নোয়াবাদ

নোয়াবাদ আঠারো ও উনিশ শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনাবাদি জঙ্গলসমূহ আবাদের আওতায় আনার কার্যক্রম। বাংলার রাজস্ব ইতিহাসে নোয়াবাদ বলতে (প্রায়োগিক দিক থেকে) বোঝানো হয় সেই জমিকে যা সর্বপ্রথম চাষের অধীনে আনা হয়। এটি চট্টগ্রামের কৃষি ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য। চট্টগ্রামের অধিকাংশ জমি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। কৃষি সম্প্রসারণের জন্য মুগল সরকার সবসময় অনাবাদি জমি আবাদের জন্য উৎসাহিত করত। চট্টগ্রামে জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি ভূমিতে রূপান্তরকে বলা হতো নোয়াবাদ (নও-আবাদ) অর্থাৎ নতুন আবাদ। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে আসে। তখন থেকে কোম্পানি সরকার কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির নীতি গ্রহণ করে। জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি কৃষিযোগ্য করার জন্য চাষিকে পাট্টা প্রদান করা হতো। আবাদকার্য ত্বরান্বিত করার জন্য জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব দাবি করা হতো না। এই বিশেষ ব্যবস্থাটি পরিচিত ছিল পাট্টাদারী হিসেবে। পাট্টাদার কৃষক মূলত অনাবাদি জমি কর্ষণ করে জীবন ধারণ করে, তার কাছ থেকে অন্যকোন ধরনের কর দাবি করা হতো না। আবাদকৃত নতুন জমি কিছুকাল পরপর জরিপ করা হতো এবং আবাদি জমির সম্পদ অনুয়ায়ী নতুনভাবে কর আরোপ করা হতো। আবাদ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বদানকারী উদ্যোক্তারা অবশেষে নোয়াবাদ তালুকদার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করত। কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি আবাদ করার কৃতিত্ব দিয়ে অনেক উদ্যোক্তাকে জমিদার হিসেবেও সনদ দেয়া হতো। এমন উৎসাহ নোয়াবাদ রায়তের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। তাদের বাস্ত্তভিটা ও তৎসংলগ্ন জমি ছিল করমুক্ত। এই সুবিধাকে বলা হতো খানাবাড়ি।

নোয়াবাদ অপারেশনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কলকাতার মুৎসুদ্দি জয়নারায়ণ ঘোষালের জমিদারি সনদ। তিনি ছিলেন দেওয়ান গোকুল ঘোষালের ভ্রাতুষ্পুত্র। গোকুল ঘোষাল গভর্নর হ্যারি ভেরেলস্ট-এর মুৎসুদ্দি এবং ১৭৬০ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের দীউয়ান ছিলেন। ১৭৬০ সালে তিনি চট্টগ্রামের প্রধান প্রশাসক হ্যারি ভেরেলস্ট (১৭৬০-১৭৬৫) এর নিকট থেকে সমগ্র অনাবাদি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওপর একটি জমিদারি সনদ লাভ করেছেন বলে দাবি করেন। ঐ সনদে প্রদত্ত অধিকারবলে জয়নারায়ণ চট্টগ্রামের সকল নোয়াবাদ জমিই তাঁর জমিদারির অংশ বলে দাবি করেন। তাঁকে প্রদত্ত সনদের ধারা উল্লেখপূর্বক তিনি দাবি করেন যে, ১৭৬০ সালের পর থেকে সকল নোয়াবাদ তালুকদারগণ উক্ত জমিদারের নিকট থেকে নোয়বাদ পাট্টা গ্রহণ করতে আইনত বাধ্য। কিন্তু আবাদকারী জমিদার এবং তালুকদারগণ জয়নারায়ণ ঘোষাল দাবীকৃত ঐ সনদকে উদ্ভট ও অবৈধ বলে প্রতিবাদ জানায়। তাদের অসন্তোষ প্রায়শ স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনে রূপ নেয়। এহেন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম কাউন্সিল অবশেষে ১৭৯৭ সালে জয়নারায়ণের সনদ বাতিল ঘোষণা করে। এর কারণস্বরূপ যুক্তি দেওয়া হয় যে সনদটি সর্বৈব মিথ্যা। কিন্তু সনদ বাতিলের পরও প্রকৃতপক্ষে সকল পুরানো নোয়াবাদ জমি তরফ জয়নারায়ণ-এর অংশ হিসেবে স্বীক…ৃত লাভ করল। অর্থাৎ ভবিষ্যতে নতুন নোয়াবাদ তালুক আর তরফ জয়নারায়ণের অন্তর্ভুক্ত হবে না। চট্টগ্রামের ভূমি রাজস্বের ইতিহাসে এমন কান্ড এটাই প্রথম নয়। বাস্তবিকই চট্টগ্রামের নোয়াবাদ কাহিনীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঘন ঘন ভূমি জরিপ, বার বার রাজস্ব হার বৃদ্ধি, চুক্তি বাতিল ও পুনর্বার নতুন বন্দোবস্ত ইত্যাদি। চট্টগ্রামের নোয়াবাদ তালুককে বহুলাংশে তুলনা করা যায় দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য জেলাগুলির হাওলা স্বত্বের সঙ্গে।  [সিরাজুল ইসলাম]