নির্বাচনী আইন

নির্বাচনী আইন নির্বাচন সংক্রান্ত আইনবিধান। সুষ্ঠভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা, প্রার্থী এবং প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারীদের আচরণ ব্যাখ্যা এবং এ সম্পর্কিত বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা নির্বাচনী আইনের লক্ষ্য।

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দান করেন। নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনের আওতায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ এবং কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা ১৯৭২ এবং আচরণ বিধিমালা ১৯৯৬ প্রণীত হয়। এসব আদেশ ও বিধিমালার সমন্বয়েই নির্বাচনী আইনবিধান গঠিত।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এ আদেশের ৩ ধারায় উল্লিখিত বিধান সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশন তার নিজস্ব পদ্ধতি নির্ধারণ করবেন। আদেশের ৫ ধারাবলে নির্বাচন কমিশন যেকোন ব্যক্তি অথবা কর্তৃপক্ষকে তার যেরূপ দায়িত্ব পালন এবং যেরূপ সহায়তা প্রদানের প্রয়োজন সেরূপ দায়িত্ব বা সহায়তা প্রদানে নির্দেশ দিতে পারেন। নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত কোনো কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বাধা দান বা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার মতো কোনো কাজ করলে, নির্বাচন কমিশন যেকোন সময় নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে তাকে বা তাদের অব্যাহতি দিতে পারবেন এবং প্রয়োজনে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিতে পারবেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৭ ধারা অনুসারে নির্বাচন কমিশন এক বা একাধিক নির্বাচনী এলাকার সংসদ-সদস্য নির্বাচনের জন্য একজন রিটার্নিং অফিসার ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারি রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করতে পারবেন। বিধিবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসারের উপর ন্যস্ত। সহকারি রিটার্নিং অফিসারগণও রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে রিটার্নিং অফিসারের কার্যক্রম সম্পাদনের দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। ৯ ধারায় রিটার্নিং অফিসারকে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি প্যানেল তৈরির কথা বলা হয়েছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১১ ধারায় মনোনয়নপত্র দাখিল ও বাছাইয়ের তারিখ নির্ধারণ ও প্রচারে নির্বাচন কমিশনকে প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ১২(১) ধারায় জাতীয় সংসদের সদস্যপদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা সদস্য হওয়ার যোগ্যতা বর্ণিত হয়েছে। ১৩ ধারায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় প্রার্থী স্বয়ং কিংবা বিধিতে বর্ণিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঙ্কের জামানত প্রদানের কথা বর্ণিত হয়েছে। ১৪ ধারায় মনোনয়নপত্র বাছাই করার ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারের উপর অর্পিত হয়েছে। ১৪(৫) ধারায় রিটার্নিং অফিসারগণ কর্তৃক মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের নিকট নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আপিল দায়েরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৫ ধারায় বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। ১৬(১) ও ১৬(২) ধারা অনুসারে বৈধভাবে মনোনীত যেকোন প্রার্থী তার নিজ স্বাক্ষরে লিখিত নোটিসের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে পারবেন।

আদেশের ১৭ (১) ধারায় বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচন বাতিলের কথা বলা হয়েছে। ১৯ ধারায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। ২০ ধারায় নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ক্ষেত্রে প্রার্থীদের পছন্দ অনুসারে প্রতীক বরাদ্দের বিধান রয়েছে। ২০ (২) ধারা অনুসারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম ও প্রতীক সম্পর্কিত পোস্টার প্রত্যেক ভোটকেন্দ্রে প্রদর্শন করতে হবে। ২১ (১) ধারায় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী এজেন্ট এবং ২১ (২) ধারায় পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। ২৭ (২) ধারা অনুসারে ভোটার তালিকা অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৮ ধারার (২), (৩) অথবা (৪) উপধারায় বর্ণিত ভোটারদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের অধিকার দেয়া হয়েছে।

আদেশের ৩৭ ধারায় প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার ফলাফল একত্র করা এবং ৩৭ (৫) ধারায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বা তার প্রতিনিধির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভোট পুনঃগণনার বিধান রয়েছে। ৩৯ (১) ধারা অনুসারে রিটার্নিং অফিসার গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবেন। ৪৪-ক ধারার (১) উপধারা অনুসারে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে রিটার্নিং অফিসার প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের উৎস-বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেবেন। ৪৪-খ ধারার (৩) উপধারায় প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা (সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা) নির্ধারিত হয়েছে। ৪৪-গ ধারা অনুসারে রিটার্নিং অফিসার নির্বাচনী ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রার্থী এবং নির্বাচনী এজেন্টদের নির্দেশ দেবেন। ৪৯(১) ধারা অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী যেকোন প্রার্থী নির্বাচনের বৈধতা সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন করে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন।

আদেশের ৭৩ ধারায় ৪৪-ক ও ৪৪-খ এর বিধান লঙ্ঘন, ঘুষ গ্রহণ, ছদ্মবেশ ধারণ, নির্বাচনে অসঙ্গত প্রভাব খাটানো, কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী সাফল্যে বিঘœ সৃষ্টি বা তার নিজস্ব বা আত্মীয়স্বজনের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতিদান, কোনো প্রার্থীর প্রতীক বা প্রার্থিতা প্রত্যাহার সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতিদান, কোনো প্রার্থীর বিশেষ সামাজিক বা ধর্মীয় অবস্থানের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটদানের আহবান বা প্ররোচিতকরণ, ভোটার উপস্থিতিতে বা ভোটদানে বাধা দান এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঘুষ গ্রহণকে দুর্নীতিমূলক অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৭৪ ধারায় বেআইনি আচরণের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এবং এর জন্য জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ৭ বছর ও সর্বনি¤œ ২ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ৭৮ ধারায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিবাগত মধ্যরাত থেকে পূর্ববর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচনী এলাকাভুক্ত সকল স্থানে জনসভা আহবান, অনুষ্ঠান ও তাতে যোগদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘিত হলে ৭৮(২) ধারা অনুসারে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং সর্বনি¤œ ২ বছর কারাদন্ড হতে পারে। ৮০ ধারায় ভোটকেন্দ্রের কাছে উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য জরিমানাসহ ঊর্ধ্বে ৩ বছর, নি¤েœ ৬ মাস কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে (কগনিজিবল অফেন্স)। ৮১(১) ধারায় ব্যালট চুরি, জালভোট দান, সীলমোহর ভেঙে ফেলা, নির্বাচন পরিচালনায় বাধা দান প্রভৃতি অবৈধ হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনি¤œ ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে (কগনিজিবল অফেন্স)।

আদেশের ৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে কাজ করলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং সর্বনি¤œ ১ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন (কগনিজিবল অফেন্স)। ৮৬ ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত থেকে কোনো ব্যক্তি নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার করলে তিনি জরিমানাসহ ঊর্ধ্বে ৫ বছর, নি¤েœ ১ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। ৯১ ধারা অনুসারে বল প্রয়োগ, ভয় প্রদর্শন এবং চাপ সহ অন্যায় আচরণমূলক কার্যকলাপ চালু থাকার কারণে সুষ্ঠু ও আইনসম্মতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় নি বলে মনে হলে নির্বাচন কমিশন সে পর্যায়ে যেকোন ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন। ৯১-খ ধারা অনুসারে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের প্রাক্কালে অনিয়ম রোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারী কমিটি গঠন করতে পারবেন। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পূর্বেই তদন্ত পরিচালনা করবে এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে।

নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১ সুষ্ঠ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচন কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন ১৯৯১ জারি রয়েছে। এ আইন দ্বারা নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ (১৯৯০ সালের অধ্যাদেশ নং ৩১) রহিত করা হয়। এ আইনের ৪ ধারায় নির্বাচন কর্মকর্তার চাকুরি ও তার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিধি জারি রয়েছে। এ আইনের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে: কোনো ব্যক্তি নির্বাচন কর্মকর্তা নিযুক্ত হলে, তিনি কমিশন বা ক্ষেত্রবিশেষে রিটার্নিং অফিসারের কাছে গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া তার দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করতে পারবেন না। নিয়োগের তারিখ হতে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত তার চাকুরির অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে কমিশনের অধীনে প্রেষণে চাকুরিরত আছেন বলে গণ্য হবেন।

এ আইনের ৫ ধারায় নির্বাচন কর্মকর্তার শৃঙ্খলামূলক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কোনো নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন বা ক্ষেত্রবিশেষে রিটার্নিং অফিসারের প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং ওই অসদাচরণ তার চাকুরিবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা, ১৯৭২ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৯৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সরকার নির্বাচনী বিধিমালা ১৯৭২ প্রণয়ন করে। এই বিধিমালার ৫ বিধিতে মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে প্রার্থীকে আপিল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ৬ বিধিতে মনোনীত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের প্রক্রিয়া বিবৃত হয়েছে। ৭ বিধিতে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের শেষ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রতীক বরাদ্দসহ চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। ৮ বিধিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার প্রক্রিয়া এবং ৯ বিধিতে প্রতীক তালিকা উল্লিখিত হয়েছে। ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ বিধিতে ব্যালট পেপার তৈরির পদ্ধতি, পোস্টাল ব্যালট ইস্যু ও তার ভোট রেকর্ড, নিরক্ষরদের ভোট রেকর্ডের প্রক্রিয়া, পোস্টাল ব্যালটের রিটার্ন এবং রি-ইস্যু করার পন্থা বিবৃত হয়েছে। ১৫-ক বিধিতে ব্যালট বাক্স রেকর্ড, ১৬ ও ১৭ বিধিতে ব্যালট পেপার মার্কিং এবং ১৮ বিধিতে তা বাক্সে ঢোকানোর পদ্ধতি বলা হয়েছে। ২০ বিধিতে প্রার্থী কর্তৃক ভোট চ্যালেঞ্জ প্রক্রিয়া, ২১ বিধিতে পরিত্যক্ত ব্যালট বাতিলের প্রক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। ২২, ২৩, ২৪, ২৫ বিধিতে বর্ণিত হয়েছে ভোট গণনা, প্রিসাইডিং অফিসার কর্তৃক বিবরণ তৈরি, ফলাফল একত্রীকরণের পদ্ধতি। ২৬ বিধিতে ভোট গ্রহণ সংক্রান্ত কাগজপত্রের পাবলিক ইন্সপেকশন পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

আচরণ বিধিমালা, ১৯৯৬ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর ৯১-খ ধারার ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন আচরণ বিধিমালা ১৯৯৬ প্রণয়ন করে। এ বিধিমালার ৩ ধারায় চাঁদা, অনুদান ইত্যাদির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা জনসমক্ষে পেশ করা যাবে। তবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী কিংবা তার পক্ষ হতে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার কোনো প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো প্রকার চাঁদা বা অনুদান প্রদান বা প্রদানের অঙ্গীকার করা যাবে না, অথবা সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় কোনো প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের অঙ্গীকার করা যাবে না। ৫ বিধিতে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী নির্বিশেষে প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান অধিকার থাকবে; কোনো প্রতিপক্ষের সভা, শোভাযাত্রা এবং অন্যান্য প্রচারাভিযান পন্ড করা বা তাতে বাধা প্রদান করা যাবে না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল বা তার পক্ষে কেউ নির্বাচনী কাজে সরকারি প্রচারযন্ত্রের ব্যবহার, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারিগণকে ব্যবহার বা সরকারি যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার হতে বিরত থাকবেন। নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টার দেশি কাগজে সাদাকালো রঙের হতে হবে এবং আয়তন কোনো অবস্থাতেই ২২" ী ১৮" পরিমাপের অধিক হতে পারবে না। নির্বাচনী প্রচারণা হিসেবে সকল প্রকার দেয়াল লিখন থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে।

আচরণ বিধিমালার ৬ বিধিতে বর্ণিত হয়েছে যে অর্থ, অস্ত্র, পেশীশক্তি কিংবা স্থানীয় ক্ষমতা দ্বারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যাবে না। ৭ বিধিতে বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারি, প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট এবং কেবল ভোটারদেরই প্রবেশাধিকার থাকবে। কেবল পোলিং এজেন্টগণ তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে উপবিষ্ট থেকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। ৮ বিধিতে বলা হয়েছে, এ বিধিমালার যেকোন বিধান লঙ্ঘন নির্বাচন-পূর্ব অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে এবং ঐ অনিয়মের দ্বারা সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল প্রতিকার চেয়ে ইলেক্টোরাল এনকোয়ারি কমিটি বা নির্বাচন কমিশন বরাবরে আর্জি পেশ করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন বরাবরে পেশকৃত আর্জি কমিশনের বিবেচনায় বস্তুনিষ্ঠ হলে কমিশন তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট বা যেকোন ইলেক্টোরাল ইনকুয়ারি কমিটির নিকট প্রেরণ করবেন। উভয় ক্ষেত্রে ইলেক্টোরাল ইনকুয়ারি কমিটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৫৫)-এর বিধান মোতাবেক তদন্তকার্য পরিচালনা করে কমিশন বরাবরে সুপারিশ পেশ করবে।

  • ২০০৮ সালের পর থেকে উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ শুরু হয়।
  • ২০০৭ সালে শামসুল হুদা কমিশনের দায়িত্বের প্রধান বিষয়গুলোর সর্বাগ্রে ছিল একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন। ২০০৭-০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘ডিজিটাল’ ডেটাবেজ বা তথ্যভা-ার তৈরির সফল উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রায় ১১ মাসে সম্পূর্ণ হয়েছিল ছবিসহ ভোটার তালিকা এবং প্রত্যেক ভোটারের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র। ২০০৮ সালের ভোটার তালিকায় ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৪৮। ভোটার তালিকার শুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে আইএফইএস (IFES: International Foundation for Electoral System) নামক আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিয়ে নিরীক্ষণ করা হয়। এদের রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে ভোটার তালিকা, সর্বাঙ্গিক ৯৯ শতাংশ শুদ্ধ।
  • ২০০৮ সালে জারিকৃত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় অধ্যাদেশ পরবর্তী সময়ে অপরিবর্তিত অবস্থায় ২০০৯ সালে সংসদে আইন দ্বারা অনুমোদিত হয়।
  • ২০০৭-০৮ সালে আরপিও সংশোধনীকালে সবদলের সম্মতিতেই নমিনেশন পাওয়ার উপযুক্ত সময় ন্যূনতম ৩ বছর ওই দলের সদস্যপদে থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। প্রাথমিক সুপারিশে ন্যূনতম ৫ বছরের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশে ৩ বছর বহাল রাখা হয়েছিল। যাতে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও হঠাৎ ‘মনোনয়ন’ নিয়ে নির্বাচনে টাকার খেলা থেকে বিরত রাখা যায়। (RPO-1972; Section 12 (i) (j) আরপিওর এই উপধারাটি পরে ২০১৩ সালে সংসদের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ঠেকাতে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের অনুচ্ছেদ (IV) এ আরেকটি অনু-অনুচ্ছেদের মাধ্যমে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার আইন সংযোজন করা হয়। এই অনুচ্ছেদে তৃণমূল পর্যায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন এবং থানা, পর্যায় হতে ন্যূনতম তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থীর প্যানেল তৈরি করে কেন্দ্রে সুপারিশ করবে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারী বোর্ড চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবে।
  • গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ এর সবচাইতে আলোচিত পরিবর্তন আনা হয় আদেশ এর Chapter-VI-এ এর মাধ্যমে। নির্বাচন কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। নিবন্ধনের শর্তগুলোতে মহিলা নেতৃত্ব এবং রাজনীতিতে মহিলাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের তৃণমূল হতে কেন্দ্রীয় কমিটিগুলোতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩% নারীদের অন্তর্ভুুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
  • ২০০৯ সাল থেকেই নির্বাচন কমিশন EVM বাস্তবায়নের ভাবনা শুরু করে। অবশেষে প্রথমবারের মতো জুন ১৭, ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জামাল খান ওয়ার্ডে EVM-এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়। এই মেশিন পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জে আংশিক, কুমিল্লা ও নরসিংদীতে পূর্ণ ব্যবহার হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল ওটিপি চিপ (OTP: One time Programable Chip)-এর মাধ্যমে।
  • সীমানা নির্ধারণে প্রথমবারের মতো নির্বাচন কমিশন জিআইএস (GIS: Geographic Information Systems) ব্যবহার করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের ম্যাপসহ যাবতীয় তথ্য সম্বলিত ৩৯৬ পৃষ্ঠার সচিত্র পুস্তক ‘কনসিটিউয়েন্সি ম্যাপস অব বাংলাদেশ’ প্রকাশ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে প্রেরণ করা হয়েছিল।
  • ২০১৩ সালে আরপিও সংশোধন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনীকে বাদ দেয়া হয়। ফলে আরপিও বা নির্বাচনী আইনের অধীনে আর সামরিক বাহিনীর নিয়োগ হবে না।

[আমিনুর রহমান সরকার]