নোয়াপাড়া-ঈশানচন্দ্রনগর

নোয়াপাড়া-ঈশানচন্দ্রনগর  কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের নিকটবর্তী বর্তমান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্রাচীন অনুদ্ঘাটিত প্রত্নস্থল। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে ৯ বর্গ কিলোমিটারের অধিক এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। দুটি স্বতন্ত্র কিন্তু অসম অংশে বিভক্ত প্রত্নস্থলটি চৌদ্দগ্রামের ৩ কিমি উত্তর ও কুমিল্লার ২৪ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত। মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত ক্ষুদ্র অংশটি নোয়াপাড়া গ্রামের অন্তর্গত। আর সড়কের পূর্ব পার্শ্বের মূল অংশটি দক্ষিণ থেকে উত্তরে পর্যায়ক্রমে ঈশানচন্দ্রনগর, রাজেন্দ্রপুর ও রাঙামাটিয়া গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। ধ্বংসাবশেষ উত্তরে আরও খানিকটা বিস্তৃত হয়ে শালুকিয়া গ্রামে আংশিক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রত্নস্থলের পূর্বে সামান্য দুরত্বে ভারতীয় সীমানা ও ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চল (ঐতিহ্যগতভাবে রঘুনন্দন নামে পরিচিত) অবস্থিত। তুলনামূলকভাবে উঁচু ও লাল মাটি দ্বারা গঠিত এ গ্রামগুলিতেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষসমূহ বিন্যস্ত। যদিও বর্তমানে বেশিরভাগ প্রাচীন অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তবুও যা রয়েছে তা প্রাচীনত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। বহু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে, এ ধ্বংসাবশেষসমূহ সাত শততে সমতটের হারিয়ে যাওয়া খড়গ বংশীয় রাজধানী ‘করমান্ত বাসক’-এর প্রতিনিধিত্ব করছে।

পাশ্চিম অংশ, নোয়াপাড়া, এখানকার প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ এর জন্য সুপরিচিত; প্রাচীন বসতির ধর্মীয় অংশ। যদিও সমগ্র প্রত্নস্থলের এটি একটি অখন্ড অংশ, তথাপি এ পবিত্র স্থানটি প্রাচীনকালে ১০ একরের একটি বড় দিঘি দ্বারা বিভক্ত ছিল। সম্প্রতি রাস্তা বড় করার জন্য এ প্রাচীন দিঘির পশ্চিম অংশটি ভরাট করা হয়েছে। ফলে দিঘির এ অংশে প্রায় ৩০০ বছর ধরে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ১১ মিটার উঁচু একটি হিন্দু মঠ ধ্বংস হয়েছে। স্তূপ অঞ্চলটি, মতান্তরে বর্ধন, বর্ধন রাজার মুরা অথবা ভজন মুরা নামে পরিচিত, কুমিল্লার জনপ্রিয় কিংবদন্তী রাজা ভবচন্দ্রের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। অবশ্য ভবচন্দ্রের ঐতিহাসিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি।

নোয়াপাড়ার দুটি প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপের মধ্যে প্রাচীনটি গ্রামের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। প্লাস্টার ও অলংকারবিহীন স্তূপটি যদিও ক্ষতিগ্রস্ত ও জীর্ণ, নিচের অংশ ঘন গাছপালা ও জঙ্গলাকীর্ণ, তথাপি ১৯৭৬ সালে এটি প্রায় ৮ মিটার উঁচু ছিল। ১৯৮৮ সালে আ.ক.ম জাকারিয়া এর প্রাচীর থেকে বেশ কিছু পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করেন। ফলকগুলি শালবন বিহারের প্রাথমিক স্তরের (সাত-আট শতক) ফলকের প্রায় অনুরূপ। এ অসাধারণ প্রাচীন সৌধটি গত শতকের নববই-এর দশকের প্রথম দিকেই ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। আকারে ছোট নোয়াপাড়ার অন্য স্তূপটি আরও বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত ও জীর্ণ। বড় স্তূপটির ১৫২ মিটার উত্তরে একটি আধুনিক গোরস্থানের কাছে এটি অবস্থিত ছিল। ১৯৭৬ সালে এটি প্রায় ৪ মিটার উঁচু ছিল। পরবর্তী সময়ে এটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। সম্ভবত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণের জন্যই এটি ধ্বংস করা হয়, যা এখন ঐ এলাকাটি দখল করে আছে।

নোয়াপাড়ার পশ্চিমাংশে রয়েছে একটি জলমগ্ন নিচু স্থান, যা দোল সমুদ্র নামে পরিচিত। এটি চৌদ্দগ্রাম ছাড়িয়ে লাকসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। স্পষ্টত প্রাচীনকালে এটি একটি বড় নদী ছিল। অনতিকাল আগে এখান থেকে চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামে নিয়ত ফেরি চলাচল করত, যা রাজঘাট নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীনকালে এখানে যে একটি পাকা ঘাট ছিল এটাই তার পরোক্ষ প্রমাণ। স্থানীয় জনশ্রুতিতে এখানে একটি রাজপ্রাসাদ ও রাজধানী ছিল বলে জানা যায়।

প্রত্নস্থলের প্রধান অংশ দখলকারী বর্তমানের আধুনিক গ্রাম তিনটির মধ্যে দক্ষিণের ঈশানচন্দ্রনগর সর্ববৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ। দুটি প্রাচীন পুকুর পশ্চিমের বড়টি নোয়াপাড়া মুখী এবং পূর্বের ছোটটি ত্রিপুরা পাহাড় মুখী দুই পাশে অবস্থিত। এ চৌহদ্দিতে প্রাচীনকালের বসতিটি সুনির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত ছিল। ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে, ধ্বংসাবশেষটি একটি প্রাচীন রাজধানীর প্রাসাদ ও প্রশাসনিক ভবনকে ধারণ করছে। গ্রামগুলির সর্বত্রই ইটের স্তূপ ও ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন পাওয়া গেলেও, মূল্যবান ও গুরুত্বসূচক কোন সাংস্কৃতিক প্রত্নসামগ্রী চোখে পড়ে না।

পার্শ্ববর্তী অপর দুটি গ্রামের মধ্যবর্তী গ্রাম রাজেন্দ্রপুর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে উত্তর সীমান্তের শেষ গ্রাম রাঙামাটিয়া গুরুত্বপূর্ণ। কৈলাস চন্দ্র সিংহ তাঁর রাজমালায় (ত্রিপুরার ইতিহাস) রাঙমাটিয়া যে এ এলাকার রাজ্য, তা তিনবার উল্লেখ করেছেন। যদিও এখানে রাঙামাটিয়ার সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কোন ধারণা দেওয়া হয়নি, তথাপি উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি কমলাঙ্ক অথবা পটিকর (পট্টিকের) রাজ্যের পূর্বে অবস্থিত। সেক্ষেত্রে ভরাট হয়ে যাওয়া প্রাচীন জলপ্রবাহ ‘দোল সমুদ্র’ নোয়াপাড়ার পশ্চিম পার্শ্বে ছিল এবং প্রাচীনকালে এটিই দুই রাজ্যের সীমারেখা চিহ্নিত করতো। সম্ভবত রাঙামাটিয়া ছিল এ প্রাচীন রাজ্যের কেন্দ্র। অনেকেই রাঙামাটিয়াকে বাংলার চন্দ্র বংশের প্রাথমিক রাজ্য ‘রহিতাগিরি’-এর সাথে অভিন্ন বলে মনে করেন।

তারপরও, এটা বলতেই হয় যে, এই সামান্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সুনির্দিষ্টভাবে এটা বলা কঠিন যে, এই বিশাল প্রত্নস্থলটিই খড়্গ রাজবংশের হারিয়ে যাওয়া রাজধানী ছিল কি না। [এম হারুনুর রশিদ]