পরীবাগ

পরীবাগ ঢাকার নওয়াবদের বাগানবাড়ি। ঢাকার শাহবাগের উত্তরে এর অবস্থান। এলাকাটি আজও পরীবাগ নামে পরিচিত। শাহবাগের বর্ধিতাংশ হিসেবে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ ১৯০২ সালে বাগানবাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। নওয়াব সলিমুল্লাহ তাঁর অন্যতম প্রিয় স্ত্রী পেয়ারী বেগমের নামে এ বাগানবাড়ির নামকরণ করেছিলেন বলে জানা যায়। আবার অনেকে নওয়াব খাজা আহসানুল্লাহ এর কন্যা পরীবানুর নামে এর নামকরণ হয়েছিল বলেও মনে করেন। পরীবাগের কিছু অংশ নওয়াব আহসানুল্লাহর সময় ক্রয়কৃত গোবিন্দপুর পরগনার অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তি ছিল। পরবর্তী সময়ে নওয়াব সলিমুল্লাহ রোয়াইল বাবু নামের জনৈক হিন্দু জমিদারের নিকট থেকে ১৪ বিঘারও অধিক জমি ক্রয় করে এর সঙ্গে যুক্ত করেন।

খানাখন্দে ভরা পরীবাগ এলাকাটি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকত। নওয়াব সলিমুল্লাহ এখানে কয়েকটি পুকুর খনন করেন এবং খানাখন্দগুলি ভরাট করে বাগ-বাগিচায় পরিণত করেন। শাহবাগ থেকে প্রবাহিত খালটি পরীবাগের ভেতর দিয়ে পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে রমনা পার্কের দিকে চলে যেত। পরীবাগের দক্ষিণ দিকে নওয়াবদের শাহবাগ বাগানবাড়ির উত্তর সীমানা দেয়াল আগে থেকেই ছিল। এছাড়া এর পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকে অনুরূপ পাকা দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছিল। নওয়াব সলিমুল্লাহ পরীবাগে অনেক দালানকোঠা তৈরি করেছিলেন।

এ বাগানবাড়ির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ইমারত ছিল পরীবাগ হাউস নামে একটি বৃহদাকার একতলা ভবন। ভবনটির চারদিক দিয়ে খিলান সহযোগে নির্মিত বৃহৎ বারান্দাগুলির দৃশ্য খুবই সুন্দর। ভবনটির দক্ষিণ দিকে খোলা চত্বরের মাঝখানে মার্বেল পাথরের তৈরি সুন্দর একটি অষ্টকোণাকৃতির চন্দ্রাতপ ছিল। ভবনটির পূর্ব দিকে বড় দিঘির পাড়ে ছিল  হাম্মামখানা এবং এর অদূরে দিঘির উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি কৃত্রিম টিলা। এছাড়া এখানে ছিল ছোট ছোট আরও কয়েকটি ভবন এবং বারোদুয়ারী নামে একটি হাওয়াখানা। হরেক রকম ফুল আর ফলের গাছগাছালি দ্বারা পরীবাগকে নয়নাভিরাম করে সাজানো হয়েছিল।

পরীবাগের পশ্চিম সীমানা দেয়ালের সঙ্গে ১৯০৫ সালে নওয়াব সলিমুল্লাহ একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বহুবার সংস্কারের ফলে মসজিদটির আদিরূপ বদলে গেছে। ঢাকার নওয়াবদের ওয়াকফ এস্টেটের আয় থেকে এখন মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় নির্বাহ করা হয়।

পরীবাগে নওয়াব সলিমুল্লাহর একটি দুগ্ধ খামার ছিল। খামারটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সৈয়দ আব্দুর রহিম নামে এক সাধক পুরুষ। তিনি পরীবাগের শাহসাহেব নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁর খানকাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। পরীবাগের উত্তর সীমানা দেয়াল সন্নিহিত তাঁর মাযারটি আজও ভক্তদের ভিড়ে মুখরিত।

পরবর্তীকালে ঢাকার নওয়াবদের সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেলে এ বাগানবাড়ির অধিকাংশই নওয়াবজাদি আমিনা বানু ও বিলকিস বানুর উত্তরাধিকারীদের অধীনে চলে যায়। ১৯৫২ সালে ঢাকার নওয়াবদের জমিদারি সরকার অধিগ্রহণ করলে নওয়াব খাজা হাবিবুল্লাহ  আহসান মঞ্জিল ছেড়ে পরীবাগে চলে আসেন। এখানে গ্রীণ হাউস নামে একটি বাড়ি তৈরি করে তিনি শেষ জীবন কাটান। তাঁর নামে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পরীবাগের একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে নওয়াব হাবিবুল্লাহ রোড। পাকিস্তান আমলে আহসান মঞ্জিলের চেয়ে পরীবাগেই ঢাকার নওয়াব পরিবারের অধিক সংখ্যক খ্যাতিমান ব্যক্তিরা বাস করতেন। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আবদুস সেলিম (পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য), খাজা শাহাবুদ্দীন, খাজা হাসান আসকারী, সৈয়দ সাহেবে আলম প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পরীবাগের উত্তরেই খাজা নাজিমউদ্দীন ও খাজা শাহাবুদ্দীন তাঁদের বাসভবন নির্মাণ করেছিলেন। ঢাকার নওয়াবদের বংশধরগণের মধ্যে এখনও কেউ কেউ পরীবাগে বসবাস করেন।  [মোহাম্মদ আলমগীর]