগলীতে তাদের ক্ষমতা দেশিয় আধিপত্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সুলতানি যুগের সাতগাঁওয়ের জায়গায় হুগলি বন্দরের উত্থানকে লাহোরী খুব সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনার সঙ্গে পর্যালোচনা করেন। সাম্রাজ্যের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কোচবিহার ও আসামে মুগল যুদ্ধ-বিগ্রহের বিবরণও তিনি খুব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। এ বিবরণগুলি পর্তুগিজ লেখায় (হুগলি থেকে পর্তুগজিদের বিতাড়নের উপর) অথবা আসাম বুরুঞ্জিতেও (মুগল কোচ এবং মুগল-অহোম সম্পর্কের উপর আসামের স্থানীয় ইতিহাস) পাওয়া যায়, কিন্তু পাদশাহনামায় প্রাপ্ত বিবরণ অধিকতর বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা লাহোরীর আলোচনায় এসেছে তা হলো বাংলার উপকূলীয় জেলাগুলিতে আরাকান থেকে পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহতকরণ। তখন ইসলাম খান (মাশহাদী) বাংলার সুবাহদার (১৬৩৫-৩৯)। এ সময়ে তিনি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সমস্যা সামলানোতে ব্যস্ত ছিলেন। যুদ্ধ-বিগ্রহের পর তিনি শত্রু পক্ষকে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এদিকে আরাকানিরা সুবাহদারের এই ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে এক শক্তিশালী নৌবহর বাংলার উপকূলে প্রেরণ করে। যদিও এ সংঘর্ষের মূল কারণ ছিল আরাকানের রাজা এবং তাঁর নিয়োজিত চট্টগ্রামের গভর্নরের মধ্যকার গৃহবিবাদ। আইনানুগ রাজাকে হত্যা করে আরাকানের রাজা অবৈধভাবে সিংহাসন অধিকার করেন। চট্টগ্রামের গভর্নর ছিলেন নিহত রাজার পিতৃব্য। অতএব তিনি বিদ্রোহী হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে যুদ্ধে গভর্নর পরাজিত হয়ে ঢাকায় মুগল সুবাহদারের আশ্রয় নেন। প্রতিশোধ নেওয়ার মানসে আরাকানরাজ মুগল অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ চালান। সুবাহদার ইসলাম খান ত্বরিত-পদক্ষেপ নেন এবং আরাকানি হুমকি মোকাবেলায় তাঁর নৌবহর পাঠান। এতে আরাকানিরা ভীত হয়ে নিজ রাজ্যে ফিরে যায়। এ ঘটনার ইতিহাস পাদশাহনামা রচয়িতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। [আবদুল করিম]
গ্রন্থপঞ্জি Abdul Haimd Lahori, Padshahnama, Bibliotheca Indica, Calcutta, 1867-68; JN Sarkar (ed) History of Bengal, II, Dhaka University, 1948; A Karim, History of Bengal, Mughal Period, II, Rajshahi, 1995.